দেশে বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে ৫০ হাজারের বেশি। অবৈধ অস্ত্রের সঠিক পরিসংখ্যান সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে নেই। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে কমিশন। নির্বাচনকে ঘিরে বৈধ এবং অবৈধ অস্ত্রধারীরা সক্রিয় হয়ে ওঠছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে হুমকি হিসেবে প্রকাশ্যে অস্ত্র প্রদর্শন করছে বলেও অভিযোগ আছে। বৈধ অস্ত্র হলেও তা বিনা প্রয়োজনে প্রদর্শন করে ও হুমকি দেয়ার ঘটনা ঘটলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
ইতিমধ্যে একাধিকবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে নির্বাচনের আগে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করার ঘোষণা দেয়া হয়। র্যাবের পক্ষ থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে চলমান অভিযান অব্যাহত রাখার কথা বলা হয়। গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পক্ষ থেকেও একই ঘোষণা দেয়া হয়েছে। বিরোধী দলের পক্ষ থেকেও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং অবৈধ অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। তবে বাস্তবে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে এখন পর্যন্ত সাড়াঁশি অভিযান শুরু করেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মূলত নিয়মিত অভিযানকেই নামকা ওয়াস্তে অস্ত্র উদ্ধার অভিযান বলে চালিয়ে দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। এই সুযোগে রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকা অবৈধ এবং বৈধ অস্ত্রধারীরা প্রকাশ্যে অস্ত্র প্রদর্শন করে মহড়া দিচ্ছে। ক্ষমতাসীন নেতারা তাদের পক্ষে প্রভাব বিস্তারে এসব অস্ত্রধারীকে মিছিল ও সভা-সমাবেশে ব্যবহার করছে বলে অনেকেই মন্তব্য করছেন।
সম্প্রতি ঢাকার মিরপুরের পল্লবী এলাকায় তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা বিক্ষোভ শুরু করলে তাদের ছত্রভঙ্গ করতে নামেন স্থানীয় যুব লীগের নেতারা। এ সময় আওলাদ হোসেন নামে এক যুবলীগ নেতাকে প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে দেখা যায়। এদিকে কয়েকদিন আগে ময়মনসিংহের নান্দাইলে উপজেলা আওয়ামী লীগের বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ মিছিলে অস্ত্র প্রদর্শন করেন স্থানীয় সাবেক সংসদ সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) আবদুস সালামের জামাতা জাহিদ হাসানের দেহরক্ষী কামরুজ্জামান। কয়েক মাস আগে অস্ত্র হাতে নিয়ে মিছিলে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায় চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) সংসদীয় আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীকে। ফেনীতে গত মঙ্গলবার (২১ নবেম্বর) রাতে প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে নিয়ে গুলী ছুড়তে থাকা দু’জনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। ঘটনার পর থেকে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লেও পুলিশ বলছে, তারা কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি। এছাড়াও বিভিন্ন সময় বিরোধী পক্ষের সভা-সমাবেশ ঠেকাতে প্রকাশ্যে অস্ত্রধারীদের ছবি গণমাধ্যমে দেখা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরেই অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে। যা আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আরও কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে অপরাধ কর্মকা-ে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হয়। জাতীয় নির্বাচনের আগে ভোটের মাঠের নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতা ধরে রাখতে এ অপতৎপরতা আরও বাড়বে। এ নিয়ে সাধারণ জনগণের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও উদ্বিগ্ন। তবে এ ব্যাপারে প্রশাসনের উদ্যোগ যথাযথ নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অস্ত্র উদ্ধার করেন। অস্ত্রের বাহকদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। অথচ কারা অস্ত্র নিয়ে আসছে, কারা কিনছে, কারা ব্যবহার করছে এর কিছুই তদন্ত করে বের করা হয় না। ফলে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, রাজনৈতিক সহিংসতা, হত্যা, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে। এসব অস্ত্রের একটি অংশ আসে ভারত থেকে। এছাড়া বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দর দিয়েও দেশে অবৈধ অস্ত্র ঢুকছে। নির্বাচনের আগে সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অস্ত্র আসা ঠেকাতে নিরাপত্তা জোরদার ও দেশে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে সাঁড়াশি অভিযান চালাতে হবে। তা না হলে নির্বাচন ছাড়াও নানা সহিংসতায় এসব অস্ত্রের ব্যবহার বাড়বে। আইনশৃঙ্খরা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বিভিন্ন সময় ধারাবাহিক অভিযান চালানো হচ্ছে। তবে কৌশলী পরিকল্পনা না থাকায় অভিযানের সফলতা বরাবর অধরাই থেকে যাচ্ছে। কারা অবৈধ অস্ত্র দেশে আনছে, কারা কিনছে, কারা ব্যবহার করছে- সার্বিকভাবে তদন্ত করে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা না নেয়া হলে পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সারা দেশে বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা ৫০ হাজার ৩১০টি। এর মধ্যে ব্যক্তিগত অস্ত্র ৪৫ হাজার ২২৬টি। অস্ত্রের মধ্যে পিস্তল ৪ হাজার ৬৮৩টি, রিভলবার ২ হাজার ৪৩টি, একনলা বন্দুক ২০ হাজার ৮০৯টি, দো’নলা বন্দুক ১০ হাজার ৭১৯টি, শর্টগান ৫ হাজার ৪৪৪টি, রাইফেল ১ হাজার ৭০৬টি এবং অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে ৪ হাজার ৬টি। বাকি অস্ত্রগুলো বিভিন্ন আর্থিক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নামে লাইসেন্স করা। প্রাপ্ত হিসাব বলছে, এ সব অস্ত্রের মধ্যে ১০ হাজার ২১৫টি রয়েছে রাজনীতিবিদদের কাছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছে রয়েছে ৭ হাজার ২১৫টি আগ্নেয়াস্ত্র। বিএনপির নেতাকর্মীর কাছে ২ হাজার ৫৮৭টি এবং অন্যান্য দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নামে ৭৯টি বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের কাছে এই বিপুলসংখ্যক অস্ত্র থাকলে তা সার্বিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়ার শর্তগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে যে কোনো নির্বাচনের আগে আগ্নেয়াস্ত্র স্থানীয় পুলিশের কাছে জমা দিতে হয়। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশনের। কমিশন যদি সিদ্ধান্ত দেয় যে, বৈধ অস্ত্রধারীদের অস্ত্র জমা দেওয়া লাগবে, তাহলে সে হিসেবেই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য মতে, দেড় বছরে সারা দেশে আগ্নেয়াস্ত্রসহ ছয় হাজারের বেশি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার করা অস্ত্রের বেশির ভাগ বিদেশী। এসব অস্ত্র যশোরের বেনাপোল, চুয়াডাঙ্গার দর্শনা, সাতক্ষীরার শাঁকারা, মেহেরপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুমিল্লা, কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়াসহ অন্তত ৩০টি পথে সীমান্ত পেরিয়ে দেশে ঢুকছে। র্যাবের তদন্তে উঠে এসেছে, অস্ত্রের বড় চালানগুলো দেশে ঢোকে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্ত দিয়ে। বিজিবির গোয়েন্দা তথ্য বলছে, দেশের সীমান্তগুলোর অন্তত ৩২টি স্থান দিয়ে দেশে অবৈধ অস্ত্র ঢুকছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে টার্গেট করে পেশাদার সন্ত্রাসীরা ছোট বড় আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করছে। এসব অস্ত্রের মধ্যে সেভেন পয়েন্ট সিক্স ফাইভ ও নাইন এমএম পিস্তল বেশি ঢুকছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে। পয়েন্ট টু-টু বোরের রিভলভার আসছে সিলেটের কানাইঘাট সীমান্ত দিয়ে। কুমিল্লা, যশোরের বেনাপোল ও হিলি সীমান্ত হয়েও এ ধরনের অস্ত্র ঢুকছে দেশে। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ সেন্টারের (বিডিপিসি) এক গবেষণা অনুযায়ী, দেশে অবৈধ অস্ত্র আমদানির শতাধিক সিন্ডিকেট রয়েছে। অবৈধ অস্ত্রের মালিকরা অস্ত্র ভাড়া দিচ্ছে এক শ্রেণির সন্ত্রাসীর কাছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. হাবিবুর রহমান বলেছেন, অস্ত্র উদ্ধার অভিযান পুলিশের একটি রুটিন কাজ। তবে নির্বাচনকে সামনে রেখে অস্ত্র উদ্ধারের বিশেষ কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়ে শিগগিরই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয়া হবে। মন্ত্রণালয়ের জন নিরাপত্তা বিভাগ পুলিশ সদর দপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরে চিঠি দিয়ে নির্দেশনা দেবে। নির্দেশনার পর পুলিশ সদর দপ্তর সারা দেশের ঊর্ধ্বতন পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। র্যাব ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী ও অবৈধ অস্ত্র আছে এমন ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করছে। এ তালিকা ধরেই বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হবে। গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী, মাদক ব্যবসায়ী, পলিটিক্যাল ক্যাডার এবং সন্ত্রাসীদের কাছে অন্তত চার লাখ অবৈধ অস্ত্র রয়েছে। নির্বাচনে আধিপত্য বিস্তার, ক্ষমতার প্রভাব দেখানো, ভোট কেন্দ্র দখলসহ নানা সহিংসতায় এসব অস্ত্র ব্যবহার হতে পারে।