বিএনপি-জামায়াত অগ্নিসন্ত্রাসী দল বলে অবিরাম অভিযোগ করে আসছে সরকার। তাদের শরীর থেকে পোড়া মানুষের গন্ধ পাওয়া যায়। যারা মানুষ পুড়িয়ে মারে, তাদের সঙ্গে কিসের সংলাপ? এমন কথা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে তথ্য প্রমাণসহ দেখানো হয়েছে, বিরোধী দল এই আগুন সন্ত্রাসের জন্য দায়ী নয়। বরং সরকারি দলের লোকেরাই বিভিন্ন স্থানে আগুন দিয়ে পুলিশের সহযোগিতায় পালিয়ে যায়। তারা আসেই পুলিশের সামনে দিয়ে আগুন দিয়ে চলেও যায় পুলিশের সামনে দিয়ে। কিন্তু পুলিশ তাদের আটক করার কোনো চেষ্টাও করে না।
যারা আগুন সন্ত্রাসের জন্য সবসময় বিরোধী দলকে দায়ী করে আসছিলেন তারা সরকার দলের আগুন সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেন না।
তবে তথাকথিত আগুন সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে এমন হুঁশিয়ারি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যা শুনে রক্ত হিম হয়ে আসে। সেটা হলো, যারা আগুন দেয়, তাদের ধরে সেই আগুনে নিক্ষেপ করতে হবে। যে হাত আগুন দেয় সে হাত পুড়িয়ে দিতে হবে। সে উদ্দেশ্যেই কিনা বলতে পারব না, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পাড়ায়-পাড়ায়, মহল্লায়-মহল্লায় যারা বিএনপি করে তাদের চিহ্নিত করতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো চিহ্নিত করে কী করবেন, নিজেরা আগুন দিয়ে সে আগুনে কী তাদের নিক্ষেপ করবেন?
এ রকম একটা অবস্থায় পাড়ায়-পাড়ায়, মহল্লায়-মহল্লায়, গ্রামে-গঞ্জে লাখ লাখ লোকের জীবন বিপন্ন হতে পারে। হতে পারে হানাহানি, শুরু হয়ে যেতে পারে ব্যাপক রক্তপাত। এ অস্থায় যদি প্রহসনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ও, তবে তা শান্তি তো আনতেই পারবে না, ঘরে ঘরে শুরু হবে হানাহানি। এর আগে বছরের পর বছর আওয়ামী লীগ প্রচার করেছে যে, বিএনপি-জামায়াত সন্ত্রাসী দল। কিন্তু তা কখনো প্রমাণিত হয়নি। তবে আওয়ামী লীগ এবারও সে কার্ড খেলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সে অপচেষ্টা হালে পানি পায়নি। এবার সন্ত্রাসী-সন্ত্রাসী জজবা অনেকখানি কমে এসেছে। সারাদেশে বিএনপির লোকদের চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে তাদের নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা হচ্ছে কিনা, তা নিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হচ্ছে।
বিরোধী দলের বর্তমান আন্দোলনকালেও যানবাহনে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। যাত্রাবাড়ি এলাকায় একটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। বাস চালক জানান, তিনি যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে গাড়িটি ঘুরিয়ে নিচ্ছিলেন। তখন একটি মোটর সাইকেলে তিনজন যুবক আসে। তারা দ্রুত বাসে উঠে আগুন দিয়ে ডজন-ডজন পুলিশের সামনে দিয়ে চলে যায়। পুলিশ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে। গাড়ি চালককে সাংবাবিদকরা জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, আপনি পুলিশকে বললেন না কেন? জবাবে গাড়ি চালক বলেন, পুলিশকে কী বলব, পুলিশের সামনে দিয়েই তো তারা চলে গেল। এভাবেই আগুন সন্ত্রাস পরিচালিত হচ্ছে।
গত ১৪ নবেম্বর নাটোরে ঘটেছে এমন একটি ঘটনা। মুখোশ, মশাল ও মোটর সাইকেলসহ তাসরিক জামান ওরফে রিফাত (২৪) নামের ছাত্রলীগের এক সাবেক নেতাকে আটক করে পুলিশ। নাশকতা করার প্রস্তুতি নেওয়ার অভিযোগে মঙ্গলবার রাতে সদর থানার পুলিশ তাকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। এ সময় সেখানে নাটোর-২ আসনের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।
আটক তাসরিফ জামান ২০২২ সালের ২ এপ্রিল গঠিত নাটোর পৌর ছাত্র লীগের সভাপতি ছিলেন। পরে ঐ কমিটি স্থগিত করা হয়। তিনি হাফরাস্তা এলাকার নাটোর থানা ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে সদর থানার ওসি নাসিম আহম্মেদের নেতৃত্বে হাফরাস্তা এলাকার একটি বাড়ির সামেন থেকে তাশরিককে আটক করে।
এ সময় নাটোর-২ আসনের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম লোকজনকে বলেন, তাশরিক বিএনপির লোক। তিনি উপস্থিত লোকজনকে বলেন, তাশরিক বিএনপির লোক। তিনি শহরের বুধবারের অবরোধ কর্মসূচি উপলক্ষে নাশকতা সৃষ্টির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। খবর পেয়ে সংসদ সদস্য পুলিশ ও প্রশাসনকে জানিয়ে ঘটনাস্থলে আসেন বলে জানান।
পুলিশ তখন হাতকড়া পরিয়ে তাশরিককে গাড়িতে ওঠায়। তখন তিনি ফেসবুক লাইভে বলেন, ‘আমি ৭ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। আমি একটি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এটা তো অপরাধ হতে পারে না। এ ঘটনার ছবিসহ একটি ভিডিও, নাটোর পৌর ছাত্রলীগের কমিটি ও জেলা ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে তোলা তাশরিকের কিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হতে শুরু করে।
আটক তাশরিকের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পরিবারের সদস্যদের সবাই থানায় অবস্থান করছেন। আশপাশের লোকজনও এ ব্যাপারে কথা বলতে রাজি হননি। তাশরিকের বাবা মুঠোফোনে বলেন, তার ছেলে ৭নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। সে কেন নাশকতার প্রস্তুতি নিতে যাবে? এসব ষড়যন্ত্র। দলের একটি পক্ষ তাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ছাত্রলীগের সঙ্গে তাশরিকের কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানান।
থানার ওসি নাসিম আহম্মেদ মুঠো ফোনে জানান, ঘটনাস্থলে তিন তরুণ নাশকতার প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন খবর পেয়ে তারা ঘটনাস্থলে যান। ঘটনাস্থলে তাশরিক দাঁড়িয়ে ছিলেন। সন্দেহ হওয়ায় তাকে নিয়ে পাশের একটি বাড়ি তল্লাশি করা হয়। সেই বাড়ির একটি পরিত্যক্ত ঘর থেকে ৩টি মুখোশ, ৬টি মশাল ও একটি মোটর সাইকেল জব্দ করা হয়। পরে খোঁজখবর নিয়ে পুলিশ নিশ্চিত হয় যে, সে ছাত্রলীগ নেতা। তাই তাকে তার পরিবারের জিম্মায় ছেড়ে দেয়া হয়।
যানবাহনে আগুন দিতে যা যা লাগে তার সবই পাওয়া যায় তাশরিকের কাছ থেকে। মুখোশ ছিল নিজেকে আড়াল করার জন্য। মশাল ছিল গাড়িতে আগুন দেয়ার জন্য। আর মোটরসাইকল ছিল দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করার জন্য। তখন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। রাত্রি আরও একটু গভীর হলে তিনি হয়তো কোনো গাড়িতে আগুন দিতেন। এটা তো প্রমাণিত হলো যে, তিনি সত্যি সত্যি ছাত্রলীগ করতেন। আর সে কারণেই পুলিশ তাকে ছেড়ে দিল এবং তাকে কোনোরূপ জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়নি।
যদি তাশরিকের জায়গায় এখানে অন্য কেউ থাকত, কিংবা থাকতো কোনো বিএনপি কর্মী, তবে কি তাকে ছেড়ে দিত পুলিশ? নাকি ঢেড়া বাজিয়ে সকলকে জানান দিত যে, বিএনপি বাসে আগুন দিতে যাচ্ছিল। সে ক্ষেত্রে শুধু ছাত্রদল বা বিএনপি কর্মী নয়, সম্ভবত তার গোটা পরিবারকেই আটক করে থানায় নিয়ে আসা হতো। আর কয়েকটা নাম উল্লেখ করে শত শত অজ্ঞাত বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হতো।
সারাদেশে এভাবেই ঘটছে অগ্নিসংযোগের ঘটনা। কাকে আগুনে নিক্ষেপ করবে সরকার?