নতুন মূল্য নির্ধারণের দাবিতে গত শুক্রবার থেকে হাসপাতালে স্টেন্ট (হার্টের রিং) সরবরাহ বন্ধ রেখেছে আমদানিকারক ও সরবরাহকারীদের বড় অংশ। এতে রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে রোগীদের ব্লকের পরিমাপ অনুযায়ী রিংয়ের সংকট দেখা দিয়েছে। এ কারণে অনেক রোগী হাসপাতাল থেকে ফেরত যাচ্ছে।
হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও হাসপাতালসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে বিভিন্ন হাসপাতালে ব্যবহৃত হচ্ছে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের তিন কম্পানির রিং।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ২০ থেকে ৪০ মিলিমিটার দৈর্ঘ্যের রিং। অন্য কম্পানির রিং সরবরাহ বন্ধ থাকায় রোগীর ব্লকের পরিমাপ অনুযায়ী এসব রিং পাওয়া যাচ্ছে না।
দেশে হার্টের রিংয়ের নতুন খুচরা মূল্য ১২ ডিসেম্বর নির্ধারণ করে ঔষধ প্রশাসন। কিন্তু এই নতুন দাম নিয়ে আপত্তি দেখা দিয়েছে ইউরোপীয় রিং আমদানিকারক ও সরবরাহকারীদের মধ্যে।
তাই তারা হাসাপাতালে রিং সরবরাহ বন্ধ রেখেছে। বর্তমানে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ব্যবহৃত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের তিন কম্পানির রিং।
গতকাল রবিবার রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে আসা রোগীর স্বজন ও চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য জানা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের একজন চিকিৎসক কালের কণ্ঠকে বলেন, ব্লকের পরিমাপমতো রিং না পাওয়ায় অস্ত্রোপচারের কক্ষ থেকে আজ (গতকাল) এক রোগীকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, সিরাজগঞ্জ থেকে আসা ওই রোগীর এনজিওগ্রাম করা হলে তাঁর হার্টে ব্লক ধরা পড়ে। পরে হার্টের ব্লক সারাতে তাঁকে অস্ত্রোপচারকক্ষে নেওয়া হয়। তবে ব্লকের পরিমাপমতো রিং না থাকায় কয়েক দিন পর হাসপাতালে যোগাযোগ করতে বলা হয়।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালটিতে প্রতিদিন গড়ে ৩০ জনের হার্টের রিং পরানো হয়। গতকাল অন্তত ছয়জনকে এই একই কারণে ফেরত পাঠাতে হয়েছে।
তারা ঢাকার বাইরের রোগী।
রিংয়ের মূল্যবৃদ্ধির দাবির পক্ষে থাকা আমদানিকারক ও সরবরাহকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিক্যাল ডিভাইস ইমপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের একাংশ জানিয়েছে, আজ তারা সারা দেশে রিং সরবরাহ বন্ধ রেখেছে। তবে সংকটাপন্ন রোগীর ক্ষেত্রে হাসপাতালে থাকা রিং ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। তারা বলছে, আবার দাম নির্ধারণ না হওয়া পর্যন্ত তারা সরবরাহ বন্ধ রাখবে।
তবে এ বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও উপপরিচালক নুরুল আলম বলেন, আলোচনার বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ইউরোপীয় কম্পানিগুলোর প্রতিনিধিরা চাইলে আলোচনায় বসে এর সমস্যা সমাধান করতে পারেন।
নুরুল আলম আরো বলেন, ‘তাঁরা তো দীর্ঘদিন ব্যবসা করে আসছেন। ভারত থেকে বাংলাদেশে দাম বেশি কেন? ভারত যদি পারে, আমাদের দেশের আমদানিকারকরা কেন তাঁদের মাদার কম্পানি থেকে কম দামে হার্টের রিং সরবরাহ করতে পারেন না? আমি আশা করি, আমদানিকারকরা যেন দেশের মানুষের কথা ভেবে মাদার কম্পানির সঙ্গে আলোচনা করেন।’
ঔষধ প্রশাসনের তথ্য মতে, দেশে হার্টের রিং আমদানির অনুমতি রয়েছে ২৭টি কম্পানির। এর মধ্যে তিনটি যুক্তরাষ্ট্রের। অন্য দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে জার্মানি, পোল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ড, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত প্রভৃতি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের রিং প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাবোট ভাসকুলার, বোস্টন সায়েন্টিফিক ও মেডট্রোনিকের রিং বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে সরবরাহ রয়েছে।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিন বলেন, রিং সরবরাহ বন্ধ রাখায় এক দিনে তো প্রভাব পড়বে না। তবে এর সমাধান প্রয়োজন। তা না হলে সামনের দিনগুলোতে সংকট প্রকট আকার ধারণ করবে। ঔষধ প্রশাসনের উচিত তাদের সিদ্ধান্তের বিষয়ে আমদানিকারকদের জানানো।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী বলেন, ‘রিং সরবরাহ বন্ধ থাকলে সারা দেশেই সমস্যা দেখা দেবে এবং রোগীদের ভোগান্তি হবে। কারণ দাম কমার কারণে স্বাভাবিকভাবেই চাহিদাও বাড়বে। তবে আমাদের একটু ধৈর্য ধরতে হবে। কারণ আমরা অনেক চেষ্টা করে দাম এই পর্যায়ে এনেছি। কম্পানিগুলোর হুমকিতে আমাদের রাজি হয়ে যাওয়া ঠিক হবে না।’
https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/12/18/1346655