ঘরে পড়েছিল মা ও দুই মেয়ের লাশ, পাশ থেকে গলাকাটা অবস্থায় উদ্ধার হয়েছেন এক বাবা। এ ঘটনা ঘটেছে- গত শুক্রবার সকালে নীলফামারী সদর উপজেলার দাড়োয়ানী বন্দর বাজার গ্রামে। এর একদিন আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় লাগেজ থেকে মাথা ও দুই পা বিচ্ছিন্ন তরুণীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। একইদন ফরিদপুরে বাস কাউন্টারে স্যুটকেস খুলতেই পাওয়া যায় একজনের লাশ। এরআগে সিরাজগঞ্জে তালাবদ্ধ বাড়ি থেকে মাবাবা ও মেয়ের গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়। গোপালগঞ্জে তিন সন্তানকে বিষ পান করিয়ে মায়ের আত্মহত্যা চেষ্টা এবং এ ঘটনায় ছোটো মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। খুলনার ডুমরিয়ায় দুই সন্তানকে হত্যার পর মায়ের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে।
চলতি সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন এলাকায় এভাবে আরো কয়েকটি লোমহর্ষক হত্যাকান্ড ও আত্মহত্যা এবং সন্তানদের নিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টার ঘটনায় জনমনে উদ্বেগ বেড়েছে। অপরাধ ও সমাজ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের ঘটনার অন্যতম কারণ পারিবারিক বিরোধ ও হতাশা। তারা বলছেন, অসহিষ্ণুতা, অতিমাত্রার ক্ষোভ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং ইন্টারনেটের অপব্যবহারের কারণেও মানুষের মাঝে দিন দিন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে নিষ্ঠুরতা। তুচ্ছ কারণে অসহিষ্ণু হয়ে খুনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। তবে বীভৎস বিকৃত খুনের ঘটনার বেশিরভাগই ঘটছে অপেশাদার খুনিদের মাধ্যমে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্রমাগত বাড়ছে অপরাধ। পারিবারিক কলহ, পূর্বশত্রুতার জের, সম্পর্কের অবক্ষয়, পরকীয়া, ব্যাবসায়িক ও ব্যক্তিস্বার্থের দ্বন্দ্ব, ছোটখাট বিষয় নিয়ে কথা-কাটাকাটি, এমনকি ঝগড়া-বিবাদ থামাতে গিয়েও একের পর এক ঘটছে হত্যাকা-। সারা দেশেই অপ্রীতিকর ঘটনা বাড়ছে। ফলে ব্যক্তিগত ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে মানুষ।
জানা গেছে, নীলফামারীতে নিজ বাড়িতে মাসহ দুই মেয়ের লাশ পাওয়া গেছে। বাড়ির উঠান থেকে গলাকাটা অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে বাবাকে। গত শুক্রবার সদর উপজেলার চড়াইখোলা ইউনিয়নের দাড়োয়ানী বন্দর বাজারে এ ঘটনা ঘটে।
গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার ওই ব্যক্তির নাম আশিকুল হক মোল্লা (৪৫)। তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। মারা যাওয়া তিনজন হলেন-আশিকুলের স্ত্রী তহুরা বেগম (৩৫), মেয়ে আয়েশা আক্তার (৮) ও জারিন (৫)। নীলফামারী সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তানভিরুল ইসলাম বলেন, রংপুর ক্রাইম সিন টিমকে জানানো হয়েছে। আহত আশিকুল হক মোল্লা রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। পুলিশ ও স্থানীয় লোকজন জানান, সকাল ৯টার দিকে গলাকাটা অবস্থায় বাড়ির বাইরে এসে ঢলে পড়েন আশিকুল হক। পরে স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠান। বাড়ির ভেতরের শয়নকক্ষে তহুরা বেগম, আয়েশা আক্তার ও জারিনকে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন তারা। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে। ওই তিনজনকে শ্বাস রোধ করে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করছে পুলিশ। তবে হত্যাকা-ের কারণ সম্পর্কে এখনো কিছু জানাতে পারেনি পুলিশ।
লাগেজ থেকে তরুণীর লাশ উদ্ধার: ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি লাগেজ থেকে মাথা ও দুই পা বিচ্ছিন্ন অজ্ঞাত এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। লাগেজের ভেতরে মাথা ও পায়ের অংশ পাওয়া যায়নি। গত বুধবার বিকেলে সদর উপজেলার রামরাইল ইউনিয়নের সেন্দা গ্রামের একটি পুকুরপাড় থেকে লাশসহ লাগেজটি উদ্ধার করে পুলিশ। ওই তরুণীর নাম-পরিচয় জানতে পারেনি পুলিশ। স্থানীয় লোকজন ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সেন্দা বাজারের দক্ষিণ দিকে নোয়াহাটি বিল্লাল মিয়ার পুকুরের পাশে একটি রক্তমাখা খয়েরি রঙের লাগেজ পড়ে থাকতে দেখেন স্থানীয় লোকজন। পরে তারা সদর থানা-পুলিশকে খবর দেন। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে লাগেজ খুলে পলিথিনে মোড়ানো মাথা ও ঊরু থেকে দুই পা বিচ্ছিন্ন এক তরুণীর লাশ দেখতে পায়। তবে লাগেজের ভেতরে ওই তরুণীর মাথা ও কেটে নেওয়া দুই পায়ের বিচ্ছিন্ন অংশ ছিল না।
স্যুটকেস খুলতেই পাওয়া গেল লাশ: ফরিদপুরে তালা ভেঙে একটি স্যুটকেস খুলতেই পাওয়া যায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির লাশ। ২৭ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ফরিদপুর শহরের বাসস্ট্যান্ডে গোল্ডেন লাইন পরিবহনের কাউন্টারের সামনে এ ঘটনা ঘটে। সেখানে একটি বৈদ্যুতিক খুঁটির কাছে অজ্ঞাতপরিচয় এক নারী স্যুটকেসটি রেখে গিয়েছিলেন। বাসস্ট্যান্ডের শ্রমিক ও প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিরা জানান, ভোরে রাজবাড়ী রাস্তার মোড়ের দিক থেকে মাহেন্দ্র গাড়িতে করে বোরকা পরিহিত এক নারী ফরিদপুর শহরের বাসস্ট্যান্ডে ওই বৈদ্যুতিক খুঁটির সামনে আসেন। মাহেন্দ্র থেকে স্যুটকেসটি নামিয়ে তিনি চলে যান। এতে তাকে সহযোগিতা করেন একই মাহেন্দ্র গাড়িতে আসা তিন থেকে চার ব্যক্তি। দীর্ঘ সময় ওই নারী ফিরে না আসায় বাসস্ট্যান্ডের শ্রমিকদের সন্দেহ হয়। বিষয়টি ফরিদপুর কোতোয়ালি থানায় জানানো হয়। পরে পুলিশ এসে তালা ভেঙে স্যুটকেস খুলে অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তির লাশ মোড়ানো অবস্থায় পায়। স্যুটকেস থেকে লাশ উদ্ধারের ঘটনায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন গ্রেপ্তার রোজিনা আক্তার ওরফে কাজল (৩২)। মঙ্গলবার বিকেল ৪টার দিকে ফরিদপুরের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. নাসিম মাহমুদের আদালতে এই হত্যা মামলার একমাত্র আসামি হিসেবে তিনি ১৬৪ ধারায় এ জবানবন্দি দেন।
বাবা ও ছেলের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার : গত ২৭ জানুয়ারি কুষ্টিয়া শহরের মঙ্গলবাড়িয়া এলাকার একটি ভাড়া বাসা থেকে বাবা ও ছেলের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে পাঠায়। স্থানীয়রা ও পুলিশ জানায়, ধর্মান্তরিত হওয়ার পর নিহত রেজাউল তার জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনী নিয়ে বেশ জটিলতায় ভুগছিলেন। যার জন্য তিনি তার সাত বছর বয়সের ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করাতে পারেননি। সেই ক্ষোভ থেকেও এই পথ বেছে নিতে পারেন। নিহত রেজাউল করিম মধু শহরের আলফা মোড় এলাকার বিষ্ণুপদ রায়ের ছেলে। পুলিশ ও স্বজনরা জানান, তার স্ত্রী ঘরের দরজা বন্ধ দেখতে পেয়ে ডাকাডাকি করেন। এর পর কোনো সাড়া না পেয়ে জানালার ছিদ্র দিয়ে দেখতে পান তার স্বামী ও সন্তান ঘরের মধ্যে একই রশিতে ঝুলে আছে।
মামা-মামি ও মামাতো বোনকে হত্যা: সিরাজগঞ্জের তাড়াশে ভাগিনা রাজীবের সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেন ছিল মামা বিকাশের। এর জের ধরেই শুরু হয় মনোমালিন্য। এরপর টাকা দেওয়ার কথা বলে মামার বাসায় যায় ভাগিনা রাজীব। এরপর পালাক্রমে মামাতো বোন, মামি ও মামাকে হত্যা করে রাজীব। লাশ উদ্ধারের ১২ ঘণ্টার মধ্যেই হত্যাকারীকে ধরে ফেলে পুলিশ। পরে পুলিশের কাছে এই ট্রিপল হত্যাকা-ের বর্ণনা দিয়েছে হত্যাকারী। বুধবার (বিকেলে সিরাজগঞ্জ জেলার পুলিশ (এসপি) মো. আরিফুর রহমান ম-ল এ কথা জানান। এর আগে মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি) দুপুরের দিকে তাড়াশ থেকেই ভাগিনা রাজীব কুমার ভৌমিককে (৩৫) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। রাজীব সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার তেলিপাড়া গ্রামের মৃত বিশ্বনাথ ও নিহত বিকাশের বড়বোন প্রমিলা রানীর ছেলে।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, সার্বিক দিক বিবেচনায় তুলনামূলকভাবে দেশে অপরাধপ্রবণতা অনেকটা কমে পরিস্থিতিও আগের চেয়ে ভালো। তবে ফৌজদারি অপরাধ কমলেও বেড়েছে পারিবারিক নির্যাতন। এ ছাড়া তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বেশির ভাগ পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে।