নতুন সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছে জটিল রাজনীতি এবং কুটিল সাংবিধানিক বিতর্কের মধ্যদিয়ে। রাজনীতির বিষয়টি সাধারণ মানুষের কাছে সুস্পষ্ট। আওয়ামী লীগ আর আওয়ামী ঘরানা ব্যতীত অন্য কোন রাজনৈতিক দলকে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি। বিরোধীদের নিপীড়ন-নির্যাতন ও অন্যায় অবিচারের মাধ্যমে নির্বাচন থেকে নিবৃত্ত করা হয়েছে। মানুষ ভোট দিতে যায়নি। বশংবদ নির্বাচন কমিশন ১০ শতাংশকে লম্বা করে করে ৪০ শতাংশ বানিয়েছে। নির্বাচনটি ‘আমরা আর মামুরা’ বলে অভিহিত হয়েছে। তারপরও মারামারি, কাটাকাটি, ফাটাফাটি, খুন, জখম ও জালিয়াতিতে ছিলো পরিপূর্ণ। ৬২ জন ডামি প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছে। সত্যিই যদি ডামির পরিবর্তে আসলরা নির্বাচন করতো, তাহলে আওয়ামী সরকারের নির্বাসনে যাওয়া ব্যতীত উপায় ছিলো না। নির্বাচনের পর যথারীতি সরকার গঠিত হয়েছে। কিন্তু জনগণের মুখে তারা হাসি দেখতে পায়নি। অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে তাদের যাত্রা যে অনিশ্চিত তারা ভালো করেই সেটা জানে। কিন্তু স্বভাবসুলভ তাফালিং করতে, বেপরোয়া মনোভাব দেখাতে তাদের জুড়ি নেই। গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়াটি যেমন জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে অতিবাহিত হয়েছে, তেমনি সাংবিধানিক অবস্থাটি ছিল কুটিল। সংসদীয় রীতি-নীতি অনুযায়ী অধিবেশন শুরুর দিন থেকে পরবর্তী ৫ বছর পর এমনি এমনিই সংসদের মেয়াদকাল শেষ হয়ে যাবে। তৎপরবর্তী ৩ মাস বা ৯০ দিনের মধ্যে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। কিন্তু এইসব নিয়মকানুনকে অগ্রাহ্য করে ১৫দশ সংশোধনীতে একটি অপকৌশল সংযোজিত হয়। বিধান রাখা হয় যে সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৩ মাস আগে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। রাজনীতিকে যারা প্রতারণার ফাঁদ বানাতে চান তারা ভাবলেন, অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যদি তারা পরাজিত হন তাহলে তো তাদের সর্বনাশ। সুতরাং এমন বিধান রাখা হলো, যাতে গাছেরটাও খাওয়া যায় আর তলারটাও কুড়ানো যায়। নির্বাচনে হারলে গৃহীত নির্বাচনকে নাকচ করার কৌশল নেয়া যাবে। আর যদি অবস্থা নির্বাচনের পূর্বেই বেহাল হয়ে যায় তাহলে সমাপ্ত সংসদকে পুনরুজ্জীবিত করা যাবে বা আরও এক মেয়াদের জন্য সময় বৃদ্ধি করা যাবে। সাম্প্রতিক নির্বাচনের আগে জনৈক আওয়ামী বুদ্ধিজীবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক এরকম পরামর্শ দিয়েছিলেন। স্মরণ করা যায় যে, ২০০১ সালের নির্বাচনে যখন তারা ৪ দলীয় জোটের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন তখন নির্বাচনী ফলাফল বাতিলের জন্য তৎকালীন তাদের মনোনীত প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাহাবুদ্দিনকে চাপ দিয়েছিলেন। কথা না শোনায় তিনি বিশ্বাসঘাতক বলে অভিহিত হয়েছিলেন। সাহাবুদ্দিন নিজেই এক বিবৃতি দিয়ে এই অপ্রিয় সত্য ফাঁস করেছিলেন। পৃথিবীর তাবৎ স্বৈরাচার এরকম ফন্দিফিকির নিয়েই সিংহাসন রক্ষা করেন। মধ্য এশিয়ার বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রে এধরনের মেয়াদ বৃদ্ধির ঘটনা ঘটেছে। বর্তমান ক্ষমতাসীনরা দেখাতে চায় যে তারা গণতান্ত্রিক। তাই নির্বাচন নির্বাচন খেলা দিয়ে গণতন্ত্রের সুফলটি ঘরে তুলতে চায়। প্রতিদ্বন্দ্বীকে নির্মূল ও নিঃশেষ করে ডামি প্রার্থী দিয়ে বোগাস নির্বাচন জায়েজ করতে চায় তারা।
রাজনৈতিক এবং সাংবিধানিকভাবে যখন তারা এধরনের জটিল ও কুটিল পথপরিক্রমা করছে, তখন তারা নিঃসন্দেহে বৈধতার সংকটে ভুগছে। তাদের নেতা-নেত্রীদের আবোল তাবোল কথা তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের প্রমাণ দেয়। মিথ্যাচার ও বাগাড়ম্বরতা দিয়ে তারা তাদের ব্যর্থতা ঢাকতে চায়। প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিকে ষড়যন্ত্র ও নির্যাতনের মাধ্যমে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না দিয়ে আশঙ্কায় ভুগছে তারা। বিশেষ করে নির্বাচন পরবর্তীকালে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো যখন নতুন করে রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছে, তখন গায়ের জোরে জিতে যাওয়া আওয়ামী লীগ আবারও পুরোনো পথে হাঁটছে। নির্বাচন পরবর্তী ৯০ দিনের মাথায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে বিএনপি। গত ৩০ জানুয়ারি তারা রাজধানীতে কালো পতাকার মিছিল সংঘটিত করেছে। অনুমতি দেয়নি পুলিশ। তবুও বড় বড় মিছিল হয়েছে। সবে ধন নীলমণি, জেলের বাইরে থাকা একজন শীর্ষ নেতা মইন খানকে আটক করেছিলো পুলিশ। পরে বদনামের ভয়ে সরকার তাকে ছেড়ে দেয়। ঐদিনিই অবৈধ সংসদের প্রথম অধিবেশন দিবস ছিল। এইদিন বিএনপি সারাদেশে-সকল শহরে, জেলায়, উপজেলায় এবং পৌরসভাগুলোতে একই কর্মসূচী পালন করে। আগের মতই পুলিশ পিটিয়ে দেয় ঐসব সমাবেশ। বাবু গয়েশ্বর রায় বলেন, এই সরকার জনগণের নয়। বরং চীন, ভারত এবং রাশিয়ার সরকার। প্রধানমন্ত্রী বিদেশ থেকে সাফাই সার্টিফিকেট জোগাড় করেছে। বিদেশীদের সার্টিফিকেটে বৈধতা অর্জিত হয় না। আওয়ামী লীগ জানে যে, তাদের পায়ের নিচে মাটি নেই। যেহেতু জনগণ তাদের বিরুদ্ধে তলে তলে ফুঁসে আছে, সেজন্য শঙ্কিত তারা। বিএনপি শেষ হয়ে গেছে এরকম হাজারও মন্তব্যের পর যখন রাজপথে লক্ষ মানুষ নেমে এসেছে, তখন তারা প্রলাপ বকছে। যেহেতু জনগণ ভোট দেয়নি সেজন্য নতুন করে নির্বাচনের দাবী তুলেছে বিরোধী শক্তি। বিরোধীরা এই সরকার ও সংসদকে মেনে নেয়নি। তারা বলছে নতুন নির্বাচন দিয়ে সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। জনগণের আন্দোলনের মুখে অবৈধ সংসদ ও অবৈধ সরকারের পতন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
একটি বোগাস নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের যেমন নৈতিক পরাজয় হয়েছে, তেমনি দ্রব্যমূল্যের আকাশ ছোঁয়া বৃদ্ধি ও অপশাসন তাদের শাসনের ভিতকে নাড়িয়ে তুলেছে। আওয়ামী লীগের নতুন মন্ত্রী-মিনিস্টাররা আস্ফালন করছে দ্রব্যমূল্য কমে আসবে। কিন্তু শনৈ শনৈ সব জিনিসের দাম বেড়েই চলেছে। সবাই বলছে যে দাম বৃদ্ধির আসল কারণ আওয়ামী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীরা প্রায়ই প্রকারান্তরে সেই সিন্ডিকেটের সদস্য। সুতরাং নিজেদের বিরুদ্ধে নিজেদের আস্ফালন কাজে লাগার কথা নয়। কেউ তোয়াক্কা করে না। আওয়ামী লীগের জন্য সবকিছু সম্ভব। আওয়ামী লীগের সাত খুন মাফ। প্রধানমন্ত্রী নবগঠিত সরকারের প্রথম সভায় বলেছিলেন জিনিসপত্রের দাম নেমে আসবে আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি। স্মরণ করা যেতে পারে যে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের আগে নিজের দোষ স্খলনের জন্য বলেছিলেন মার্চের দিকে দুর্ভিক্ষ হবে। বৈদেশিক শক্তির সহায়তায় বিএনপি এই দুর্ভিক্ষ ঘটাবে। এভাবেই নিজের ব্যর্থতার দায় অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তুষ্ট হতে চায় শাসক আওয়ামী লীগ। অথচ বিগত ১৭ বছর ধরে তারাই ক্ষমতাসীন। বিএনপি যদি এতই পারঙ্গম হয়, তাহলে নির্বাচনে তাদের দূরে রাখা কেন? সরকারে আসলে আওয়ামী লীগের চেয়ে তারা যে অনেক ভালো করবে সে ভয়ে ভীত কি তারা? বিএনপি সবেমাত্র ঘুরে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচনের কারসাজির পর সবকিছু সামলিয়ে সতর্কভাবে এগুচ্ছে তারা। এ অবস্থাকেও হুমকি মনে করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেছেন বিএনপি যদি এখানে সহিংসতা করে বা কোন কর্মসূচী দেয় তবে সেটার মোকাবেলা করা হবে। আশা করা যায় যে, দিন যতই যাবে ততই বিএনপির আন্দোলন জোরালো হয়ে উঠবে। এদিকে অন্যান্য রাজনৈতিক দল-জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন আগের মতই বিএনপির সাথে সমান্তরাল কর্মসূচী পালন করছে। বামপন্থী রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো একইভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে সরকারের ঘোষিত শিক্ষানীতি তথা ট্রান্সজেন্ডার ইস্যুকে কেন্দ্র করে ইসলামী দলগুলো শক্ত অবস্থানে আছে। হেফাজতে ইসলামও কঠিন বিবৃতি দিয়ে সরকারকে সতর্ক করেছে। সরকারের এসব অন্যায় ও অনৈতিক নীতিমালার বিরুদ্ধে ইসলামী নেতা ও অন্যান্য দলগুলো আগে থেকেই শক্ত অবস্থানে রয়েছে।
অভ্যন্তরীণ চাপের সাথে সাথে সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞার ভয়ে ভীত রয়েছে। নির্বাচনের পর জাতিসংঘসহ সকল বৈশ্বিক গণতান্ত্রিক ও গণঅধিকার রক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেয়। নির্বাচন পরবর্তীকালে অনেক দেশ আনুষ্ঠানিক অভিনন্দন জানায়। সরকার কপটতার সাথে ঐসব আনুষ্ঠানিক বিবৃতিকে তাদের অবৈধ নির্বাচনে বৈধতার সার্টিফিকেট মনে করে। কূটনৈতিক মহল মনে করেন আনুষ্ঠানিক বিবৃতি এবং কূটনৈতিক সংলাপ এক নয়। যেহেতু দীর্ঘ সময় ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা বাংলাদেশকে নির্বাচন প্রশ্নে কোন ছাড় দেয়নি, অনেকে মনে করেন নিকট ভবিষ্যতে অবরোধ বা নিষেধাজ্ঞার মত কর্মসূচী আসতে পারে। এগুলো কোন মতেই কাম্য নয়। সরকার কূটনৈতিকভাবে পাশ্চাত্যের দেশগুলোকে প্রকাশ্য ও গোপনে নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার তদবির করে। তাতে কোন ইতিবাচক ফলোদয় হয়নি। কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন পাশ্চাত্য বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়তো সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য সময় নিচ্ছে। পৃথিবীর এই অংশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে। এর আগে ভারতের প্রযতেœ মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করার যে কূটনৈতিক নীতি ছিলো, তা আর অবশিষ্ট নেই। মার্কিনীরা সবসময়ই বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার নিশ্চিতের পক্ষে অবস্থান নিয়ে আসছে।
৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পরে যে সরকার গঠিত হয়েছে সে সরকার গণপ্রতিনিধিত্বশীল নয়। কূটনৈতিক মহল মনে করেন মার্কিন স্বার্থ সাময়িকভাবে ব্যাহত হলেও তা স্থায়ী স্বার্থের জন্য প্রতিবন্ধক হবে না। অর্থনৈতিক বিচারে বাংলাদেশ ভারত, রাশিয়া ও চীনের চেয়ে পাশ্চাত্যের কাছে বেশি দায়বদ্ধ। দেশের রেমিটেন্স, ব্যবসা বাণিজ্য বিশেষত তৈরী পোশাক খাত পাশ্চাত্যের উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। তাই পাশ্চাত্যের বা মার্কিনীদের কোন উদ্যোগ বা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে পারে না। অভ্যন্তরীণ আন্দোলন ও বৈদেশিক চাপ-উপরোক্ত বিশ্লেষণে প্রমাণিত হয়েছে যে, সরকার একটি অব্যাহত অনিশ্চয়তার মধ্যে দিনাতিপাত করছে।