সারা দেশে গ্যাস সংকটে বেপরোয়া হয়ে পড়েছে সিলিন্ডার গ্যাস (এলপিজি) ব্যবসায়ীর। সময় সুযোগ এবং সুবিধামতো স্থানে সিলিন্ডার গ্যাসের দাম বাড়িয়ে নিচ্ছে অনেকে। এতে করে আরো বেশি দুর্ভোগে পড়েছে মানুষ। একদিকে লাইনের গ্যাস না পেয়েও মাসের শেষে বিল গুনতে হচ্ছে গ্রাহকদের। অপরদিকে গ্যাস সংকটের কারনে বাধ্য হয়ে বেশি দাম দিয়ে সিলিন্ডার গ্যাস কিনতে হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রান্নার চুলা জ্বালাতে না পেরে আবাসিক গ্রাহকেরা পড়েছেন বেশি ভোগান্তিতে। পাইপলাইনে গ্যাস না থাকায় আবাসিক গ্রাহকদের বাধ্য হয়ে এলপিজি সিলিন্ডার, ইলেকট্রিক চুলা (ইনডাকশন) ও লাকড়ির চুলা ব্যবহার করতে হচ্ছে। সুযোগটি ব্যবসায়ীরা হাতছাড়া করেননি। যথারীতি চাহিদা বাড়ায় গ্যাস সিলিন্ডার ও ইলেক্ট্রিক চুলার দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন তারা। জানা গেছে, সর্বশেষ গত ২ জানুয়ারি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১২ কেজির সিলিন্ডার গ্যাস ১৪০৪ টাকা নির্ধারন করা হয়। পাইপলাইনের গ্যাস সংকটের কারন সিলিন্ডার কেনা গ্রাহদের গুনতে হচ্ছে বেশি টাকা। দেশের বিভিন্ন স্থানভেদে প্রতি বোতল কোথাও ১শ থেকে ২শ টাকা আবার কোথায়ও আড়াশ থেকে ৩শ টাকা পর্যন্ত বেশি গুনতে হচ্ছে গ্রাহকদের।
রায়েরবাগ এলাকার বাসিন্দা গৃহিণী নিতু বেগম বলেন, গ্যাস না থাকায় অনেকটা বাধ্য হয়েই ইলেকট্রিক চুলা ব্যবহার করছি। এতে প্রতি মাসে বাড়তি ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা বিদ্যুৎ বিল দিতে হচ্ছে। আবার তিতাস গ্যাসকেও বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে। লাইনের গ্যাস সংকটের কারনে বাড়তি দাম দিয়ে সিলিন্ডার কিনতে হচ্ছে।
যাত্রাবাড়ি মিরহাজারী বাগ এলাকার বাসিন্দা গৃহিণী রেশমা জানান, গভীর রাতে গ্যাস এলেও সকাল ছয়টার আগে চলে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে বাড়তি টাকা দিয়ে গ্যাস সিলিন্ডার কিনতে হচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার উত্তর মাসদাইর এলাকার গৃহিণী বুলবুলি বেগম বলেন, গ্যাস নেই, এলপিজি কেনার সামর্থ্য নেই। তাই মাটির চুলায় রান্না করতে হয়। এমন দুর্ভোগ শুধু তাঁর একার নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
মিরপুর রাইনখোলা এলাকার বাসিন্দা আরাফাত হোসেন বলেন, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সকালে খেয়ে স্কুলে যেতে পারছে না। প্রতিদিনই বাইরে থেকে নাশতা কিনতে হচ্ছে। কিন্তু এভাবে কত দিন চলতে পারব। সবসময় বাইরে থেকে নাশতা কেনার সামর্থ্য নেই। খুব সীমিত আয়ে আমাদের দিন পার করতে হয়। এক বোতল (১২ কেজি) গ্যাস কিনলে বেশি দিন যায় না। বর্তমানে বোতল গ্যাসের দামও বাড়িয়ে দিয়েছে দোকনদারা।
সেগুন বাগিচার বাসিন্দা মান্নান বলেন, প্রতি বোতল গ্যাসের দাম (সিলিন্ডার গ্যাস) ১শ থেকে ২শ টাকা বেশি নিচ্ছে। আগে দিনে লাইনের গ্যাস কোনো না কোনো সময় মিললেও এখন সারাদিনই পাওয়া যাচ্ছে না। সকালে বাসা থেকে না খেয়ে বের হতে হয়। দুপুরেও বাসায় গিয়ে খেতে পারি না। রাতেরটা খেতে হয় ১২টায়। কিন্তু মাস শেষে ঠিকই বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে। বিল না দিলে আবার লাইন কেটে দেয়। এভাবে চলতে থাকলে রাস্তায় নামা ছাড়া উপায় থাকবে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে শুধু রাজধানীনয় আশে^ পাশে^র জেলাগুলোতে বাড়তি দামে সিলিন্ডার গ্যাস বিক্রির অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের তীব্র সঙ্কটে মানুষ সময়মতো রান্না করতে পারছেন না।
নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ আখড়া এলাকার সিঁথী রানী সাহা প্রতিদিন গভীর রাত ২টা পর্যন্ত জেগে থেকে রান্না করেন। কারণ দিনের বেলায় তো গ্যাস থাকেই না আর সন্ধ্যার পর যা থাকে তাতে রান্না চড়ানো যায় না। রাত ২টা অবধি রান্নার পর পরের দিন তিন বেলাতেই ছেলে মেয়ে আর পরিবারের লোকজনদের খেতে হয় ঠান্ডা খাবার।্
কাশীপুর বাংলাবাজারের বাসিন্দা জুয়েল আহমেদ বলেন, সারা দিন গ্যাস থাকে না। আগে কুপির মতো একটু জ্বলতো। তাতে টিপটিপ করে ভাতটা অন্তত ফুটতো। এখন তো তাও নাই। তিনি আরো বলেন,যেই বাড়িতে কাজে যাই সেইখানেও গ্যাস নাই।একজনের বাড়িতে এলপি গ্যাস আর আরেকজনের স্টোভ দিয়ে রান্না করি। তাগো ট্যাকা আছে তারা পারে, আমগোর জীবন কষ্টের! এদিকে গ্যাস সংকটে নিরসনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, পাইপলাইন দিয়ে ৩ বছরের মধ্যে ভোলার গ্যাস মূল ভূ-খন্ডে নেওয়া হবে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ সকল উৎস হতে দেশীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম আরও জোরদার করা হবে। গতকাল বৃহস্পতিবার দ্বীপ জেলা ভোলার বোরহানউদ্দিনে শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র পরিদর্শন করে এসব কথা বলেন প্রতিমন্ত্রী।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যে পেট্রোবাংলা ৪৬টি কূপ খনন, পুনঃখননের কার্যক্রম শুরু করেছে। যা থেকে ৬১২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা হবে। ২০২৩ সালে এই কার্যক্রমের আওতায় এরইমধ্যে ১১২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে এবং এই কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
তিনি বলেন, ভোলা দ্বীপ একটি গ্যাস সমৃদ্ধ অঞ্চল। এখানে আরও ৯টি অনুসন্ধান কূপ খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ভোলার নদী এলাকায় দ্বিমাত্রিক ভূকম্পণ জরিপ করা হবে। তিনি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভোলায় শিল্প গ্যাস সংযোগ দিয়ে ভোলায় কর্মসংস্থান সৃষ্টির গুরুত্বারোপ করেন। বর্তমানে ভোলা থেকে সিএনজি করে দৈনিক ৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দেশের মূল ভূ-খন্ডের শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য নেওয়া হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে তা ২৫ মিলিয়ন ঘনফুটে উন্নীত করা হবে বলে জানান তিনি।