আমি আজকের কলাম নিয়ে কিছুটা মুশকিলে আছি। কারণ এই কলামটি প্রকাশিত হবে ১৭ ডিসেম্বর রোববার। অথচ লেখা শুরু করেছি ১৫ ডিসেম্বর শুক্রবার। অথচ এখনও প্রার্থীতা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা সম্পর্কে পরিষ্কার কোনো চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না। শুরুতেই বলে রাখতে চাই যে এটি কোনো নির্বাচনই হচ্ছে না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের যত বই পুস্তক আছে তার কোথাও এই ধরনের আজব নির্বাচনের নজির পাওয়া যায় না। ড. আলী রিয়াজ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের যেসব সুশীল আছেন তারাসহ আমিও সম্পূর্ণ একমত যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কোনো সংজ্ঞাতেই এটি নির্বাচনের পর্যায়ে পড়ে না। আজ আমি সংবিধান বা অন্যকোনো পত্র পত্রিকা বা বই পুস্তকের রেফারেন্স দেবো না। কারণ গত ৩০ নভেম্বরের পর থেকে ইলেকশনের নামে যেসব কান্ড কীর্তি হচ্ছে সেগুলোকে একটি বিরাট তামাশা, সার্কাস বা প্রহসন ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। যারা বেশি লেখা পড়া জানেন না তারা পর্যন্ত বলছেন যে, এই ধরনের অদ্ভুত নির্বাচনের নাটক না করে সরকার সিইসি হাবিবুল আউয়ালের হাতে ৩০০ ব্যক্তির একটি তালিকা ধরিয়ে দিক। হাবিবুল আউয়াল সাহেব ৭ই জানুয়ারি আসার আগেই ঘোষণা করে দিন যে, এই ৩০০ ব্যক্তি এমপি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। আরও ভাল হবে যদি তিনি বলেন, এই ৩০০ ব্যক্তি ইলেক্টেড নয়, সিলেক্টেড হয়েছেন। তাই এটিকে নির্বাচন বা ইলেকশন না বলে সিলেকশন বললেই সবচেয়ে ভাল হতো। ইলেকশনের নামে তামাশার এই বিরাট নাটকের কয়েকটি দিক একটু পরে বলছি। তার আগে সিইসি হাবিবুল আউয়াল এটা কী করেছেন? ১৭ ডিসেম্বরের পর অর্থাৎ ১৮ ডিসেম্বর থেকে শুধুমাত্র নির্বাচনী প্রচারণা ছাড়া অন্যকোনো প্রচারণা ও রাজনৈতিক তৎপরতা চালানো যাবে না। এই মর্মে নির্দেশ জারির জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তিনি অনুরোধ করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তথা আওয়ামী সরকার এই ধরনের একটি মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষাতেই বসে ছিল। যেই সিইসি উপরোক্ত মর্মে চিঠি দিয়েছেন সাথে সাথে সরকার সেটি লুফে নিয়েছে। অতঃপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ফরমান জারি করা হয়েছে যে, ১৮ ডিসেম্বর থেকে নির্বাচনী প্রচারণা ছাড়া অন্য সবরকম রাজনৈতিক প্রচারণা ও রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো।
এসম্পর্কে আমরা আর কী বলবো? সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব) সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, “এর আগে কোনো নির্বাচনের আগে এমন পরিস্থিতি আমি দেখিনি। এমনকি ২০১৪ সালের দিকে যখন দেশের সার্বিক পরিস্থিতি এর চেয়েও নাজুক ছিল তখনো এমন অবস্থা দেখা যায়নি। এর আগে কোনো কমিশন কোনো সরকারকে এই ধরনের অনুরোধ করেছে কিনা, তা আমরা জানি না। নির্বাচনের সময়ে যারা থাকেন, তারা কেবল রুটিন কাজ করবেন। এটাই বলা আছে। রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হবে কি হবে না, কাকে আটক করবে, কাকে বাধা দেবে, কাকে মুক্ত করবে এটা তাদেরই করার কথা। কিন্তু কমিশন নিজে থেকে কেন এটা করতে গেল তা আমার বোধগম্য নয়। এখন সরকার বলার সুযোগ পাবে যে, নির্বাচন কমিশন আমাদের বলেছে, তাই আমরা করেছি। এখন সভা-সমাবেশের যে অধিকার সেটি কীভাবে নিশ্চিত করা হবে? শহরাঞ্চলে বা উপজেলা পর্যায়ে যদি আমরা দেখি তাহলে এই অধিকারটি কীভাবে নিশ্চিত করা হবে? কমিশন এই দায় কেন নিলো! অতীতে এমন ঘটনা তো ঘটেনি। কমিশন নিজেই সরকারকে একটি সুযোগ দিলো। সরকার সেটি লুফে নিয়েছে।”
সুপ্রিম কোর্টের এ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ একজন নিরপেক্ষ মানুষ। তিনি সাধারণত জনহিতকর বিষয় নিয়ে কেস করেন। অনেক ক্ষেত্রে তাকে সুয়োমুটো মামলা করতে দেখা যায়। এহেন একজন নিরপেক্ষ মানুষও বলেছেন, “নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্ত থেকে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় যে, এটি একটি বিশেষ দলকে যারা ক্ষমতায় রয়েছে তাদের সুবিধা দিতেই দেয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে, অনেক রাজনৈতিক দল তার বিরোধিতা করছে। তারা দাবি আদায়ে রাস্তায় রয়েছে, সভা-সমাবেশ করছে। এখন এই সভা-সমাবেশের অধিকার তো সাংবিধানিক। সংবিধান নাগরিককে এই অধিকার দিয়েছে। এখন এভাবে সভা-সমাবেশের অধিকার বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়া সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।”
ড. শাহ্ দ্বীন মালিক একজন সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী। তিনি সাফ বলে দিয়েছেন, “কথা হলো, এটা কোনো আইন নয়, বিধান। অতীতে যদি এমনটা না ঘটে থাকে তাহলে এটাকে ‘বিশেষ ব্যবস্থা’ বলা যায়।”
॥ দুই ॥
প্রিয় পাঠক, আমরা আর এ ব্যাপারে নিজস্ব কোনো মন্তব্য দিলাম না। কী বলবো? ভারত ভাগ হয়েছে ৭৬ বছর আগে। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের আলোচ্য সময়টি ছাড়া কোনোদিন ইলেকশনের আগে এই ধরনের হুকুম জারি করতে দেখা যায়নি। ইলেকশনে ভোট চাওয়া যেমন কোনো রাজনৈতিক দল বা তার প্রার্থীর মৌলিক অধিকার, তেমনি এই ইলেকশনে আপনারা ভোট দিতে যাবেন না, সেটি বলাও একটি রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার।
অন্য সব সময়ের কথা বাদ দেই। যতদিন বাংলাদেশ পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে ছিল তার শেষ দুই বছর দেশটি ছিল জেনারেল ইয়াহিয়া খানের মার্শাল ‘ল’ এর আন্ডারে। সামরিক শাসনের অধীনেই ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচন দিয়েছিলেন। তখন ভাসানী পন্থী ন্যাপ এই ভোট বর্জন করে। তখন মেনন, কাজী জাফর প্রমুখ নেতা ভাসানী ন্যাপ করতেন। সেই মওলানা ভাসানী স্বয়ং এবং তার অন্য নেতারা শ্লোগান দিয়েছিলেন, “পেটে আর অন্ন নাই/ভোটের আগে ভাত চাই”। তারা আরও শ্লোগান দিয়েছিলেন, “ভোটের বাক্সে লাথি মারো/বাংলাদেশ স্বাধীন করো”। কই, ইলেকশনের বিরুদ্ধে এরকম মারমুখী মনোভাব নিয়ে মওলানা ভাসানী এবং তার নেতাকর্মীরা মাঠে নেমেছিলেন। তারপরেও তো নির্বাচন বিরোধী প্রচারণার বিরুদ্ধে কোনো আইন করা হয়নি, কোনো ফরমান জারি করা হয়নি বা নির্বাচন বিরোধী আন্দোলনের জন্য কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। সেজন্যই প্রথমে বলেছিলাম যে, এবারের ইলেকশনে যেসব কান্ড কীর্তি হচ্ছে সেগুলো বাংলাদেশে কেন, বিশে^র কোথাও ঘটেনি।
॥ তিন ॥
ইলেকশন মানেই তো ভোট, একাধিক প্রার্থীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ইত্যাদি। জনগণের ভোট ছাড়া যদি পার্লামেন্টে মেজরিটি সদস্য নির্বাচিত হন তাহলে সেটিকে কোনো অবস্থাতেই নির্বাচন বলা যায় না। ২০১৪ সালে এরকম একটি ঘটনা ঘটেছিল। তখন ১৫৩ জন সদস্য কোনোরূপ ভোটাভুটি ছাড়াই এমপি হয়েছিলেন। এবার যা হতে যাচ্ছে তা আরেক কাঠি সরেস। গত রোববার বলেছি যে, এটি হচ্ছে আমাদের আর মামুদের নির্বাচন। ইলেকশনের আগেই আওয়ামী লীগের সাথে বিভিন্ন দলের দেন দরবার চলছে, কোন্ দলকে কতগুলো আসন দেওয়া হবে। এটি বানরের পিঠা ভাগের মতো ব্যাপার। এখানে বড় তরফ হলো আওয়ামী লীগ। বড় তরফ অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ঠিক করে দেবে যে ছোট তরফ অর্থাৎ বিরোধী দল কোন্ পার্টি হবে। বড় তরফ এটিও ঠিক করে দেবে যে তারা যেভাবে বিরোধী দল ঠিক করবে সেই বিরোধী দলের সংখ্যা কত হবে এবং কোন্ কোন্ ব্যক্তিকে নিয়ে সংসদে বিরোধী দল গঠিত হবে। প্রিয় পাঠক, আপনারা কি কোনো দিন এইভাবে সংসদে বিরোধী দল গঠিত হওয়া দেখেছেন? আমি আমার সুদীর্ঘ জীবনে দেখিনি।
শুধুমাত্র জাতীয় পার্টির কথাই বা বলি কেন, আর যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে তারাও সকলে বড় তরফের একটি মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। বাগানে অনেকগুলো সূর্যমুখী ফুল ফোটে। কিন্তু আপনারা নিশ্চয়ই দেখেছেন যে, সবগুলো সূর্যমুখী ফুল সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। ইংরেজিতে এই ফুলের নাম সানফ্লাওয়ার রাখা হলেও বাংলাতে এর নাম সূর্যমুখী ফুল। এখন বাংলাদেশের ইলেকশনে দেখা যাচ্ছে জাতীয় পার্টি, মেনন, ইনু, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, তরিকত ফেডারেশন, তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনএম), বিএসপি ইত্যাদি পার্টির নাম পত্র পত্রিকায় দেখা যাচ্ছে যারা এই ইলেকশনে অংশগ্রহণ করছে। মজার ব্যাপার হলো, জিএম কাদের জাতীয় পার্টির বর্তমান চেয়ারম্যান হলেও অপর অংশের নেতা রওশন এরশাদকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জরুরী তলব দিয়ে ডেকেছিলেন। আর রওশন এরশাদও প্রধানমন্ত্রীর কাছে নালিশ করেছেন। নালিশ করেছেন কীভাবে তাকে এবং তার পুত্র সাদ এরশাদকে নমিনেশন থেকে তার দেবর জিএম কাদের বঞ্চিত করেছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে আরো অনুরোধ করেছেন যে, জিএম কাদেরের উপদলের সাথে আসন ভাগাভাগি নিয়ে আওয়ামী লীগ যেন দরবার না করে।
॥ চার ॥
শুধুমাত্র রাজনীতি নয়, বাংলাদেশের নির্বাচনেরও কত অধপতন হয়েছে যে তথাকথিত বিরোধী দল তাদের অভ্যন্তরীণ গোলযোগ মিটকুট করার জন্য সরকারি দলের নেতার কাছে নালিশ করে। অথচ সরকারের বিরুদ্ধেই রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিচালনা করাটাই হলো বিরোধী দলের প্রধান কাজ। শুক্রবারের পত্র পত্রিকায় দেখা গেল, মেননের পার্টিকে নাকি ৩ টি এবং ইনুর পার্টিকেও নাকি ৩ টি আসন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার পরেও ইনু এবং মেননের গোস্বা কমেনি। তারা বেশি করে আসন চান। তাদের অনুকূলে শুধুমাত্র নৌকা মার্কা প্রার্থীকে প্রত্যাহার করলেই চলবে না, স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরকেও প্রত্যাহার করতে হবে। তাদের এমন মামা বাড়ির আবদার বড় তরফ নাকি শোনেনি। ইংরেজি ডেইলি নিউ এজ শুক্রবার তাদের লিড নিউজে হেডিং করেছে, মেনন ও ইনুকে ৩ টি করে সিট দেওয়া হয়েছে। জাতীয় পার্টিকে অপেক্ষায় রাখা হয়েছে।
এসব খবর শোনারও প্রবৃত্তি হয় না। আর এর ওপর লেখা তো পরের কথা। সমশের মবিন, তৈমুর আলম, মাইজভান্ডারি প্রমুখ (অন্যদের নাম জানি না) তাকিয়ে আছেন, কার ভাগ্যে কয়টি শিকা ছেঁড়ে।
বাংলাদেশে এবার ইলেকশন নামীয় সার্কাস দেখে মরহুম আব্দুল আলিমের ঐ গানটির কথা মনে পড়লো, ‘তুমি হাকিম হইয়া হুকুম করো / পুলিশ হইয়া ধরো’।
Email: asifarsalan15@gmail.com