পরিকল্পিত উপায়ে দেশের ভূমি ও জলাশয়ের উন্নয়ন করতে বিশ্বব্যাপী ‘পরিকল্পনা’র নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে।
প্রথমে জাতীয় পরিকল্পনা, এরপর আঞ্চলিক ও স্থানীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। এই পদ্ধতিতে উন্নয়ন কাজ করলে টেকসই উন্নয়ন হয়। যেখানে কৃষি, জীববৈচিত্র্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ঠিক রাখা যায়।
বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত এ পদ্ধতি অনুসরণ করা হলেও নগর পরিকল্পনা প্রণয়নে উলটো পথে হাঁটছে বাংলাদেশে। কারণ জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন ছাড়াই এসব মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হচ্ছে, কার্যত কোনো সুফল বয়ে আনবে না-এমন মন্তব্য করেছেন একাধিক নগর পরিকল্পনাবিদ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জাতীয় ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা না করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় খণ্ড খণ্ড স্থানীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হচ্ছে। নতুন করে গ্রামীণ পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে। এসব পরিকল্পনার কোনো সুফল মিলছে না।
গত দেড় দশকে এমন ২৬০টি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করেছে সরকার। এরমধ্যে ২৫০টি গেজেট হওয়ার আগেই মেয়াদ শেষ হয়েছে। বাকি ১০টির গেজেট হলেও জাতীয় পরিকল্পনা না থাকার দুর্বলতায় তার ৫ ভাগও বাস্তবায়ন নেই। এসব পরিকল্পনা শুধুই কাগজেই সীমাবদ্ধ। আর এসব কাজ করতে গিয়ে সরকারের অপচয় হয়েছে প্রায় ১৬৫ কোটি টাকা।
এছাড়া নতুন করে কক্সবাজারের আধুনিকায়ন করতে ১৬১ কোটি টাকার মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের কাজ চলমান। পাশাপাশি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের আওতায় প্রায় ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৫টি উপজেলা মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের কাজ চলছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাবেক সভাপতি ও বর্তমান কমিটির উপদেষ্টা মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন যুগান্তরকে বলেন, দেশের পরিবেশবান্ধব ও টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে পৃথিবীজুড়ে ভূমি ও জলাশয়সহ সামগ্রিক দিক বিবেচনায় রেখে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। সেখানে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দিক থাকে-প্রথমত, পরিকল্পনা কাঠামো প্রণয়ন।
এখানে পরিকল্পনাবিদদের নেতৃত্বে জাতীয় (স্থানিক) পরিকল্পনা প্রণয়ন, আঞ্চলিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও স্থানীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন। দ্বিতীয়ত, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কেন্দ্রীয়, নগর ও গ্রামীণ পর্যায়ে পর্যাপ্তসংখ্যক দক্ষ জনবল নিয়োগ করা। তৃতীয়ত, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইনি ক্ষমতা দেওয়া। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে পরিকল্পিত উন্নয়নের উলটো চর্চা চলছে।
এ কারণে পরিকল্পিত উন্নয়নের নামে যেসব মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হচ্ছে, সেসব কাগুজে দলিল হয়ে থাকছে। বাস্তবে তা রূপলাভ করতে পারছে না। পরিকল্পনার সঠিক চর্চা না করলে যতই মাস্টারপ্ল্যান করা হোক না কেন, তাতে কার্যত সুফল মিলবে না। সরকারের অর্থের অপচয় ঘটবে।
তিনি জানান, বিআইপির পক্ষ থেকে জাতীয় পরিকল্পনার রূপরেখা কেমন হবে, তা প্রস্তুত করে সরকারকে দেওয়া হয়েছে। সেখানে পরিকল্পনাবিদরা দেশের পরিকল্পনা কেমন হওয়া উচিত।
এজন্য কি কি করা দরকার, সে সংক্রান্ত বিস্তারিত করে দেওয়া হয়েছে। এটা প্রণয়নে দেশ-বিদেশে কর্মরত বিশেষজ্ঞ পরিকল্পনাবিদরা কাজ করছেন। এরপরও সরকার তা আমলে নিচ্ছে না। নগর পরিকল্পনাবিদরা সরকারের ঘুম ভাঙাতে এবার রাজপথে নামবেন।
এ প্রসঙ্গে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, ২০৪১ সালে বাংলাদেশ উন্নত দেশ হবে। সে লক্ষ্যে কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তবে পরিকল্পনার ত্রুটি রেখে তো তা সম্ভব হবে না। এজন্য এ সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে আন্তঃমন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের সঙ্গে সভা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
তিনি বলেন, নতুন মন্ত্রী মহোদয় শুধু নগর এলাকা নয়, গ্রাম নিয়েও চিন্তা করছেন। সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সংস্থা ও পেশাজীবীদের সমন্বয়ে কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) জেলা শহর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ২২টি পৌরসভার মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করেছে। এসব মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নে মোট খরচ হয়েছে ৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা।
এ মাস্টারপ্ল্যানগুলো ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে করা হয়েছে। এটা বাস্তবায়নে সময়কাল ছিল ৫ বছর। ৪ বছর আগে ওই মাস্টারপ্ল্যানের মেয়াদ শেষ হয়েছে। আর উপজেলা শহর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে ২১৫টি উপজেলা মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হয়েছে। এখানে সরকারের খরচ হয়েছে ১৯ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। ২০০৯ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে প্রণয়ন করা হয়েছে।
এসব পরিকল্পনার মেয়াদ শেষ হয়েছে দুই বছরের বেশি সময়। এলজিইডির দ্বিতীয় নগর পরিচালন ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ১টি পৌরসভার মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে সরকারের খরচ হয়েছে ৩৫ লাখ টাকা। ২০১৫ এসব মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন কাজ হয়েছে।
ইতোমধ্যে বাস্তবায়নের সময়ও শেষ হয়েছে প্রায় আড়াই বছর আগে। ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালে ভোলা শহর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন কাজ করা হয়েছে। এখানে খরচ হয়েছে প্রায় ৩৫ লাখ টাকা। ইতোমধ্যে এই মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নের সময় শেষ হয়েছে।
আর তৃতীয় নগর পরিচালন ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ১৬টি পৌরসভার মাস্টারপ্ল্যান করা হয়েছে। এতে খরচ হয়েছে ৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। ২০১৬ সালে এই মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হয়েছে। গেজেট প্রকাশের আগেই এসব মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নের মেয়াদকালও শেষ হয়েছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ২০১০ সালে সরকার ঢাকার মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নে খরচ করেছে ২০ কোটি টাকা। এই মাস্টারপ্ল্যান সংশোধনে ২০২২ সালে খরচ করেছে আরও ৩৭ কোটি টাকা।
২০২২ সালে চট্টগ্রাম শহরের মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নে খরচ করেছে ৩৩ কোটি টাকা, ২০১৯ সালে রাজশাহী শহরের মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নে খরচ করেছে ১৮ কোটি টাকা। গ্রামে নগরের সুবিধা পৌঁছানোর লক্ষ্যে কারিগরি কৌশল বা মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নে ২০২৩ সালে শেষ হওয়া এলজিইডি আমার গ্রাম আমার শহর প্রকল্পের আওতায় খরচ করেছে ২১ কোটি টাকা। সরকারের লক্ষ্য ধাপে ধাপে দেশের ৮৭ হাজার ২৩০ গ্রামে উন্নতমানের নাগরিক সুবিধা বা নগরের সুবিধা গ্রামে পৌঁছানো।
২০২৩ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) নতুন ১৮ ওয়ার্ডের মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নে ৩ কোটি টাকা খরচ করেছে। আইনগত ক্ষমতা না থাকায় এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন কাজ করতে পারছে না সংস্থাটি। একইভাবে গত বছর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) সমন্বিত মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের নামে ২ কোটি ৫০ টাকা খরচ করেছে।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে ৮ কোটি টাকার কাজের আড়াই কোটি টাকা পরিশোধের পর কাজে সন্তুষ্ট না হওয়ায় কার্যাদেশ বাতিল করেছে। এখন নিজেদের মতো করে মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্বদ্যিালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. মুসলেহ উদ্দীন হাসান যুগান্তরকে বলেন, জাতীয় পর্যায়ের পরিকল্পনা বা স্থানিক (স্থানভিত্তিক) পরিকল্পনা দেশের পরিকল্পিত ও টেকসই উন্নয়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা ছাড়া আঞ্চলিক ও স্থানীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন করে কার্যকর সুফল মিলছে না, মিলবেও না। এজন্য জাতীয় স্থানিক পরিকল্পনার গুরুত্ব সরকারকে অনুধাবন করতে হবে।
তিনি বলেন, পরিকল্পনার পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করলে মাস্টারপ্ল্যানগুলোর মধ্যে সমন্বয় করে কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হবে। এতে কোন এলাকার জন্য কি পরিকল্পনা উপযোগী, তার আলোকে পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা যায়। এতে পরিবেশ, প্রতিবেশ ঠিক থাকবে এবং টেকসই উন্নয়ন হবে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান সরকার স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলেছে। ২০৪১ সালে উন্নত দেশের ঘোষণা করেছে। এটা অর্জন করতে হলে স্মার্ট পরিকল্পনাও প্রণয়ন করতে হবে। তা না হলে সরকারের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।
বিআইপির সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান যুগান্তরকে বলেন, দেশের নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন কাজ অপরিকল্পিতভাবে করা হচ্ছে। এজন্য পরিকল্পিত ও টেকসইন নগরায়ণ গড়ে উঠছে না। সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে বিষয়গুলো পরিষ্কার ভাবে তুলে ধরা হলেও তা বাস্তবায়নে তেমন কোনো আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
এজন্য বিআইপি পেশাজীবী প্রতিষ্ঠান হিসাবে জাতীয় স্থানিক পরিকল্পনা প্রণয়নের রূপরেখা উপস্থাপন করেছে। এরপরও সরকারের সে বিষয়ে তেমন কোনো আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। অপরিকল্পিত পরিকল্পনা ও উন্নয়ন রোধে পরিকল্পনাবিদরা রাজপথে নামার চিন্তা করছেন। নগর পরিকল্পনা শিখে দেশের ধ্বংস এভাবে চেয়ে চেয়ে দেখা যায় না।
তিনি বলেন, পরিকল্পিত উন্নয়ন করতে হলে যে কোনো দেশের আগে জাতীয় পর্যায়ে স্থানভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হয়। সেখানে নির্দেশনা থাকবে দেশের কোন এলাকায় কি ধরনের উন্নয়ন করা যাবে। ভূমি, জলাশয়, পরিবেশ বিবেচনায় রেখে ওই নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। এরপর অঞ্চল পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হয়।
সবশেষ এলাকাভিত্তিক বিস্তারিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করে, তার আলোকে যে কোনো উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হয়। কিন্তু, বাংলাদেশে এসব নিয়মের কোনো তোয়াক্কা করা হচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতার অর্ধশত বছরেও দেশে স্থানভিত্তিক (স্থানিক) পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়নি। অথচ সরকার বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ প্রণয়ন করেছে। তবে জাতীয় পরিকল্পনা ছাড়া বদ্বীপ পরিকল্পনায় কার্যত কোনো সুফল মিলবে না।
সিটি ও পৌরসভা এলাকায়ও বহু মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হয়েছে। পরিকল্পনার যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ না করায় এখান থেকে কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলছে না। এটা অনুসরণ করা হলে উন্নয়ন কাজের নামে অপচয়ও অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।