বিদেশি ঋণ পরিশোধ প্রশ্নে বেশ চাপে আছে অর্থনীতি। ঋণ মেটাতে গিয়ে অর্থ সংকটে রয়েছে সরকার। পুরোনো দেনার বোঝা নামাতে গিয়ে বাধ্য হয়ে নতুন ঋণের দিকে ঝুঁকতে হচ্ছে। এ কারণে আগামীতে আরও মাশুল গুনতে হতে পারে। একদিকে অতিমাত্রায় ঋণ নেওয়া, অন্যদিকে ডলারের বিনিময়ে টাকার ধারাবাহিক দর পতনের কারণে চাপের বৃত্ত থেকে কোনোভাবেই বের হওয়া যাচ্ছে না। এ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে বিদেশি ঋণের সুদ-আসল পরিশোধে ৬৭ শতাংশ বেশি টাকা খরচা করতে হয়েছে। ডলারের হিসাবে যা ৪৮ শতাংশ। এ সপ্তাহের শুরুতে ডলারের দাম আরেক দফা বেড়েছে। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমেই তলানিতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে রিজার্ভ এখন ১৮ বিলিয়ন ডলার, যা গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম।
এ পরিস্থিতিতে ডলারের সরবরাহ বাড়াতে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বাজেট সহায়তা পাওয়ার চেষ্টা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ উদ্দেশ্যে আগামী বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) রেকর্ড ১ লাখ কোটি টাকা বিদেশি ঋণ নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের চাহিদা ছিল ৯১ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ, চাহিদার চেয়েও ৯ হাজার কোটি টাকা বেশি ঋণ নেওয়া হচ্ছে। এ অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির তুলনায় আগামী অর্থবছরের এডিপিতে বিদেশি ঋণ বাড়ছে প্রায় ২০ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ১৬ হাজার ৫০০ কোটি। এর আগে অন্য কোনো অর্থবছরে এডিপিতে বিদেশি ঋণের পরিমাণ এত বেশি ছিল না।
পরিকল্পনা কমিশনের বর্ধিত সভায় আগামী অর্থবছরের এডিপির খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদে (এনইসি) অনুমোদনের জন্য এই খসড়া তোলা হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের এনইসি সম্মেলেন কক্ষে অনুষ্ঠেয় বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন একনেক চেয়ারপারসন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সূত্র জানিয়েছে, আগামী অর্থবছরের এডিপির আকার ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। ১ লাখ কোটি টাকা হিসাবে মোট এডিপিতে বিদেশি ঋণের প্রস্তাবিত পরিমাণ প্রায় ৩৮ শতাংশ। এ অর্থবছরের এডিপিতে এ উৎসের বরাদ্দ ছিল ৯৪ হাজার কোটি টাকা। পরে সংশোধিত এডিপিতে তা ৮৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় কমিয়ে আনা হয়।
এ ব্যাপারে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান সমকালকে বলেন, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে সরকার দ্বান্দ্বিক সমস্যায় রয়েছে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে অর্থ সংকট দেখা দেবে। বিদেশি ঋণ নিলে পরিশোধের চাপ আরও বাড়বে। এ পরিস্থিতিতে রিজার্ভে ইতিবাচক প্রভাবের আশায় এডিপিতে বেশি পরিমাণ বিদেশি ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে বিদেশি ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে, যাতে পরিশোধের চাপ আরও অসহনীয় না হয়। ঋণের অর্থের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বিচক্ষণতার সঙ্গে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রকল্প সাজাতে হবে। যাতে ঋণের অর্থের ব্যবহার লাভজনক হয়, সময়মতো প্রকল্প শেষ হয়। এ ক্ষেত্রে সুশাসনের বিষয়ে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি তৎপর থাকতে হবে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের এডিপিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা সংস্থার বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পের বরাদ্দ নির্ধারণের জন্য চার দিনের ধারাবাহিক বৈঠক হয়। এর আগে প্রকল্প-সংশ্লিষ্টদের কাছে চাওয়া হয় বরাদ্দের ধারণা। বৈঠকগুলোতে বিস্তারিত আলোচনার পরই প্রকল্পভিত্তিক বরাদ্দের প্রাথমিক খসড়া তৈরি হয়। ইআরডির সংশ্লিষ্ট শীর্ষ এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, ১ লাখ কোটি টাকার মধ্যে ৪ হাজার কোটি টাকা আলাদা একটি হিসাবে রাখা হবে। পরিস্থিতি ও চাহিদা বুঝে পরে তা বরাদ্দ দেওয়া হবে।
গত তিন অর্থবছর এডিপিতে বিদেশি ঋণের বরাদ্দ প্রবণতায় দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের এডিপিতে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯২ হাজার ২০ কোটি টাকা। সংশোধিত এডিপিতে তা কমিয়ে ৭৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে মূল এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ৮৮ হাজার ২৪ কোটি টাকা, সংশোধিত এডিপিতে কমিয়ে ধরা হয় ৭২ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরের এডিপিতে বৈদেশিক অংশে বরাদ্দ ছিল ৭০ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ কমিয়ে ধরা হয় ৬৩ হাজার ১ কোটি টাকা।