বাজারে ডলারের সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করেছে। বৈদেশিক দায় নিয়মিত শোধ করা যাচ্ছে না। বেশি দাম দিয়েও ডলার মিলছে না। দায় শোধ করতে না পারায় বাড়তি সুদসহ দণ্ড সুদ দিতে হচ্ছে। এমনি পরিস্থিতিতে ডলারের দাম ৫০ পয়সা কমানোর ঘোষণা দিয়েছে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা)। আর বাফেদার সিদ্ধান্তকে সঠিক মনে করে সংবাদ সম্মেলন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়েছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো: মেজবাউল হক। তিনি বলেন, নানাভাবে ডলারের চাহিদা কমিয়ে এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ কারণে বাফেদা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা সময়োপযোগী বলে মনে করছেন তিনি। তিনি বলেন, দেশের ৬০টি ব্যাংকের মধ্যে ২১টি ব্যাংকের ডলার সঙ্কট রয়েছে। ওই সব ব্যাংকের গ্রাহক চাইলেও চাহিদা অনুযায়ী ঋণপত্র খুলতে পারছেন না। তাই তারা বাধ্য হয়ে অন্য ব্যাংকের শরণাপন্ন হচ্ছেন। এ কারণেই কখনো কখনো অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে ডলারের বাজারে।
গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল ভবনের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স হলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে মুখপাত্র মো: মেজবাউল হক এসব কথা বলেন। এ সময় রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ করা হবে কি না এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে সরকার তার প্রয়োজনে ডলার নেয়। প্রয়োজন হলে দেশের স্বার্থে সেটি দিতেই হবে। বন্ধ করার কোনো সুযোগ নেই।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মুখপাত্র জানান, আমাদের বেশির ভাগ ব্যাংকের কাছেই প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ডলার আছে। পক্ষান্তরে সঙ্কটেও রয়েছে কিছু ব্যাংক। যেহেতু আস্তে আস্তে ডলার বাজার স্বাভাবিক হচ্ছে এখন বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ করবে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে মেজবাউল হক বলেন, দেশের ডলার খরচের মূল খাত হলো দু’টি। আমদানি মূল্য পরিশোধ করা এবং অন্যটি সেবামূল্য পরিশোধ। দুই জায়গাতেই আমরা চাহিদা কমাতে সক্ষম হয়েছি। ইতোমধ্যে আমাদের ডলার পরিশোধের পরিমাণ অর্ধেকে নেমে এসেছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে মাসিক ডলার পরিশোধ নেমে ৪৯ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। কারণ আমরা অলরেডি বেশ কিছু পণ্য আমদানিতে সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছি। পাশাপাশি এখন দীর্ঘমেয়াদি ঋণপত্র খোলার হার কমে গেছে। ব্যবসায়ীরা এখন যেসব ঋণপত্র খুলছেন তার বেশির ভাগই অ্যাট সাইট এলসি বা তাৎক্ষণিক। তাই খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ডলার সঙ্কটের পাশাপাশি দেশের মূল্যস্ফীতি ও নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে বলে আশা ব্যক্ত করেন তিনি।
ডলার কারসাজির বিষয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে কি না জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, বাজার তদারকি বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মিত কাজ। এটা চলতেই থাকবে। ইতঃপূর্বে আমরা একাধিক ব্যাংককে জরিমানা ও শাস্তির আওতায় এনেছি। অনেকগুলো এক্সচেঞ্জ হাউজের লাইসেন্স বাতিল করেছি। সুতরাং আমরা সবসময় অনিয়ম তদারতকি করছি। ভাবিষ্যতেও করব।
গত বছর প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ডলার সংরক্ষণ করে দর বৃদ্ধির প্রমাণ পাওয়ায় ছয় ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে অপসারণের নির্দেশ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে পাঁচটি দেশী এবং একটি বিদেশী ব্যাংক। দেশী পাঁচ ব্যাংক হচ্ছে- ব্র্যাক ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, প্রাইম ও সাউথইস্ট ব্যাংক। আর বিদেশী ব্যাংকটি হচ্ছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। তবে পরে ছয় ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক যে ব্যবস্থা নিয়েছিল তা প্রত্যাহার করা হয়েছে।
তবে ডলারের দাম কমানো হলেও বাস্তবে এর কোনো প্রতি ফলন হবে না বলে মনে করেন ব্যাংকাররা। তারা জানিয়েছেন, বাজারে ডলারের সঙ্কট প্রকট। বৈদেশিক দায় নিয়মিত শোধ করা যাচ্ছে না। বেশি দাম দিয়েও ডলার মিলছে না। দায় শোধ করতে না পারায় বাড়তি সুদসহ দণ্ড সুদ দিতে হচ্ছে। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী ডলারের দামে একক দর এখন কার্যকর হচ্ছে না। বাফেদা ও এবিবির বেঁধে দেয়া দরে ডলার বেচাকেনা হচ্ছে না। বাজারের নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রণয়ন করা নীতি কাজ করছে না। তারা বলেছেন, ডলারের দাম কমানো হলেও বাজারে তা কার্যকর হবে কতটুকু তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ বর্তমানে ডলারের যে দাম চালু রয়েছে সেগুলোই এখন কার্যকর হচ্ছে না। ব্যাংকাররা নানা ফাঁকফোকর দিয়ে ডলারের দাম বেশি রাখছে। তারা বলেন, রেমিট্যান্স সংগ্রহের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে এখন তীব্র প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। ডলারের দাম কমানো হলে রেমিট্যান্স পাওয়া যাবে না। যেখানে দাম বেশি পাবে সেখানে চলে যাবে। ফলে ব্যাংক চ্যানেলে রেমিট্যান্স কমে যেতে পারে। নিকট অতীতে দেখা গেছে, রেমিট্যান্সের ডলারের দাম কমানো হলে ব্যাংক চ্যানেলে এর প্রবাহ কমে যায়। আবার দাম বাড়ালে বেড়ে যায়। ফলে এ ক্ষেত্রে খুব সতর্কতার সাথে পদক্ষেপ নিতে হবে।