দীর্ঘদিন ধরে একের পর এক নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে দিশেহারা মানুষ। সরকার কোনভাবেই নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। সরকারও এ নিয়ে চিন্তিত। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার নতুন করে আরো কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সম্প্রতি নতুন করে বৃদ্ধি পেয়েছে চাল, ডাল, পেয়াঁজসহ বেশকিছু পণ্যের দাম। কিন্তু কিছুতেই এসব পণ্যের দাম কমছে না। নতুন করে আরো কিছু পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। এদিকে সপ্তাহের ব্যবধানে রাজধানীতে বেড়েছে ডিমের দাম। এক-দেড় মাস স্থিতিশীল পর্যায়ে থাকার পর ফের বাড়তে শুরু করলো নিত্যপণ্যটির দাম। সেই সাথে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে চড়া সবজির দাম। অপরদিকে এখন থেকে বাড়তে শুরু করেছে রমযানের ইফতার ও সেহেরী সামগ্রীর দাম।
নিত্যপণ্যের অসহনীয় দামে মানুষ দিশেহারা। সরকারের নানা চেষ্টা সত্ত্বেও নিয়ন্ত্রণে আসছে না বাজার। এ নিয়ে খোদ সরকারও চিন্তিত বলে জানিয়েছে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল। গতকাল শুক্রবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিশ্বব্যাপী দ্রব্যমূল্য নিয়ে অস্থিরতা চলছে। আমরাও দ্রব্যমূল্য নিয়ে চিন্তিত। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কাজ করছি। তবে বিশ্বব্যাপী অস্থিরতার মধ্যেও দেশের মানুষ ভালো আছে। খাদ্যে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। এটা অস্থিরতার মধ্যে ভালো দিক।
এদিকে সম্প্রতি বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেছেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে তিন মন্ত্রণালয় এক সঙ্গে কাজ করবে। ভোজ্যতেল, চিনিসহ কিছু পণ্য আছে, যা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তদারকি করে। আবার চালসহ কিছু পণ্য আছে, যা তদারকি করে খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়। আমরা এখন তিন মন্ত্রণালয় একসঙ্গে বসে বাজারের কী বিষয়ে কীভাবে ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সে বিষয়ে কাজ শুরু করব।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে দেখা গেছে, পাড়া-মহল্লার খুচরা দোকানে এখন প্রতি ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকা দরে। একটি ডিম ১৩ টাকা দরেও বিক্রি হতে দেখা গেছে। সে হিসাবে ডজন পড়ছে ১৫৬ টাকা। তবে বড় বাজারে ডিমের ডজন ১৪০-১৪৫ টাকায় মিলছে। এদিকে চলতি সপ্তাহে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছে পেঁয়াজ। ভারত রপ্তানি বন্ধ করার পরে নভেম্বর-ডিসেম্বরে উত্তপ্ত ছিল দেশের পেঁয়াজের বাজার। জানুয়ারি মাসে মুড়িকাটা পেঁয়াজের সরবরাহ বাড়ায় দাম ৮০ টাকায় মধ্যে নেমে আসে। মাসের শেষে নতুন করে বাজারে পেঁয়াজের দামে ঊর্ধ্বগতি দেখা গেছে।
পাড়া-মহল্লার খুচরা বাজারে বেশিরভাগ দোকানেই নতুন পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা কেজিতে। পুরোনোর কেজি ৯০ টাকা। তবে বড় বাজারে ৮০ টাকায়ও পাওয়া যাচ্ছে। ভোটের সময় সারাদেশে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছিল চালের দাম। সে সময় প্রতি কেজি চালের দাম ৬ টাকা পর্যন্ত বাড়ে। এরপর গত দুই সপ্তাহ ঢাকাসহ সারাদেশে মজুতবিরোধী অভিযান শুরু করে খাদ্য অধিদপ্তর। এ অভিযানের ফলে কোথাও কোথাও ধান ও চালের দাম কিছুটা কমেছে। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন,
আগেই উচ্চমূল্যে থাকা চালের দাম কমেছে সামান্যই। বাজারে মিনিকেট চাল কেজিতে সাড়ে ৬ টাকা বাড়লেও অভিযানের পর কমেছে ২ টাকা।
বাজারে দেখা গেছে, প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৬৮-৭০ টাকায়, এক সপ্তাহ আগেও যা ছিল ৭১-৭২ টাকা। তবে ভোটের আগে এ মিনিকেট বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৬৫-৬৬ টাকায়। হিসাব অনুযায়ী মিনিকেট চালের বাজার বেড়েছিল ৬ টাকা। অভিযানের পর সেই চালের দাম কমেছে মাত্র ২ টাকা। এভাবে ব্রি-২৮ জাতের চালের কেজি আগে ৫৫ থেকে বেড়ে ৬০ টাকা হলেও সর্বশেষ এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৮ টাকায়, স্বর্ণা ৫০ থেকে বেড়ে ৫৫ টাকা হলেও এখন ৫৩-৫৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, চালের দাম বাড়া শুরু করেছে নির্বাচনের পরের দিন থেকে। ২ হাজার ৯০০ টাকা বস্তার মিনিকেট হয়ে যায় ৩ হাজার ৩০০ টাকা। অভিযানে নামার পর বস্তাপ্রতি ১০০ টাকা কমে। অর্থাৎ যা বেড়েছিল তার থেকে অর্ধেক এখনো কমেনি।
সবজির বাজারে অস্বস্তি চলছেই। এখনো শীতকালে ভরা মৌসুম চলছে। তারপরও বাজারে অধিকাংশ সবজির দাম ৮০ টাকার ওপরে। যা সাধারণের নাগালের বাইরে। এছাড়া মৌসুমি ফুলকপি ও বাঁধাকপি প্রতি পিস ৪০-৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একটি মাঝারি আকারের লাউ ১০০-১২০ টাকায় খুচরা বিক্রি হচ্ছে, যা এক সপ্তাহের ব্যবধানে ১০-২০ টাকা বেড়েছে। এছাড়া খুচরা বাজারে শীতকালীন বেগুন ৯০-১১০ টাকা কেজি, দেশি শিম ৬০-১০০ টাকা, টমেটো ৭০-৯০ টাকা, শসা ৭০-৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে। যদিও বাজারে আলুর দাম কিছুটা কমতে শুরু করেছে। প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকার মধ্যে। অন্যান্য বছরের স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় এর দাম বেশি হলেও শেষ কয়েক মাসের তুলনায় কম।
সবজি বাজারে দেখা গেছে, বাজারে শিম ৬০ থেকে ৮০, শালগম ৫০, টমেটো ৭০-৯০, মটরশুঁটি ১০০, সাদা মুলা ৪০, লাল মুলা ৫০, দেশি গাজর ৫০, লম্বা বেগুন ১০০, সাদা গোল বেগুন ৯০, কালো গোল বেগুন ৯০, শসা ৯০, ক্ষিরাই ৭০, উচ্ছে ১০০, পেঁপে ৫০, মিষ্টিকুমড়া ৪০, ঢ্যাঁড়স ১০০, চিচিঙ্গা ৮০, ধুন্দল ৭০, বরবটি ১০০, কচুর লতি ৮০, কচুরমুখী ১০০, কাঁচা মরিচ ৮০ থেকে ১০০ ও ধনেপাতা ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।বেশ কিছু সবজির দাম বেড়েছে ১০ টাকা থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত। এর মধ্যে পেঁপের দাম বেড়েছে ১০ টাকা ও উচ্ছের দাম বেড়েছে ৩০ টাকা।
এছাড়া দেশি রসুন ২৬০-২৮০ টাকা, চায়না রসুন ২২০ টাকা, ভারতীয় আদা ২২০, চায়না আদা ২২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ছোট মসুর ডাল ১৩৫, মোটা মসুর ডাল ১১০, মুগডাল ১৭৫, খেসারি ডাল ১১০, বুটের ডাল ১০০, ছোলা ১১০, প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৭৩, প্যাকেটজাত চিনি ১৪৫, খোলা চিনি ১৪০, দুই কেজি প্যাকেট ময়দা ১৫০, আটা দুই কেজির প্যাকেট ১৩০ এবং খোলা সরিষার তেল প্রতি লিটার ১৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
মাছের বাজারেও দেখা গেছে অধিকাংশ মাছের দাম বেশি। ইলিশ ওজন অনুযায়ী ১২০০ থেকে ২০০০ টাকা, রুই ৪০০ থেকে ৭০০, কাতল ৪৫০ থেকে ৫০০, কালিবাউশ ৪০০ থেকে ১২০০, চিংড়ি ৭০০ থেকে ১২০০, কাঁচকি ৪৫০, কৈ ২৫০ থেকে ১৫০০, পাবদা ৪০০ থেকে ৭০০, শিং ৪০০ থেকে ১২০০, বেলে ৬০০ থেকে ১২০০, টেংরা ৬০০ থেকে ৮০০, মেনি ৫০০ থেকে ৮০০, কাজলি ১১০০ থেকে ১২০০, বোয়াল ৬০০ থেকে ১২০০, রূপচাঁদা ১০০০ থেকে ১২৫০ ও শোল ৯০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
ব্রয়লার মুরগি ১৯০ থেকে ২০০ টাকা, কক ২৬৫ থেকে ২৮০, লেয়ার ২৮০ টাকা, দেশি মুরগি ৫০০ ও গরুর গোশত ৭৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। মুরগির লাল ডিম ১৩৫ টাকা এবং সাদা ডিম ১৩০ টাকা প্রতি ডজন বিক্রি হচ্ছে।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে তিন মন্ত্রণালয় একসঙ্গে কাজ করবে
সম্প্রতি বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেছেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে তিন মন্ত্রণালয় এক সঙ্গে কাজ করবে। ভোজ্যতেল, চিনিসহ কিছু পণ্য আছে, যা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তদারকি করে। আবার চালসহ কিছু পণ্য আছে, যা তদারকি করে খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়। আমরা এখন তিন মন্ত্রণালয় একসঙ্গে বসে বাজারের কী বিষয়ে কীভাবে ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সে বিষয়ে কাজ শুরু করব। মন্ত্রিসভার বৈঠকের পরে বসতে পারিনি। ওমরাহ পালন করার জন্য দেশের বাইরে আছেন কৃষিমন্ত্রী। তিনি এলেই কৃষি, খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একসঙ্গে বসে বাজারটাকে কীভাবে যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা যায় এবং কার কী ভূমিকা, কে কী করবেন, তা নিয়ে কাজ শুরু করব।’
এদিকে চাল, চিনি, ভোজ্যতেল ও খেজুরের শুল্ক কমাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, চারটি পণ্যের শুল্ক কমাতে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চাল হচ্ছে খাদ্য অধিদপ্তরের। চালের বাজার, মজুত ও বিপণনের দায়িত্ব খাদ্য অধিদপ্তরের।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘দুটি পণ্যের মূল্য নির্ধারণের এখতিয়ার আমাদের আছে। একটি চিনি, অন্যটি ভোজ্যতেল। বাজারে যেসব পণ্য নিয়ে বেশি আলাপ হয়, তার মধ্যে এই দুটি রয়েছে। এ বিষয়ে বলছি যে, গত ২২ জানুয়ারি চিঠি দিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) বলা হয়েছে, যাতে শুল্ক কমিয়ে দেওয়া হয়। গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ নিয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এটা কার্যকর হলে ভোক্তা পর্যায়ে কিছুটা স্বস্তি আসবে।’ এর আগেও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু কাজ হয়নি- এ বিষয়ে তিনি বলেন, সেটা আমি কী করতে পারি? আমাদের যা করার করে দিয়েছি। এখন এনবিআর বলতে পারবে।
তিনি বলেন, এনবিআরের সঙ্গে আর বৈঠক করার দরকার নেই। চিনি, ভোজ্যতেল ও খেজুরের শুল্ক কমানোর বিষয়ে গত ২২ জানুয়ারি আমরা চিঠি দিয়েছি। বৃহস্পতিবার তারা চিঠি পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। এখন এনবিআর কাজ করছে এ বিষয়ে। রমজান উপলক্ষে চিনির যে ৩০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আছে, সেটা কমানোর প্রস্তাব দিয়েছি। ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশের জায়গায় ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব আমরা দিয়েছি। আর খেজুরের একটা ভ্যালু (মূল্য) ঠিক করা ছিল, আমরা বলেছি ইনভয়েস ভ্যালুতে শুল্কায়ন করার জন্য।’