এই মুহূর্তে তিনটি ইস্যু গুরুত্বপূর্ণ। আমি দৈনিক সংগ্রামে সপ্তাহে মাত্র একদিন অর্থাৎ রোববার কলাম লিখি। কিন্তু থাকে ইস্যুর ভিড়। এসব ইস্যু থেকে একটিকে বেছে নিতে হয়। মাঝে মাঝে একের অধিক ইস্যু দাবি করে যে সেগুলো নিয়েও লিখি। সেজন্য মাঝে মাঝে দুটি ইস্যু নিয়ে লিখি। কিন্তু দুটি ইস্যুই সংক্ষেপ করে লিখতে হয়। প্রথমেই বলেছি, আজ তিনটি ইস্যু। বৃহস্পতিবার যখন কলামটি লিখতে শুরু করেছি তখন ইন্টারনেটে দেখলাম বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের জামিনের আবেদন আদালতে নাকচ হয়েছে। এর দুই দিন আগে অর্থাৎ ৩০ জানুয়ারি মঙ্গলবার বিএনপি সারাদেশে কালো পতাকা মিছিলের ডাক দেয়। এ উপলক্ষে বিএনপিকে ঢাকাসহ কোথাও দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি। সব জায়গার সমাবেশ ও মিছিলের উদ্যোগ পুলিশ পন্ড করে দিয়েছে। ঐদিকে হঠাৎ করে কেউ কেউ ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিচ্ছেন। এই তিনটি ইস্যুই গুরুত্বপূর্ণ। এক এক করে সংক্ষেপে আজ সবগুলোই আলোচনা করবো।
প্রথমে কালো পতাকা মিছিল। পুলিশ তথা সরকার বিএনপিকে কেন দেশের কোথাও কালো পতাকা মিছিল করতে দিল না সেটি আমার বোধগম্য নয়। আপাতদৃষ্টে এই মুহূর্তে সরকারের সামনে কোনো থ্রেট নেই। একথা ঠিক যে, গত ৭ জানুয়ারির ইলেকশনে কম করে হলেও দেশের ৯৫ শতাংশ ভোটার ভোট দেয়নি। তারপরেও ৫ শতাংশ ভোটার উপস্থিত হলেও ইলেকশন হয়ে গেছে। বিএনপি এবং অন্যান্য বিরোধী দল এই ইলেকশন ঠেকাতে পারেনি। ইংরেজিতে একটি কথা আছে। কথাটি হলো ঈধষষ ঃযব ংঢ়ধফব ধ ংঢ়ধফব. অর্থাৎ কোদালকে কোদাল বলো। আরো সোজা করে বলতে হলে কঠিন সত্য, সেটা যদি অপ্রিয়ও হয়, তাহলে সেটাই বলা উচিত। তাই আজ আমি এখানে দুই-একটি কঠোর বাস্তবের কথা বলবো।
এখানে কারো দোষ-গুন বা সাফল্য ব্যর্থতার কথা বলবো না। বাস্তব হলো এই যে, বিএনপি জামায়াতসহ বিরোধী দলসমূহ আন্দোলন করেছিল এই সরকারের অধীনে নয়, একটি নিরপেক্ষ অন্তবর্তীকালীন সরকারের অধীনে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন করার দাবিতে। অন্য কথায়, আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকার গঠন। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগও এ্যাডামেন্ট ছিল, কোনো অবস্থাতেই তারা পদত্যাগ করবে না, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে না এবং তাদের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে।
অবশেষে দেখা গেল, বিরোধী দলের দাবিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে এবং দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। বলা হবে যে নির্বাচনের তিন মাস আগে থেকে সরকার বিএনপি জামায়াতের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সাঁড়াশি আক্রমণ করে। ২৭ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে। বিএনপি হরতাল ও অবরোধ দেয়। জনগণ সাড়াও দেয়। কিন্তু হরতাল উপলক্ষে পিকেটিং বা কোনো রকম তৎপরতা চালাতে দেওয়া হয়নি বিরোধী দলকে। কিন্তু তারপরেও চরম সত্য হলো এই যে নির্বাচনটি হয়ে গেছে।
এখানে নির্বাচন বর্জনের আরেকটি উদাহরণ দিতে হয়। তখন ক্ষমতায় বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে। আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তুমুল আন্দোলন করলে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন হয়। আওয়ামী লীগসহ অন্যরা এই নির্বাচন বর্জন করে। বিএনপি একতরফা নির্বাচনে ২৮৯ টি আসন পায়। প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়ার ব্যক্তিগত উদ্যোগে নবগঠিত সংসদ গণদাবির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল সম্বলিত ত্রয়োদশ (১৩ নং) সংশোধনী সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে। নতুন সংসদ প্রথম অধিবেশনে মিলিত হয় ১৯৯৬ সালের ১৯ মার্চ। এই সংসদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ এবং তার সহযোগীরা তুমুল গণআন্দোলন গড়ে তোলে। এই আন্দোলনের পটভূমিতে প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়ার পরামর্শে প্রেসিডেন্ট ৩০ মার্চ নবগঠিত সংসদ ভেঙ্গে দেন এবং ঐ দিনই প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া পদত্যাগ করেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে প্রবল গণআন্দোলনের মুখে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদের আয়ূ ছিল মাত্র ১২ দিন।
এর পাশাপাশি বর্তমান দ্বাদশ সংসদ। প্রথম অধিবেশন বসেছে ৩০ জানুয়ারি। স্বতন্ত্ররাও আওয়ামী লীগ বলে গণ্য হয়েছেন। তাই এই সংসদে জাতীয় পার্টি ছাড়া আওয়ামী লীগ বা আওয়ামী লীগের আশীর্বাদপুষ্ট দলসমূহ জয়লাভ করেছে ২৮৮টি আসনে। নির্বাচন বর্জনের সপক্ষে ৯৫ শতাংশ ভোটার সুস্পষ্ট রায় দিলেও ৭ জানুয়ারির পর ২৭ দিন অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু সরকার পতনের মতো কোনো আন্দোলন বা কোনো হুমকি দৃশ্যমান নয়। তাহলে কেন সরকার কালো পতাকা মিছিল করতে দিল না? কেন ফখরুলসহ এখনও ২৫ হাজার রাজবন্দীকে জেলে রাখা হয়েছে? ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম লিখেছেন যে, এই নির্বাচনের মাধ্যমে একদলীয় সরকার থেকে এক ব্যক্তির সরকার প্রতিষ্ঠিত হলো। তারপরেও বিরোধী রাজনীতি এ্যালাও করা হচ্ছে না কেন? ১লা ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন যে, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালকে স্থায়ী করার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যেই দ্রুত বিচারের আওতায় অন্তত ১৭০০ রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীকে কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। অন্যদের বিচার প্রক্রিয়াও রকেটের গতিতে এগোচ্ছে। আপাতদৃষ্টে এই সরকারকে রুশ চীন বা বেলারুশের সরকারের মতো শক্তিশালী মনে হচ্ছে। তারপরেও কেন রাজনীতির লাগাম টেনে ধরা?
॥ দুই ॥
হঠাৎ করে দুই-একটি মহল থেকে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দেওয়া হয়েছে। আমি গত দুই সপ্তাহের প্রায় সমস্ত পত্র পত্রিকা ঘেঁটে দেখলাম। কোনো রাজনৈতিক দল ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দেয়নি। ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখা গেল, একাধিক ইউটিউবার বা ব্লগার এই ডাক দিয়েছেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন যারা ইউটিউবের মাধ্যমে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন। কারো কারো সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা নাকি ১৫ লক্ষ। এরা প্রায় সকলেই বিদেশে থাকেন এবং বিদেশ থেকেই তাদের ভিডিও ইউটিউবে আপলোড করেন। তাদের দেখাদেখি ফেসবুকেও কেউ কেউ ঐ আওয়াজ তুলেছেন। এ ব্যাপারে আগের মতই আমি কোদালকে কোদাল বলবো।
॥ তিন ॥
এই দাবিটি উত্থাপন করা হয়েছে নির্বাচনের পর। কঠোর বাস্তব হলো এই যে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আমেরিকার বাইডেন সরকার এবং বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে সেই প্রায় দুই বছর আগে। টানাপোড়েনটি প্রকাশ্যে আসে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে যখন আমেরিকা প্রায় শতাধিক দেশের গণতন্ত্র সম্মেলন আহ্বান করে। ঐ সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এরপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে আমেরিকা ৭ জন শীর্ষস্থানীয় অফিসারসহ র্যাবের ওপর ম্যাগনটস্কি আইনের অধীনে স্যাংশন আরোপ করে। ২০২৩ সালে যে দ্বিতীয় গণতন্ত্র সম্মেলন হয় সেখানেও আমেরিকা বাংলাদেশকে দাওয়াত করেনি। বলা হয় যে গণতান্ত্রিকভাবে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হলেও ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের দুটি নির্বাচনের মাধ্যমে সেই গণতান্ত্রিক আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃত্ববাদী সরকারে রূপান্তরিত হয়। সেজন্যই আমেরিকা ২০২৩ সালের মে মাসে ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
এরপর আমেরিকা বলে ২০২৪ সালে যে ইলেকশন হবে সেই ইলেকশন অবাধ ও সুষ্ঠু হতে হবে। আমেরিকা এ ব্যাপারে সরকার বা বিরোধী কোনো পক্ষভুক্ত নয়। যারাই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটাবে তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবরের হেভি পুলিশী ক্র্যাকডাউনের পর বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দসহ দুটি বৃহৎ বিরোধী দলের ২৭ হাজার কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। তারপর ৩ মাস কেটে গেছে। দ্রুত বিচার আইনে ১৭০০ রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। বিরোধী দলের কোনো কর্মীকে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক তৎপরতা করতে দেওয়া হয়নি। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে এইরূপ একটি ধারণা সৃষ্টি করা হয় যে, ভোটারবিহীন ও জুলুমের স্টিম রোলার চালানো নির্বাচনের পর হয়তো মার্কিন কোনো স্যাংশন আসবে। কিন্তু সেটি আসেনি। এবং আর আসবে বলেও কেউ মনে করেন না।
আমেরিকা হঠাৎ পিছিয়ে গেল কেন? এখন ভারতীয়, বাংলাদেশী এবং অন্যান্য দেশী-বিদেশী পত্র-পত্রিকা এবং টেলিভিশনে বলা হচ্ছে যে, বাংলাদেশের ওপর আমেরিকা যেন আর চাপ সৃষ্টি না করে সেজন্য ভারত আমেরিকাকে বলেছে। ফলে শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে সকলের রাগ গিয়ে পড়েছে ভারতের ওপর। এ ব্যাপারে কোন্টা সত্যি এবং কোন্টা সত্যি নয়, সে ব্যাপারে আমরা কোনো কমেন্ট করবো না। কিন্তু মুদ্রার অপর পিঠটি দেখা যাক।
বাংলাদেশে মানুষ ব্যবহার করেন, এমন কোনো পণ্য কি আছে যা ভারত থেকে আমদানি করা হয় না? সেটি সরকারি বাণিজ্যনীতির মাধ্যমে হোক, বা বেসরকারি আমদানির মাধ্যমে হোক, বা চোরাচালানের মাধ্যমে হোক। আলু, মরিচ, আদা, পিঁয়াজ থেকে শুরু করে হেন আইটেম নেই যা ভারত থেকে আনা হয় না। প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ লোক চিকিৎসার জন্য ভারত যায়। অনুরূপভাবে পর্যটনের উদ্দেশ্যেও লক্ষ লক্ষ লোক ভারত যায়। শিক্ষার জন্যও অনেক ছাত্র ছাত্রী ভারত যান। সিনেমা, সঙ্গীত, সাহিত্যসহ সমাজ জীবনের এমন কোনো অংশ কি আছে যেখানে ভারত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে নেই? সবশেষে তো ‘পাঠানের’ মতো ব্লকবাস্টার সিনেমাসহ ভারতীয় হিন্দি ছবি নিয়মিত বাংলাদেশে আসছে। কিন্তু প্রবল পরাক্রমী নতুন সরকারের আতঙ্ক কাটেনা কেন তার কোন সদুত্তর মিলছে না।