আশঙ্কাজনক হারে কৃষি জমি হ্রাসের ফলে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরায় আমন চাষ কম হচ্ছে। এছাড়া নতুন করে হরতাল অবরোধের কারণে বিরোধীদল দমনে গায়েবী মামলার আসামী হওয়ায় অনেক কৃষক তাদের ক্ষেতে যেতে পারছে না। এতে শ্রমিক সংকট ও তীব্র হচ্ছে। মহিলা শ্রমিক দিয়ে আমন ধান সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছে তারা। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে বিগত ২৩ বছরে জেলায় সাড়ে ৮ হাজার হেক্টর আবাদযোগ্য জমি হ্রাস পেয়েছে। একই সময়ে সারা দেশে ৬ শতাংশ কৃষি জমি হ্রাস পেলেও খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ একই সময়ে উপকূলীয় অঞ্চলে ৩৩ হাজার টন খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। ২০১৫-১৬ মৌসুমে জেলায় আমনের আবাদ হয়ে ছিল ৯৪ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে। সেখানে চলতি ২০২৩-২৪ মৌসুমে জেলাতে ৮৮ হাজার ৭৬৮ হেক্টর জমিতে রোপা আমন চাষ করা হয়েছে। যা গত মৌসুমের তুলনায় ২৪৩ হেক্টর পরিমান কম। গেল মৌসুমে জেলায় রোপা আমনের আবাদ হয়েছিলো ৮৮ হাজার ৫২৫ হেক্টর জমিতে। ফলে গত ৮ বছরে জেলাতে আমন চাষ হ্রাস পেয়েছে ৫ হাজার ৬৭৫ হেক্টর মজিতে। ঐতিহ্যতগ ভাবে আমন মৌসুমে ধান সংগ্রহ নিয়ে কৃষক কৃষাণীদের মধ্যে যে আমেজ ছিল তা এখন আর দেখা যায় না। নেই নবান্নের উৎসব। এর পরও শস্য ভান্ডার সাতক্ষীরার কৃষকরা তাদের স্বপ্ন সাধ পুরনে ব্যস্ত, অবিরাম, ক্লান্তহীন ভাবে কেটে চলেছে আমন ধান। সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুরোদমে চলছে ধানকাটা, গোছানো। মহা ব্যস্ততায় কৃষকরা। কাকডাকা ভোরে আবার কেউ কেউ সকালে গাতার খেয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত ধান কেটেই চলেছে।
৩ হাজার ৮৫৮ দশমিক ৩৩ বর্গ কিলোমিটার আয়তনে ২২ লাখ মানুষের বসবাস রত জেলাটিতে খাদ্য ঘাটতির আশংঙ্কা দিন দিন বাড়ছে। সাতক্ষীরা পরিসংখ্যান অফিসের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় এখন কৃষি খানার সংখ্যা ৫ লাখ ১৪ হাজার ৩৬৬, যাদের অধীন আবাদি জমি রয়েছে ২ লাখ ৭১ হাজার ৪৭০ একর। ২০০৮ সালের কৃষিশুমারি অনুযায়ী জেলায় কৃষি খানার সংখ্যা ছিলো ৪ লাখ ৩৬ হাজার ১৭৮, যাদের অধীন আবাদি জমি ছিলো ২ লাখ ৮০ হাজার ৭৩০ একর। সেই হিসাবে ১২ বছরের ব্যবধানে সাতক্ষীরা মোট আবাদি জমির পরিমাণ কমেছে ৯ হাজার ২৬০ একর। অন্যদিকে কৃষি খানার বৃদ্ধি পেয়েছে এক লাখ ৬৪ হাজার ৭০৮। ২০০৮ সালের পর ২০১৯ সালে কৃষিশুমারি হয়। তবে বেসরকারি হিসেবে কৃষি জমি হ্রাসের পরিমান আরো অনেক বেশি। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সাতক্ষীরা উপকূলীয় এলাকায় প্রতিবছর ঘূণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদী ভাঙন, লবণাক্ততা, নগরায়ন, ইটভাটা, শিল্পকারখানা, বসতভিটা, রাস্তাঘাট, অবকাঠামো নির্মাণ ও যত্রতত্র বসতি প্রতিষ্ঠার কারণে অনেক কৃষিজমি অনাবাদি হচ্ছে। কৃষকরা জানান, কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষিভিত্তিক উৎপাদনের জন্য যেখানে ছিলো যথাযোগ্য তাপমাত্রা,ছিলো ছয়টি আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ঋতু, সেখানে দিনে দিনে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঋতু হারিয়ে যেতে বসেছে এবং তার সাথে সাথে বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা সবকিছুতে আমূল পরিবর্তন আসছে। ফলে কৃষির ভবিষ্যৎ চরম হুমকির মুখে পড়েছে। সাতক্ষীরার তারা উপজেলার খলিষখালি এলাকার আব্দুস সালাম বলেন, গত ১০ বছরে আমার এলাকার ১০০ বিঘা জমি যেখানে ধানসহ অন্যান্য ফসল হতো। সেই সব জমি কৃষি খাত থেকে অন্য খাতে চলে গেছে। এছাড়া ৪০ বিঘার বেশি জমি ঘর-বাড়ি স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্র্রাসাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরীতে চলে। এমনিভাবে প্রতিবছর কৃষি খাতের জমি অন্যখাতে চলে যাচ্ছে। এতে ভবিষ্যতে খাদ্যের উপর চাপ পড়বে। সংশ্লিষ্টরা বলছে, কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইনটি প্রস্তাবিত অবস্থায় থাকার কারণে সেই সুযোগ নিচ্ছে অনেক অসাধু ভূমি খেকো। ফলে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণে কৃষি জমি চলে যাচ্ছে অকৃষি খাতে। এভাবে প্রতি বছর কমে যাচ্ছে আবাদি জমি, কমে যাচ্ছে খাদ্যশস্যের উৎপাদন। কোনো কৃষি জমি ভরাট করে বাড়িঘর, শিল্প-কারখানা, ইটভাটা বা অন্য কোনো অকৃষি স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। কিন্তু সাতক্ষীরায় এই আইনটি মানছেন না অনেকেই।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট সাতক্ষীরা উপকেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. বাবুল আক্তার বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-উপকূলীয় এলাকায় দিন দিন লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া অসময়ে বৃষ্টিপাত হচ্ছে, জলমগ্ন হয়ে পড়ছে বিস্তীর্ণ অঞ্চল। সাতক্ষীরা জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সরদার শরিফুল ইসলাম বলেন, আবাসন ও শিল্প উন্নয়নের কারণে জেলায় কৃষি জমির পাশাপাশি জলাশায়ও কমে যাচ্ছে। পুকুরগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে তিনি নিজের একটি বাড়ি তৈরী করছেন। এতে করে জমি কমে যাচ্ছে।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ২০০১ সালে জেলায় আবাদযোগ্য জমি ছিলো এক লাখ ৭৩ হাজার ৬০৪ হেক্টর সেটা ২০১০-১১ সালে এসে দাঁড়ালো এক লাখ ৭০ হাজার ৪১৯ এবং ২০২২-২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী এক লাখ ৬৫হাজার ২৪৫ হেক্টরে এসে দাঁড়িয়েছে। এমনিভাবে প্রতি বছর কৃষি খাতের জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, কৃষি জমি সুরক্ষায় সরকার বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এছাড়া জেলা সমন্বয় কমিটির মাধ্যমে কৃষি জমি অন্যখাতে চলে গেলে আমি তাদের অবহিত করি।