হঠাৎ আলোচনায় টাঙ্গাইল শাড়ি। বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলায় উৎপাদিত এ শাড়ির জিআই স্বত্ব নিজেদের বলে দাবি করেছে ভারত। দেশটির সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সম্প্রতি নিজেদের ভেরিফাইড ফেসবুক পেইজে টাঙ্গাইল শাড়িকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে উদ্ভূত বলে প্রচার করে। এর আগে ২রা জানুয়ারি ভারতের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ভারতের এমন দাবিতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশিরা। তারা বলছেন, ভারত কিসের ভিত্তিতে টাঙ্গাইল শাড়িকে নিজেদের বলে দাবি করে তা বোধগম্য নয়। এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না। ভারতের মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পোস্টে বাংলাদেশি অনেকে প্রতিবাদও জানিয়েছেন।
অন্যদিকে যাদের অবহেলায় এমন হয়েছে তাও খতিয়ে দেখার দাবি করেছেন অনেকে। বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশের প্যাটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি)। যদিও এ বিষয়ে কূটনৈতিক সমাধানে আগাবে কি না সেটি স্পষ্ট করেননি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
আর অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মুনিম হাসান বিষয়টি সম্পর্কে অবগত-ই নন বলে জানান। মানবজমিনকে তিনি বলেন, আমি এখন দেশের বাইরে আছি। এমন কিছু হয়েছে জানি না। জেনে এ বিষয়ে বলতে পারবো। ইন্টারন্যাশনাল প্রোপার্টি রাইটস অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউআইপিও) সংজ্ঞা অনুযায়ী, কোনো পণ্যের নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অবস্থান, নাম বা চিহ্নকে জিআই বলা হয়। ভৌগোলিক কারণে সে পণ্যের আলাদা গুণ ও খ্যাতি থাকতে হয়। যেহেতু এর গুণাগুণ ভৌগোলিক অবস্থানের উপর নির্ভর করে, কাজেই পণ্য ও এর উৎপত্তিস্থলের মধ্যে সুস্পষ্ট সম্পর্ক থাকে। আন্তর্জাতিক বাজারে জিআই পণ্যের বেশ চাহিদা রয়েছে। তাই প্রতিটি দেশই ভৌগোলিক অবস্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু পণ্যের স্বত্বের স্বীকৃতি নিতে চায়।
বাংলাদেশে ২০১৩ সালে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন হয়। আর ২০১৫ সালে আইনের বিধিমালা তৈরির পর জি-আই পণ্যের নিবন্ধন নিতে আহ্বান জানায় পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি)। এরপর আবেদনের ভিত্তিতে এ পর্যন্ত ১৭টি পণ্যকে বাংলাদেশের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এসব পণ্যের বিস্তারিত ডিপিডিটি’র ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের জার্নালে প্রকাশ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব বিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল প্রোপার্টি রাইটস অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউআইপিও) নিয়ম মেনে জিআই পণ্যের স্বীকৃতি দেয়া হয়। টাঙ্গাইল শাড়ি বাংলাদেশের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃত না হলেও হঠাৎ ভারত এর দাবি করে বসায় বির্তক তৈরি হয়েছে। কারণ বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার সঙ্গে এ শাড়ির উৎপাদন ও বিপণন জড়িত। বহু বছর ধরে এ এলাকার মানুষ এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত।
গত বৃহস্পতিবার ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রচার করা পোস্টে বলা হয়, টাঙ্গাইল শাড়ি পশ্চিমবঙ্গ থেকে উদ্ভূত। এটি ঐতিহ্যবাহী হাতে বোনা মাস্টারপিস। এর মিহি গঠন, বৈচিত্র্যময় রঙ এবং সূক্ষ্ম জামদানি মোটিফের জন্য বিখ্যাত। এটি এ অঞ্চলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক। টাঙ্গাইলের প্রতিটি শাড়ি ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধ সৌন্দর্যের মেলবন্ধনে দক্ষ কারুকার্যের নিদর্শন। পোস্টটির কমেন্ট সেকশনে অনেক বাংলাদেশি প্রতিবাদ জানান। তারা বলেন, টাঙ্গাইল শাড়ি বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের সঙ্গে জড়িত। টাঙ্গাইল জেলার নাম অনুসারে এর নামকরণ করা হয়েছে। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে জিআই পণ্য। তাই কোনো একটি পণ্যকে এর তালিকাভুক্ত করতে মুখিয়ে থাকে দেশগুলো। কিন্তু জটিলতা বাধে যখন একই পণ্যকে একাধিক দেশ নিজেদের বলে দাবি করে। এমনটাই ঘটেছে টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়ে। বিভিন্ন গবেষণায় উঠে আসে, টাঙ্গাইল শাড়ির উৎপত্তি পাথরাইল, নলশোধা, ঘারিন্দাসহ টাঙ্গাইলের বাইশ-তেইশটি গ্রামে। এসব গ্রামের বসাক নামক সম্প্রদায় টাঙ্গাইল শাড়ি বুননের কাজ করতেন। বসাক সম্প্রদায়ের বংশধর হরিপদ বসাক জানান, ১৮৫০ সালের দিকে তৎকালীন ধামরাই এবং চৌহট্ট নামে দু’টি গ্রামে মসলিনের উত্তরসূরি কিছু তাঁতী বসবাস করতেন। সন্তোষ, করটিয়া, দেলদুয়ারে জমিদারি পত্তনের সময় অন্যান্য পেশাজীবীদের পাশাপাশি ওই তাঁতীদেরও সেসব জায়গায় নিয়ে বসতি স্থাপন করা হয়।
এসব গ্রামের মানুষেরা যে শাড়ি বয়ন করতেন তাই ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’- নামে পরিচিতি লাভ করে। আর ভারতের কলকাতায় এ শাড়ির প্রচলনের বিষয় উঠে আসে মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন গবেষক সুব্রত ব্যানার্জি, মো. মনিরুজ্জামান মুজিব ও সুমনা শারমিনের গবেষণায়। আর কলকাতার বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁতশিল্প গবেষক নিলয় কুমার বসাক বলেন, ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর বসাক সম্প্রদায়ের বড় অংশই ভারতে চলে যান। তাদের ভিড়টা বেশি হয় নদীয়া জেলার ফুলিয়া গ্রাম এবং পূর্ব বর্ধমানের ধাত্রী গ্রাম ও সমুদ্রগড়ে। তাদের বদৌলতে নদীয়া ও পূর্ব-বর্ধমানে ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ পরিচিতি লাভ করে।
এদিকে টাঙ্গাইল শাড়িকে ভারত তাদের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পর নয়াকৃষি আন্দোলনের সংগঠক ফরিদা আখতার তার এক নিবন্ধে বলেন, এমন উদ্ভট দাবির প্রতিবাদ জানাই। কাজটি তো হঠাৎ করে হয়নি। ভারত যে এ ব্যাপারে সক্রিয়, তা খোঁজ রাখার দায়িত্ব ছিল সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের। তাদের গাফিলতিতেই এমনটি হতে পারলো। এখন অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে হলেও টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই সনদ বাংলাদেশের হাতে আনার কাজ শুরু করতে হবে। তিনি বলেন, কোনো একটি দেশের পরিবেশ, আবহাওয়া ও সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখে, তাহলে সেটিকে ওই দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। বাংলাদেশের তাঁতী, বাংলাদেশের নদীময় জলবায়ু, হাওয়া ও রোদ ছাড়া কি টাঙ্গাইল শাড়ি কল্পনা করা যায়! সার্বিক বিষয়ে ডিপিডিটি’র পরিচালক (ডব্লিউটিও এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ক) এবং পরিচালক (ভৌগোলিক নির্দেশক ইউনিট) (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ড. কায়সার মুহাম্মদ মঈনুল হাসান মানবজমিনকে বলেন, এটা আমাদের নজরে এসেছে। টাঙ্গাইল শাড়ি ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের। ভারত কীভাবে এ শাড়ি তাদের বলে দাবি করে- তা জানা নেই। টাঙ্গাইল নামে কোনো জেলা তাদের আছে কি না বা কিসের ভিত্তিতে তারা এ দাবি করে। বিষয়টি নিয়ে আমাদের টিম কাজ করছে। অতীতেও কয়েকটি পণ্য নিয়ে এমন হয়েছে- তা নিয়েও কাজ চলছে।