অস্ত্র তাক করা অবস্থায় নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছিলেন প্রিজাইডিং অফিসার মো. বিল্লাল হোসেন। কিছুই করার ছিল না তার। অস্ত্রধারীরা বন্দুক তাক করে ব্যালট নিয়ে সিলমারা শুরু করে। ভোট শুরুর আগে প্রায় দেড়ঘণ্টা বন্দি ছিলেন তিনি। আর এই সময়ে অস্ত্রধারী ওই যুবকরা চেয়ারম্যান পদে ৫শ’, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৫শ’ ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৫শ’ ভোট ব্যালটে দিয়ে বাক্সের ভেতরে ঢুকিয়ে চলে যায়। যাওয়ার সময় হুমকিও দেয়; ঘটনাটি কাউকে না বলার।
এমন ঘটনা ৮ই মে বিশ্বনাথের আলোচিত নোয়ারাই ভোটকেন্দ্রে ভোটের দিন ভোরে ঘটেছিল। এই কেন্দ্রের ভোট নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতার কারণে মধ্যরাত পর্যন্ত বিশ্বনাথ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা সম্ভব হয়নি। কারণ; দিনভর যে ভোট পড়েছিল সেই ভোটের ফলাফলে অনেক প্রার্থীর এজেন্টরা স্বাক্ষর করেননি। পরে অবশ্য জটিলতা কাটিয়ে রাত পৌনে ১টার দিকে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়।
কী ঘটেছিল বিশ্বনাথের খাজাঞ্জি ইউনিয়নের নোয়ারাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে। এনিয়ে এখনো বিশ্বনাথে চলছে কৌতূহল। পরাজিত প্রার্থীরা এ ফলাফল মেনে নিতে পারছেন না। সংক্ষুব্ধ প্রার্থী সেবুল মিয়া কারচুপির অভিযোগ এনে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। তবে; নোয়ারাই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার এ ব্যাপারে সাংবাদিকদের কাছে মুখ খুলেছেন। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেছেন; ভোর রাত ৫টা। কেন্দ্রের দোতলায় প্রিজাইডিং অফিসারের কক্ষে ছিলেন তিনি।
ফজরের নামাজ পড়তে ঘুম থেকে উঠেছেন। এমন সময় তার রুমে এসে পৌঁছেছে ব্যালট পেপার। অজু আদায় করেন। নামাজ পড়তে যাবেন এমন সময় কেন্দ্রে ঢুকলো ১৫-২০ জন লোক। কারও হাতে আগ্নেয়াস্ত্র, কারও হাতে দেশীয় অস্ত্র। রুমে ঢুকেই তারা ভেতর থেকে দরজা লক করে দেয়। তাকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ব্যালট পেপার হাতে নেয়। এরপর শুরু করে সিলমারা। প্রিজাইডিং অফিসার বিল্লাল হোসেন জানান, অস্ত্রধারীরা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১৫শ’ ভোট কাস্ট করে। এরমধ্যে চেয়ারম্যান পদের কিছু কিছু ব্যালটে তারা স্বাক্ষরও দিয়ে গিয়েছিল। এসময় কেন্দ্রে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত থাকলেও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে তারা পদক্ষেপ নিতে পারেনি। যুবকদের হাতে অস্ত্র থাকায় সবাই অসহায় হয়ে পড়েছিলেন।
প্রিজাইডিং অফিসার জানান, ভোট শুরুর পর সকাল ১০টার দিকে তিনি বিষয়টি বিশ্বনাথের দায়িত্বে থাকা সহকারী রিটার্নিং অফিসার স্বর্ণালী পালকে মোবাইল ফোনে অবগত করেন। এসময় সহকারী রিটার্নিং অফিসার ওদের দেয়া ভোট কাস্টিং না দেখাতে বলেন। ভোটের পরে বিষয়টি দেখবেন বলে জানান। এ কারণে ভোট শেষ হওয়ার পর যখন গণনায় তখন কেন্দ্রে সঠিকভাবে কাস্ট হওয়া ৮৬০টি ভোটের হিসাব করে তিনি ফলাফল দেন। আর ওই ১৫শ’ ভোট হিসাবে আনেননি। এনিয়ে কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণার সময় হট্টগোল দেখা দিলে ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে প্রিজাইডিং অফিসার ও নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের উপজেলা সদরে নিয়ে আসেন। এদিকে, বিশ্বনাথের ইউএনও কার্যালয়ে ফলাফল ঘোষণার সময় নোয়ারাই কেন্দ্রের ভোট নিয়ে আপত্তি তুলেন প্রার্থীরা। সেখানে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি কাস্টিং নিয়েও আপত্তি তোলেন। প্রার্থীদের আপত্তির কারণে রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ফলাফল ঘোষণা করা সম্ভব হয়নি। পরে রাত পৌনে একটার দিকে প্রিজাইডিং অফিসারের দেয়া ফলাফলকে আমলে নিয়ে চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করা হয়। তবে; এই কেন্দ্রের ফলাফল নিয়ে বিশ্বনাথে এখনো বিতর্ক কাটছে না। কয়েক দিন আগে সংবাদ সম্মেলন করে কেন্দ্রের ফলাফল নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন প্রতিদ্বন্দ্বী চেয়ারম্যান প্রার্থী মো. সেবুল মিয়া। গতকাল তিনি মানবজমিনকে জানিয়েছেন; বিশ্বনাথের ফলাফলে কারচুপি হয়েছে এটা নোয়ারাই কেন্দ্রের ভোট পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়। বিষয়টি নিয়ে নির্বাচন কমিশনে আপত্তি জানাবেন। প্রয়োজনে আইনি লড়াইয়ে নামবেন বলে জানান তিনি। বিশ্বনাথের ম্যাজিস্ট্রেটদের দায়িত্বে থাকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহীনা আক্তার মানবজমিনকে জানিয়েছেন; নোয়ারাই কেন্দ্রের ওই ঘটনা তাকে কেউ জানায়নি। যদি ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে অভিযোগ আসতো তিনি জানতেন। বিশ্বনাথের দায়িত্বে থাকা সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা স্বর্ণালী পাল মানবজমিনকে জানিয়েছেন, প্রিজাইডিং অফিসারদের প্রতি আমাদের নির্দেশনা ছিল সঠিক কাস্টিং ভোটগ্রহণের গণনা করে ফলাফল প্রকাশ করতে হবে। সেটি করা হয়েছে। আর কেন্দ্রে অস্ত্রধারীরা গিয়ে প্রিজাইডিং অফিসারকে বন্দি করে ভোট দিয়েছে; এমন অভিযোগ লিখিতভাবে তাকে কেউ জানায়নি বলে জানান তিনি।