পবিত্র রমজান মাসের আর মাত্র দেড় বাস বাকি। সিয়াম সাধনার এই মাস উপলক্ষে পেঁয়াজ, তেল, চিনি, খেজুর, মসুর ডাল ও ছোলা এই ৬ নিত্যপণ্যেল চাহিদা সবচেয়ে বেশি। বাজারে এই পণ্যগুলোর সরবরাহ নির্বিঘ্ন করতে আমদানিতে শূন্য মার্জিন রেখে ঋণপত্র (এলসি) খোলার সুযোগ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে ব্যবসায়ীরা। গত ৩ জানুয়ারি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক সভায় ব্যবসায়ীরা এই অনুরোধ জানান। ২১ জানুয়ারি ৫ জন মন্ত্রী জরুরী বৈঠক করে রমজানে বাজার ব্যবস্থাপনা মনিটরিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তারা বলেছেন, নিত্যপণ্যের কোনও সংকট নেই, এলসি মীমাংসায়ও নেই কোনও জটিলতা। গতকাল বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু জানিয়েছেন, দেশের আমদানিকারক ও উৎপাদনকারীদের সাথে বৈঠক করা হয়েছে। আগে দেশে চিনি, তেল ও খেজুরের শুল্ক বেশি ছিল। শুল্ক যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে এনবিআরে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। রমজানে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং ভারত থেকে ২০ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ ও ৫০ হাজার মেট্রিক টন চিনি আমদানি করা হবে।
গত বৃহস্পতিবার এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম জানিয়েছেন রমজান সামনে রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য সহনীয় রাখতে আমদানি শুল্ক কমানোর প্রস্তাব আমরা পেয়েছি এবং আমরা এ ব্যাপারে কাজ করছি। প্রশ্ন হচ্ছে আসন্ন রজমান উপলক্ষ্যে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের এতো উদ্যোগ, এনবিআরের আমদানি শুল্ক কমানোর পরও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকবে? অতিতের অভিজ্ঞতা থেকে বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো ভাবেই এবার বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না। গত দুই বছর ধরে বাজার নিয়ন্ত্রণের অসংখ্য উদ্যোগ নিয়ে সফল হতে পারেনি। পণ্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে পযুদস্ত সাধারণ মানুষ। নির্বাচনের পর পরই চাল-ডালসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এখনো প্রায় প্রতিদিন ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে অভিযান পরিচালনা করছে। অধিকমূল্য নেয়ায় জরিমানা করছে। যা খুবই অপ্রতুল এবং লোক দেখানোর নামান্তর। ‘শর্ষের ভিতরে ভুত রেখে’ ভুত তাড়ানোর চেষ্টা চলছে। প্রতি সপ্তাহে প্রতিটি পণ্যের দাম ৫ থেকে ১০ টাকা করে বাড়ছে। ডলার সংকটের কারণে দেশের অর্থনীতি কার্যত বিশৃংখলার মুখে নিপতিত হয়েছে। গতকালও অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী অসৎ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন ।Player
দেশের যে কর্পোরেট হাউজগুলো ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে থাকে তার প্রায় সবগুলোর মালিকরা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। তারাই বাজারে সিণ্ডিকেট করে পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেন, বাজারে পণ্য সংকটের সৃষ্টি করেন। প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণী পদে থেকে তারাই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং তারাই সেটা কার্যকর করেন। ফলে তারা নিজেদের স্বার্থের বাইরে যেতে চান না। এতে করে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। রমজান মাসে পেঁয়াজ, তেল, চিনি, খেজুর, মসুর ডাল ও ছোলা এই ৬টি পণ্যেল চাহিদা বেশি থাকে। তবে ডলার সংকটের কারণে এসব পণ্য সময়মতো আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছোলার আমদানি বেড়েছে অনেকটাই। তবে মসুর ও মটর ডালের আমদানি বাড়েনি। গম, ভোজ্যতেল, চিনিসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের আমদানি এখনো কম। তবে আমদানির উদ্যোগ বেড়েছে। অর্থাৎ, এসব পণ্য আমদানির জন্য ব্যাংকে ঋণপত্র খেলা বেড়েছে।
জানতে চাইলে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ডলার সংকট আছে ঠিকই। তবে ব্যবসায়ীরা ভোক্তাকে যেভাবে জিম্মি করে রোজার আগেই পণ্যের দর বাড়াচ্ছেন, তা অস্বাভাবিক। সরকার বারবার কঠোর নিয়ন্ত্রণের কথা বললেও আদতে তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। রমজানে বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে এমন প্রত্যাশা করা কঠিন।
বাজার সিণ্ডিকেট নিয়ে সরকারে অসহায়ত্ব প্রকাশ করে ২০২৩ সালের ২৬ জুন জাতীয় সংসদে ওই সময়ের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছিলেন, ‘সিন্ডিকেটের কথা বলা হয়। এটা ঠিক বড় বড় গ্রুপগুলো একসঙ্গে অনেক বেশি ব্যবসা করে। তারা হঠাৎ করে ক্রাইসিসটা তৈরি করে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে বিপদে পড়তে হবে।’ মূলত টিপু মুনসি ব্যবসায়ী হোমরা চোমরাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে অপরাগতা প্রকাশ করেন। কারণ যারা সিিিণ্ডকেট করে তাদের অনেকেই এমপি মন্ত্রী। এবারও ব্যতিক্রম নে।ি নব নির্বাচিত ২৯৯ এমপির মধ্যে ২০০ জনের পেশা ব্যবসা। শতকরা হিসেবে এমপিদের মধ্যে ৬৭ ভাগ হচ্ছেন ব্যবসায়ী। এরাই মূলত দেশের সব সেক্টরের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।
গত ২১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আন্তমন্ত্রণালয়ের এক জরুরি সভার আয়োজন করা হয়। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সভাপতিত্বে সভায় খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী আব্দুর রহমান, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, এনবিআর চেয়ারম্যানসহ রাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় দেশের খোলা বাজারে নিত্যপণ্যের সরবরাহ বাড়ানোর কৌশল নির্ধারণ, মজুতদার ও সিন্ডিকেটের কারসাজি রোধ এবং প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির মাধ্যমে দ্রুত সময়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের উপায় নিয়ে কথা বলা হয়। সভায় বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন ও আমদানি পরিস্থিতির সঙ্গে চাহিদা বিশ্লেষণ করে ঘাটতি চিহ্নিত করা এবং রমজানের আগে ঘাটতি মেটাতে পণ্য আমদানি সহজ করা এবং রমজানে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং বাজার মনিটরিংয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
রমজানে বেশি চাহিদা থাকে ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, মটর ডাল, মসুর ডাল, পেঁয়াজ ও খেজুরের। গমের চাহিদা সব সময়ই থাকে। এসব পণ্যের বেশির ভাগের চাহিদা মেটে আমদানি করে। কিন্তু ডলার সংকটে আমদানির ঋণপত্র কমে গেছে। রোজা উপলক্ষ্যে যে আমদারি ঋণপত্র খোলা হচ্ছে তাতে পণ্যের মূল্য বেশি পড়বে। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকের বেধে দেয়া ডলার নির্ধারিত দামে পাওয়া যাচ্ছে না। ডলার সংকট ও ডলারের দাম নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা কাটছে না। এতে বৈধ পথে শুল্ককর দিয়ে পণ্য আমদানিতে ব্যবসায়ীরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।
নিত্যপণ্যের আমদানিকারক বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের যে দর নির্ধারণ করে দিয়েছে, সেই দরে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাংক একেকজনের কাছে একে দর চাইছে। এতে নিত্যপণ্যে যে প্রতিযোগিতা, তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের মে মাসে মার্কিন ডলারের দর ছিল ৮৬ টাকার আশপাশে। এখন তা সরকারি কাগজে-কলমে ১১০ টাকা। অথচ ব্যবসায়ীদের আমদানির ক্ষেত্রে ডলার কিনতে ১২৪ টাকার মতো দাম দিতে হচ্ছে। ডলারের দাম যতই বাড়ছে, পণ্যে করভার ততই বাড়ছে। কারণ, শুল্ক আরোপ হয় শতাংশ হারে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, রোজায় ভোজ্যতেলের চাহিদা থাকে বেশি। ব্যবসায়ীদের হিসাবে এই চাহিদা অন্তত সাড়ে তিন লাখ টন। ভোজ্যতেলের মধ্যে সয়াবিন আমদানি কমলেও পাম তেল আমদানি বেড়েছে। এনবিআর হিসাবে, গত ১ নভেম্বর থেকে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত হিসাবে দেশে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি কমেছে ৪৪ শতাংশ। তবে সয়াবিন ও পাম দুই ধরনের তেল আমদানিতেই ঋণপত্র বেড়েছে। রমজানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য চিনি। অথচ দেশের চিনিকলগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আমদারির ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় চিনির দাম এখন চড়া। প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকায়, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৪ শতাংশ বেশি। দাম বাড়ার একটি কারণ আমদানি কম। গত নভেম্বর থেকে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত অপরিশোধিত চিনি আমদানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২২ শতাংশ কমেছে। বছরে দেড় লাখ টনের বেশি ছোলার চাহিদা। প্রতিবছর আমদানি হয় দুই লাখ টনের মতো। এর মধ্যে শুধু রমজানেই চাহিদা থাকে প্রায় এক লাখ টনের। স্থানীয়ভাবে ছোলার উৎপাদন একেবারে কম। ফলে পণ্যটির চাহিদা পূরণ করতে হয় আমদানি করে। রমজানের আগেই এখনই ছোলা ও ছোলার ডালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকায়। রোজায় দরকার হয় এমন অন্য ডালের দামও বেড়েছে। প্রতি কেজি অ্যাংকর ডাল ৭৫ থেকে ৮০, খেসারি ডাল ১১০ থেকে ১২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। নির্বাচনের আগে ছোলার কেজি ৮৫ থেকে ৯০ টাকা, অ্যাংকর ডাল ৬৫ থেকে ৭০ এবং ৯০ থেকে ১০০ টাকা দরে খেসারি ডাল বিক্রি হতো।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভোজ্যতেল, চিনি ও খেজুরের ওপর শুল্ককর কমানোর অনুরোধ জানিয়ে সম্প্রতি চিঠি দিয়েছে এনবিআরকে। গত বৃহস্পতিবার এনবিআরের এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান বলেন, রমজান সামনে রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য কমানোর জন্য আমদানি শুল্ক কমানোর প্রস্তাব আমরা পেয়েছি। সেটা নিয়ে কাজ করছি।
বর্তমানে চালসহ প্রতিটি পণ্যের দাম বেশি। ডলার সংকটের কারণে এবার আমদানি কম হওয়ায় প্রতিটি পণ্যের দাম আরো বেড়ে যেতে পারে এমন আশঙ্কা ভোক্তাদের। তাদের বক্তব্য ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট সরকারের ভিতরেই (মন্ত্রী-এমপি ও ক্ষমতাসীন দলের অনুসারি) থাকায় দুই বছরেও পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের কোনো উদ্যোগ সফলতার মুখ দেখেনি। এবারও রমজান দেড় মাস থেকে দুই মাস আগেই নিত্যপণ্যের বাজারে অসাধু ব্যবসায়ী চক্রের কালো ছায়া পড়তে শুরু করেছে। চালের মূল্য নিয়ন্ত্রণে নানান উদ্যোগের পরও তা নিয়ন্ত্রণে আসেনি। বরং সিন্ডিকেট চক্র ক্রেতার পকেট কাটতে পুরোনো সেই চক্র ফের নড়েচড়ে বসছে। রমজানে কয়েক গুণ চাহিদা থাকে ছোলা, ভোজ্যতেল, চিনি, অ্যাংকর ডাল, খেজুর ও পেঁয়াজের। ডলার সংকটের কারণে এসব পণ্য আমদানি কম হয়েছে। ফলে এখনোই অসাধু ব্যবসায়ীদের ‘শকুন চোখ’ এসব পণ্যের প্রতি পড়েছে। সরবরাহে কোনো ঘাটতি না থাকলেও নানা ছুতায় এসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়া হতে পারে।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ডলারের দর বেড়ে যাওয়ায় বাজারে পণ্যের দামে প্রভাব পড়েছে। রোজার যে সময় বাকি, তাতে নতুন করে আমদানি করে বাজারে সরবরাহ বাড়ানো কিছুটা সমস্যা হতে পারে। তবে যেসব পণ্য এখন মজুত আছে, এগুলোর সরবরাহ অন্তত স্বাভাবিক রাখার উদ্যোগ থাকা দরকার।
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেছেন, রমজান উপলক্ষে যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য মজুত রয়েছে। ভারত দীর্ঘ দিন রপ্তানি বন্ধ করে রেখেছিল, ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। রমজান মাসের আগেই ভারত বাংলাদেশে চিনি ও পেঁয়াজ রপ্তানি করবে। আগে যে শুল্ক ছিল তা কমিয়ে আনা হবে। এছাড়া ব্রাজিল ও বিভিন্ন দেশ থেকে চিনিসহ বিভিন্ন সামগ্রী আসছে।