রমজানের এখনো দেড় মাসের মতো বাকি। এরই মধ্যে রমজান নির্ভর পণ্য নিয়ে এখন থেকেই তৎপর সিন্ডিকেট চক্র। ফলে বাজারে ছোলা, ডাল, ভোজ্য তেল, চিনি, আদা, রসুন ও পিয়াজের দাম বাড়ছে। আর রমজানেই এসব পণ্যের চাহিদা থাকে কয়েক গুণ। তথ্য বলছে- গম, ভোজ্য তেল, চিনিসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের আমদানি এখনো কম। তবে উদ্যোগ বেড়েছে। অবশ্য সরকার বলছে, পণ্যের পর্যাপ্ত মজুত আছে। তাই সরবরাহ বা ঘাটতি নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই। তবে নানা অজুহাতে এসব পণ্যের দাম বাড়াতে এরইমধ্যে থাবা দিয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীচক্র।
ক্রেতারা বলছেন, রমজানকে সামনে রেখে অসাধু ব্যবসায়ীচক্র পুরোনো ছক কাজে লাগাচ্ছে। রমজান নির্ভর পণ্যের দাম তারা আগেই বাড়িয়ে নিচ্ছে।যাতে রমজানে নতুন করে দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হয় না।
একইসঙ্গে দীর্ঘ সময় ভোক্তার পকেট কেটে অতিরিক্ত মুনাফা করা যায়।
ব্যবসায়ীদের দাবি, আমদানি বাড়লে পণ্যের সরবরাহে সমস্যা হবে না। সরকার যদি শুল্কছাড় দেয়, তাহলে পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখা যাবে। তবে ডলারের দাম নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েছে।
এদিকে রমজান মাসে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু। তিনি বলেন, চিনি, তেল ও খেজুরের শুল্ক বেশি ছিল। শুল্ক যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে এনবিআরে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। রমজান উপলক্ষে যথেষ্ট পরিমাণ মজুত আছে। এ ছাড়া আগামী তিন মাসের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য মজুত আছে। তাই এবার রমজানে দেশে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশে (টিসিবি) হালনাগাদ তথ্য বলছে, এক বছরে চিনির দর বেড়েছে প্রায় ২৪ শতাংশ। এক বছর আগে চিনির দর ছিল ১১০ থেকে ১২০ টাকা। বর্তমানে ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকা। খেজুরের দর বেড়েছে প্রায় ১২ শতাংশ। এক বছর আগে খেজুরের দর ছিল ১৫০ থেকে ৪৫০ টাকা। বর্তমানে ২৫০ থেকে ৪২০ টাকা। এক বছরে ছোলার দরও প্রায় ১২ শতাংশ বেড়েছে। এক বছর আগে ছোলার দর ছিল ৮৫ থেকে ৯০ টাকা। বর্তমানে ৯৫ থেকে ১০০ টাকা। এক বছরে পাম অয়েলের দর বেড়েছে প্রায় ৬ শতাংশ। এক বছর আগে পাম অয়েলের দর ছিল ১২০ থেকে ১২৫ টাকা। বর্তমানে ১২৫ থেকে ১৩৫ টাকা। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে পিয়াজের দর, প্রায় ১৬১ শতাংশ। এক বছর আগে পিয়াজের দর ছিল ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা। বর্তমানে ৯০ থেকে ১০০ টাকা।
পাশাপাশি ব্রয়লার মুরগির দর বেড়েছে প্রায় ২৯ শতাংশ। এক বছর আগে ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকা। বর্তমানে ১৮৫ থেকে ১৯৫ টাকা। এ ছাড়া দেশি আদার দাম বেড়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ। এক বছর আগে দেশি আদার দর ছিল ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা। বর্তমানে ২৫০ থেকে ২৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে টিসিবি’র দামের তালিকার সঙ্গে খুচরা বাজারের দরের মিল খুব কম পাওয়া গেছে।
প্রতি বছর রমজানের আগেই নিত্যপণ্যের বাজারে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণ অধিদপ্তর দফায় দফায় বৈঠক করে। এমনকি কিছু পণ্যের আমদানি শুল্কও কমানো হয়। কিন্তু ভোক্তারা এর সুফল পায় না। এবারো রমজানে বহুল ব্যবহৃত ৮ ধরনের পণ্য আমদানিতে এলসি মার্জিন শিথিল করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাজার বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে আমদানি পর্যায়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণ দরকার। বিশেষ করে আমদানিকারকরা কতো দরে পণ্য আমদানি করছেন, চাহিদার চেয়ে মিল পর্যায়ে কী পরিমাণ মজুত রয়েছে, এসব বিষয়ে নজরদারি বাড়ানো জরুরি।
রমজানে বেশি চাহিদা থাকে ভোজ্য তেল, চিনি, ছোলা, মটর ডাল, মসুর ডাল, পিয়াজ ও খেজুরের। গমের চাহিদা সব সময়ই থাকে। এসব পণ্যের বেশির ভাগের চাহিদা মেটে আমদানি করে। এরমধ্যে রমজানে সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে খেজুর ও ছোলার। রাজধানীর কাওরান বাজার ও বিভিন্ন বাজারে ছোলা ও ছোলার ডালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, বছরে দেড় লাখ টনের বেশি ছোলার চাহিদা রয়েছে। প্রতি বছর আমদানি হয় দুই লাখ টনের মতো। এরমধ্যে শুধু রমজানেই চাহিদা থাকে প্রায় এক লাখ টনের। স্থানীয়ভাবে ছোলার উৎপাদন একেবারে কম।
বাজারে এখন ৪০০ টাকার কমে খেজুর পাওয়াই যায় না। খুচরা বাজারে মারিয়াম খেজুরের কেজি ৯০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ এবং আজওয়ার কেজি ৭০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা। কম দামের মধ্যে বরই খেজুর ও খুরমার কেজি মিলছে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায়। অথচ গত বছর এসব খেজুরের কেজি অন্তত ২০০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল বলে জানান খেজুর বিক্রেতারা।
আমদানিকারকদের দাবি, বিলাসী পণ্যের মতো শুল্ক আরোপ করা হয়েছে খেজুরে। গত এক বছরের ব্যবধানে খেজুর আমদানি খরচ বেড়েছে কয়েক গুণ। প্রতি বছর খেজুরের চাহিদা প্রায় এক লাখ টন। এর অর্ধেকই, অর্থাৎ ৫০ হাজার টন দরকার হয় রমজানে। অভিযোগ আছে, ব্যবসায়ীরা এ চাহিদা বাড়ার সুযোগ নেন।
ভোজ্য তেলের বাজারেও চলছে অস্থিরতা। মাস দেড়েক আগে কোনো ঘোষণা ছাড়াই সয়াবিন তেল লিটারে চার টাকা বাড়ায় পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো। তাতে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন ১৭৩ ও পাঁচ লিটারের বোতল ৮৪০ টাকা করা হয়। দুই সপ্তাহ ধরে খোলা সয়াবিন ও পাম অয়েলের দরও বাড়তি। পাঁচ টাকার মতো বেড়ে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন ১৬০ থেকে ১৬৫ এবং পাম অয়েল ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। দেশে বছরে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত মিলিয়ে প্রায় ২০ লাখ টন তেল আমদানি হয়। এরমধ্যে রমজানে ভোজ্য তেলের চাহিদা সাড়ে ৩ লাখ টন।
এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, রমজানকে সামনে রেখে কিছু পণ্যে আমদানি শুল্ক ও কর কমানোর কাজ চলছে। তবে কোন কোন পণ্যে শুল্ক কমানো হবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট করেননি তিনি। অবশ্য গত সোমবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ভোজ্য তেল, চিনি ও খেজুর আমদানি শুল্ক কমানোর জন্য চিঠি দিয়েছে ব্যবসায়ীরা।
কনজ্যুমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ব্যবসায়ীরা রমজানের আগেই পণ্যের দর বাড়াচ্ছেন, তা অযৌক্তিক। সরকার বার বার কঠোর নিয়ন্ত্রণের কথা বললেও আদতে তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আমদানিকারকদের আমদানি দর, শুল্ক খরচ ও কারখানায় মজুতের পরিমাণ তদারকি করলে পণ্যের দামের কারসাজির খুঁটিনাটি বেরিয়ে আসবে। এই দাবি বারবার তোলা হলেও কার্যকর হচ্ছে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা গেছে, এপ্রিল থেকে নিয়ন্ত্রণ আরোপের ফলে মে থেকে আমদানি কমে। ডলার সংকট ও নিয়ন্ত্রণের ফলে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানির এলসি খোলা কমে যায় ২৬.৬৭ শতাংশ এবং আমদানি রেকর্ড পরিমাণে ৯২.৬৬ শতাংশ কমে যায়। এক বছরে আমদানি কমার এটাই ছিল রেকর্ড। ওই হারে আমদানি কমার পর এখনো কমানো হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে এলসি খোলা কমেছে ১৪ শতাংশ। আমদানি কমেছে প্রায় সাড়ে ২৭ শতাংশ।