শীতের ভরা মৌসুম চলছে। সবজিতে ভরে গেছে রাজধানীর কাচা বাচার। তারপরও সবজির দাম আকাশছোঁয়া। শিম, বেগুন, আলুর দাম কমেনি ভরা মৌসুমেও। চিনি, ডাল, চালের দামও বাড়তি। পেঁয়াজ, রসুন, আদার দাম বেড়েছে কয়েক মাস আগে তা আর কমেনি। একবার বাড়লে আর যেন কমতে চায় না পণ্যমূল্য। নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যেরই দাম এখন চড়া। আবার একেক বাজারে একেক ধরণের দাম। বগুড়ায় যে কফির পিছ ২৫ টাকা সেই কফি ঢাকার বাজারে বিক্রি হয় ৬০ টাকা। রংপুরের ৩০ টাকা কেজির বেগুন ঢাকায় বিক্রি হয় ৭০ থেকে ৮০ টাকা। মাছ, গোশতের বাজারে অগ্নিদশা। বাজারের এমন পরিস্থিতিতে মানুষের নাভিশ্বাস। বিশেষ করে সীমিত আয়ের মানুষেরা দিশেহারা। বিশেষজ্ঞরা বলছে, সুশাসনের অভাবে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। পণ্যমূল্য বাড়লে ধনীর ওপর তেমন প্রভাব পড়ে না, আঘাতটা প্রথমে আসে গরিব মানুষের ওপর।
দাম বাড়লেই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রতিশ্রুতি দেয় সরকার। চালের গুদামে অভিযানের কথা জানান খাদ্যমন্ত্রী। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সরকার সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে। ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনা করছেও বটে। কিন্তু দৃশ্যমান কোনো ফল আসছে না। বরং রমজান আসার আগেই প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
বাজার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ এবং করণীয় নিয়ে কথা বলেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন এবং ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, মূল্যস্ফীতিতে পণ্যের দাম বাড়বেই। এটি গাণিতিক হিসাব। সরকার মূল্যস্ফীতির হার নিয়ে যে কথা বলেছিল, তা ছিল অবাস্তব। চলমান পরিস্থিতিতে তার প্রমাণ মিলেছে। ১০-এর ঘরে মূল্যস্ফীতির হার। অথচ, পার্শ্ববর্তী অনেক দেশের মূল্যস্ফীতি কমে আসছে। তিনি আরো বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষ। করোনা এবং বৈশ্বিক সংকটে বাংলাদেশে দরিদ্র এবং অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়ছে। এসব মানুষের জন্য সরকার আশু কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে বলে নজরে আসেনি। সাধারণ মানুষের জন্য বিশেষ কর্মসূচি ঘোষণা করে বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তবে এর আগে সুশাসন এবং জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা নিয়ে ভাবতে হবে। সুশাসন না থাকলে কোনো পদক্ষেপ-ই কাজে আসবে না।
ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে গরিব মানুষের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। বঙ্গবন্ধুর সময় টিসিবি সৃষ্টি করা হয়। সেসময় টিসিবির মাধ্যমে ব্যাপকভাবে পণ্য আমদানি করে দুস্থদের মধ্যে প্রায় বিনামূল্যে বিতরণ করা হতো। একই সময়ে বৈদেশিক সহায়তায় পল্লীবিদ্যুৎ এবং পোল্ট্রি খাবারের সংস্থান করে ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন করা হয়েছিল। খোলাবাজারে পণ্য বিক্রির আওতা বাড়ানোর পরামশ দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এ গভর্নর বলেন, এখনো খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। তবে সেটা অপ্রতুল বলে মনে করছি। মানুষ বাঁচাতে হলে খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি বাড়াতে হবে। ন্যূনতম তিন মাস থেকে যতদিন প্রয়োজন ততদিন নিত্যপণ্য বিক্রি করতেই হবে। এতে করে যারা পণ্য মজুত করে কৃত্রিমভাবে সংকট তৈরি করেন তারা শায়েস্তা হয়ে যাবেন। সরকার পণ্যবিক্রি বাড়িয়ে দিলে তারা মজুত করা পণ্য বাজারে ছাড়তে বাধ্য হবেন। নইলে গুদামে পচবে। সরকারের সবাই আখের গোছাতে ব্যস্ত। মার খায় সাধারণ জনগণ। দ্রব্যমূল্য বাড়লে ধনীর ওপর তেমন প্রভাব পড়ে না, আঘাতটা প্রথমে আসে গরিব মানুষের ওপর। তিনি আরো বলেন, এখানে আমি আরেকটি বিষয় সুপারিশ করবো। যদি কোনো পণ্য আমদানির ৫টি লাইসেন্স থাকে সেখানে বাড়িয়ে একশটি লাইসেন্স দিতে হবে। আমদানিকারক বাড়াতে পারলে প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং বাজার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে আসবে। তবে বাজারের এই পরিস্থিতির জন্য দুর্নীতি ও সুশাসনের অভাবকে দায়ী।
অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দুর্নীতিই বাংলাদেশকে লক্ষ্যে পৌঁছাতে দিচ্ছে না। দুর্নীতির কশাঘাত পড়ে প্রথমে সাধারণ মানুষের ওপর। দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। যে রেমিট্যান্স আসছে, সেই পরিমাণ অর্থ বাইরে পাচার হচ্ছে। হুন্ডির মাধ্যমে দেশের বাইরের এজেন্টরা টাকা পাচারে সহায়তা করছেন। সরকার জানে কীভাবে (পাচার) হচ্ছে। সরকার কিছুই জানে না- এটা বলার সুযোগ নেই।
সুশাসন এবং জবাবদিহি না থাকলে সেই সমাজে সব কিছুই বৈধতা পায় মন্তব্য করে তিনি বলেন, সবাই আখের গোছাতে ব্যস্ত। মার খায় সাধারণ জনগণ। দ্রব্যমূল্য বাড়লে ধনীর ওপর তেমন প্রভাব পড়ে না, আঘাতটা প্রথমে আসে গরিব মানুষের ওপর। সহজ হিসাব।