সারাদেশে চলছে বোরো-ইরি আবাদ। এই শীত শেষে বোরো-ইরি ধান চাষে সেচের প্রয়োজন হবে। একই সাথে আসছে রমজান মাস এবং গ্রীষ্মের গরম সব মিলিয়ে আগামী ফেব্রয়ারির মাঝামাঝি থেকে এবার বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি অনেক বেড়ে যাবে। বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে এবার গরমে সর্বোচ্চ চাহিদা ১৭ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যাবে। এ পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে দরকার হবে বিপুল পরিমাণ তেল, গ্যাস এবং কয়লা। চলমান ডলার সংকট, গ্যাস সংকট এবং আর্থিক চাপের মধ্যে এবার প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানি করে চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে কিনা সেটি নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উদ্যোক্তা, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন বর্তমান বাস্তবতায় এ বছর নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে বড় চ্যালেঞ্জ।
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে এবার গরমে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা হতে পারে সাড়ে সতের হাজার মেগাওয়াট। পুরো জ্বালানি আমদানি করতে না পারলে কিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ রাখতে হবে। সেক্ষেত্রে করতে হবে লোডশেডিং। এখনো গ্যাসের অভাবে বন্ধ রাখতে হচ্ছে বিদ্যুৎ কেন্দ্র। আবার বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসে থাকলেও ক্যাপাসিটি চার্জের নামে কেন্দ্র ভাড়া দেয়ার জন্য ব্যয় বাড়ছে পিডিবির। পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন জানান বিদ্যুৎ বিভাগ যেভাবে পরিকল্পনা করছে তাতে এ বছর ১৬ হাজার মেগাওয়াটের বেশি উৎপাদন করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। সর্বোচ্চ চাহিদার সময় গরমে ৫শ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হতে পারে। তবে যদি জ্বালানি আমদানিতে ব্যাঘাত ঘটে এবং বিশ্ববাজারে জ্বালানি মূল্যে নতুন কোনো সংকট তৈরি হয় সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১৫শ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হওয়ার আশঙ্কার কথাও জানান তিনি।
অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দেশের আর্থিক পরিস্থিতি এবং ডলার সংকট মিলিয়ে এ বছর বিদ্যুৎ চাহিদা কীভাবে সামাল দেয় সরকার সেটি দেখার বিষয়। সক্ষমতা থাকার পরও চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে না পারাটা সরকারের কাঠামোগত সমস্যা হিসেবেই দেখেন তিনি।
বর্তমানে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা আছে ২৫ হাজার ৪৯১ মেগাওয়াট। কিন্তু বিদুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা থাকলেও যে পরিমাণ জ্বালানির প্রয়োজন তা আমদানির জন্য ডলার সঙ্কটে রয়েছে সরকার। আসছে গরমে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে এখন বিপুল পরিমাণ জ্বালানি আমদানির প্রয়োজন হয়। সরকারি ও বেসরকারিভাবে এই আমদানি হয়ে থাকে। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের পাশাপাশি এখন বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো তেল আমদানি করতে পারে। এছাড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য এখন অনেক কয়লা আমদানি করতে হয়। তেল ও কয়লা এবং গ্যাস আমদানির জন্য প্রচুর ডলার প্রয়োজন। পিডিবির তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা ৭৮টি। যার মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৮ হাজার ৭৭৮ মেগাওয়াট। এর মধ্যে তেল ভিত্তিক ৪৭টি কেন্দ্রের ক্ষমতা ৫ হাজার ৩৬০ মেগাওয়াট। বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো জানাচ্ছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য তেল আমদানি করা এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে বিপিসির কাছ থেকে কিনতেও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। বাংলাদেশে ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিপ্পা) সভাপতি ফয়সাল কে খান বলছেন, আগামী তিন মাসের উৎপাদন নিশ্চিত করতে ডলারের সাপোর্ট জরুরি ভিত্তিতে দরকার। সামনের দিকে আমরা খুবই চিন্তিত আছি আগামী কয়েকমাস নিয়ে। আগামী মাসগুলিতে আইপিপিগুলোর অবশ্যই উৎপাদন বাড়াতে হবে। আমাদের তেল আমদানি করতেই হবে। বেশিরভাগ বেসরকারি এইচএফও (ফার্নেস অয়েল) প্ল্যান্ট নিজেরা আমদানি করে অথবা বিপিসি থেকে সাপ্লাই নেয়। এই মুহূর্তে যে সমস্যাটা হয়ে গেছে ঠিক আইপিপিগুলো যেমন আমদানি করতে সমস্যা ফেইস করছে ডলার নিয়ে বিপিসিও একই সমস্যা ফেইস করছে। বিপিসিও আমাদেরকে তেল দিতে পারছে না যখন আমরা তাদের কাছে অনুরোধ করছি।
বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি যত বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে তার সমস্ত বিদ্যুৎ এবং আমদানির অংশ একক ক্রেতা হিসেবে কিনে নেয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। পিডিবি আবার বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে সেই বিদ্যুৎ বিক্রি করে। কিন্তু ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রোডিউসার (আইপিপি), রেন্টালসহ জ্বালানির ধরন এবং কেন্দ্র ভেদে যে দামে বিদ্যুৎ কিনতে হয়, পিডিবিকে তার চেয়ে কম দামে বিক্রি করতে হয়। বেশি দামে কিনে কম দামে বিক্রির কারণে একটা বড় অর্থ সংকট তৈরি হয়েছে পিডিবির। এই অর্থ সংকটের কারণে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে সময়মতো বিল পরিশোধ করতে পারেনি পিডিবি। বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে যে পিডিবির কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করে পাওনা প্রতি মাসে পাওয়ার কথা থাকলেও প্রায় দেড় বছর ধরে বকেয়া পড়ে আছে।
বিপ্পার সভাপতি ফয়সাল কে খান বলেন, বকেয়া টাকা না পেয়ে ঋণ করে তাদের চলতে হচ্ছে। অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্র মারাত্মক সংকটে পড়েছে। তিনি বলেন, আমাদের পাওনা জমেছে গত দেড় বছর ধরে। আমরা অনেক জায়গায় বক্তব্য রেখেছি। এখন বকেয়াটা ত্রিশ হাজার কোটি রেঞ্জে চলে গেছে। তবে বন্ড ইস্যু করার সিদ্ধান্ত হয়েছে যেখানে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যে বিল জমেছে সেটা ক্লিয়ার করে দেবে। কিন্তু এই সমাধানেও ক্যাশ ফ্লোর সংকট রয়ে যায়। আমাদের উচ্চ সুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লোন নিতে হচ্ছে। যারা যারা বড় কোম্পানি আছে স্ট্রং ব্যালেন্স শিট আছে তারা হয়তো লোনটা পে অফ করতে পারছে। তারপরেও আমরা কৃতজ্ঞ যে সরকার বন্ডের উদ্যোগটা নিয়েছে।
বেসরকারি উদ্যোক্তারা বকেয়ার পরিমাণ ত্রিশ হাজার কোটি টাকা বললেও পিডিবির সূত্র বলছে দেনার পরিমাণ ২৭ হাজার কোটি টাকা। বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বিক্রি করার কারণে পিডিবির এই আর্থিক সংকট তৈরি হয়েছে। এই ঘাটতি ভর্তুকি হিসেবে পরিশোধ করার কথা থাকলেও টাকার সংকটে সরকার পিডিবির সমস্ত ভর্তুকি দিতে পারেনি।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের হিসেব বলছে, গত দুই বছরে আর্থিক সংকট প্রকট হয়েছে। এখন বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি এবং বকেয়া পরিশোধের জন্য বিশেষ বন্ড ইস্যু করতে শুরু করেছে সরকার। এছাড়া সামনে ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুতের দামও বাড়ানোর চিন্তাভাবনা চলছে। পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, পর্যায়ক্রমে ভর্তুকি থেকে একটা সময় বের হয়ে আসতে হবে বিদ্যুৎ খাতকে। সাবসিডি দিয়ে কখনোই নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে না। এই যে ধরুন এখন যে সমস্যাটা তৈরি হচ্ছে, আইপিপিগুলোকে পেমেন্ট করতে গিয়ে পিডিবিকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সুতরাং এটাতো একটা কস্ট রিফ্লেকটিভ ট্যারিফ অনিবার্য। দাম সমন্বয় এবং উৎপাদন খরচ কমিয়ে এই দুটোকে সমন্বয় করে আমরা একটা জায়গায় আশা করি অদূর ভবিষ্যতে যেতে পারবো।
উদ্যোক্তারা বলছেন ডলার সংকট এবং এলসি জটিলতা না কাটলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রভাব পড়তে পারে এ বছর। আগামী তিন মাসের জন্য বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর তেল আমদানির জন্য আড়াইশ থেকে তিনশ মিলিয়ন ডলারের একটা সাপোর্ট তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে চাইছেন। তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো চাহিদা পূরণ করতে জরুরি ভিত্তিতে এই বিশেষ সুবিধা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়েক বছর আগেও গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল ছিল। বর্তমানে গ্যাস নির্ভরতা পঞ্চাশ শতাংশের কম। নিজস্ব গ্যাসক্ষেত্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত গ্যাস পাওয়া যায় না। বাংলাদেশ এখন এলএনজি আমদানির মাধ্যমে গ্যাস সংকট মেটানোর চেষ্টা করছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের বাইরে এখন তেল ও কয়লার ব্যবহার বেড়েছে। এই তেল এবং কয়লার সিংহভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। পিডিবির তথ্য অনুযায়ী ভারত থেকে আমদানি, আদানির বিদ্যুৎসহ ২০২২-২৩ অর্থবছরে এখাতে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের জ্বালানি খরচ হয়েছে ৬১ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে একটা বড় অংশই তেল ও কয়লা বিদ্যুতের জ্বালানি খরচ। বিশ্লেষকরা বলছেন আমদানি নির্ভরতার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি খরচ বাড়ছে এবং সেটা সরাসরি ডলারের ওপর চাপ তৈরি করছে।
তেলের বাইরে বড় পরিমাণে কয়লাও আমদানির করতে হচ্ছে। এ বছর গ্রীষ্মে কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র থেকে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা আছে। গত বছর কয়লার মূল্য পরিশোধ করতে বিলম্বের কারণে দক্ষিণাঞ্চলের সবচে বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র পায়রা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। টানা ২৫ দিন এটি বন্ধ থাকায় দেশজুড়ে ব্যাপক বিদ্যুৎ সংকট তৈরি হয়।
গত অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার জন্য খরচ পড়েছে ১২ হাজার ৭শ কোটি টাকার বেশি। এ বছর গরমের দিনে ৫ হাজার মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা আছে বিদ্যুৎ বিভাগের। এর জন্য প্রয়োজন হবে প্রতি দিন প্রায় ৫০ হাজার টন কয়লা।
বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এম খোরশেদুল আলম বলেন, তাদের এলসি খুলতে জটিলতা নেই কারণ চীন থেকে সেটা করা হয়। এছাড়া এ বছর কয়লার দাম গত বছরের তুলনায় কমে এসেছে ফলে সমস্যা কিছুটা কম হবে বলে তিনি মনে করেন।