ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির ধারাবাহিকতায় আলুর বাজারেও বড় ধরনের অস্থিরতা শুরু হয়েছে। এই নিত্যপণ্যের মূল্য এখন অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। আসলে আমাদের দেশে বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেই। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর তৎপরতা একেবারে দায়সারা গোছের। বাজার তদারকী যাদের দায়িত্ব তারাও এক্ষেত্রে বেশ উদাসীন। সরকারের নেই কোন কার্যকর পদক্ষেপ। ফলে বাজার চলে স্বশাসনে; সিন্ডিকেট ও অতিমুনাফাখোর গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে। সঙ্গত কারণেই আমাদের দেশের বাজার পরিস্থিতি সব সময় অস্থিতিশীল। আর এতে সবচেয়ে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হোন দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী।
দেশের সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা না বাড়লেও আমাদের দেশের নিত্যপণ্যের বাজার সবসময়ই ক্রমবর্ধমান। চাল, ডাল, পিঁয়াজ, রসুন ও আদাসহ অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য এখন সাধারণ মানুষের রীতিমত ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। এমনকি অতিপ্রয়োজনীয় সবজি আলু নিয়ে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের সিন্ডিকেটের অভিযোগ উঠেছে। ফলে বাজারে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আলুর দাম। কৃষি বিপণন অধিদফতরের সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী দেশি সাদা আলুর পাইকারি পর্যায়ে যৌক্তিক মূল্য ছিল ২৩ টাকা ৩০ পয়সা; অথচ পাইকারি বাজারে বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি সর্বোচ্চ ৪৩ টাকা দরে। যৌক্তিক মূল্যের চেয়ে কেজিতে শুধু পাইকারি বাজারেই ২০ টাকা বেশি রাখা হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে খুচরা পর্যায়ে। ভরা মৌসুমেও প্রতি কেজি আলুর জন্য ভোক্তাকে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা গুণতে হচ্ছে।
শুধু পাইকারি নয়, কৃষক পর্যায়ে গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ দামে এ বছর আলু বিক্রি হচ্ছে বলে একটি ডিসি রিপোর্ট বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এসেছে। রংপুর থেকে পাঠানো ওই ডিসি রিপোর্টে দাম বাড়ার দু’টো কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। ১. মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বেশি লাভের আশায় আলু কিনে মজুত করছেন। ২. আলু কিনে হিমাগারে মজুত করায় সংরক্ষণ ব্যয় বেশি পড়ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে সামনে আলুর দাম খুচরা পর্যায়ে ৬০ টাকা কেজি ছাড়িয়ে যেতে পারে বলেও সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ডিসি রিপোর্টে। যা জনমনে রীতিমত উদ্বেগ-উৎকন্ঠার সৃষ্টি করেছে।
রংপুর জেলা প্রশাসন সূত্র বলছে, রংপুর বিভাগে ৪০টি হিমাগারের ধারণ ক্ষমতা ৪ লাখ ২২ হাজার ৫৩৮ মেট্রিক টন। ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত হিমাগারগুলোতে খাবার ও বীজ আলু মিলিয়ে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৩ মেট্রিক টন আলু সংরক্ষণ করা হয়েছে। বস্তার হিসাবে ৫২ লাখ ৩৬৮ বস্তা। গত বছর প্রতি বস্তা আলু সংরক্ষণে ৩০০ টাকা হিমাগার ভাড়া থাকলেও এবার তা বাড়িয়ে ৩৮৫ টাকা করা হয়েছে। প্রতি বস্তায় শুধু সংরক্ষণ চার্জ বাড়ছে ৮৫ টাকা। এটি আলুর মূল্য বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলবে বলে চিঠিতে উল্লেখ করেছে জেলা প্রশাসন। সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, আলুর দাম বাড়ার পেছনে বেশ কিছু বিষয় কাজ করছে। প্রথম পর্যায়ে কৃষক কিছুদিন আলু ধরে রাখায় ভরা মৌসুমেও সবজিটির দাম বেশি পড়ছে। তবে এখন আর কৃষকের হাতে আলু বেশি নেই। হিমাগার থেকে আলু বেরোচ্ছে। ফলে খুব দ্রুত দাম কমে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। আলু নিয়ে সরকার পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে তিন, চার মাস পর দাম আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন রংপুরের জেলা প্রশাসক। এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের বক্তব্য হলো, মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে ঢাকা থেকে খুব বেশি করণীয় নেই। আলুর মজুতদারি ও অতিরিক্ত মুনাফা ঠেকাতে জেলা প্রশাসকদের আগে থেকেই নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে। তারা যদি স্থানীয় পর্যায়ে সঠিকভাবে বাজার মনিটরিংয়ের পাশাপাশি হিমাগার থেকে আলু ছাড়ার বিষয়টি মনিটরিং করেন তবে পাইকারি বাজারে সরবরাহ বাড়বে। সরবরাহ বাড়লেই দাম কমে আসবে। কিন্তু এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের ইতিবাচক পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
আলু আমাদের দেশে অতিপ্রয়োজনীয় একটি সবজি। কিন্তু এই পণ্যটির দাম এখন অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বড় ধরনের বিপাকে পড়েছেন প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ। তাই আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জনমনে স্বস্তি ফিরে আনা দরকার। এ জন্য সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সিন্ডিকেট মোকাবেলায় নিতে হবে জোরালো পদক্ষেপ। অন্যথায় আগামী দিনে সার্বিক পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে।