ভোটের আগে হাতে ৫২ দিন সময় রেখে গত বুধবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আগের সংসদ নির্বাচনগুলোতে তপশিল ঘোষণার আগে ৪০-৪৫ দিন সময় রাখা হতো। নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা ছাড়াই এত দ্রুত নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা ঠিক হয়নি। এতে সংলাপের পথ আরও রুদ্ধ হয়ে গেছে; যা চলমান রাজনৈতিক সংকটকে আরও ঘনীভূত করবে। তবে নির্বাচন কমিশন বলছে, প্রার্থিতা বাছাই ও আপিলের জন্য হাতে পর্যাপ্ত সময় রাখতেই একটু আগে তপশিল দেওয়া হয়েছে।
সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে সংঘাতময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে। নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল হরতাল-অবরোধসহ নানা কর্মসূচি পালন করছে। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলছে, সংবিধান অনুসারে বর্তমান সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এমন পরিস্থিতিতে সুশীল সমাজ ও অনেক প্রভাবশালী বিদেশি রাষ্ট্র আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের ওপর জোর দিচ্ছে। এ নিয়ে নানামুখী আলোচনার মধ্যেই গত ১৫ নভেম্বর তপশিল ঘোষণা করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। তপশিল অনুসারে আগামী ৭ জানুয়ারি ভোট অনুষ্ঠিত হবে।
আওয়ামী লীগ ও তাদের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট এরই মধ্যে তপশিলকে স্বাগত জানিয়েছে। বিএনপি-জামায়াতসহ অনেক দল তপশিল প্রত্যাখ্যান করে ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ঘোষণা করে। তপশিল ঘোষণার পর প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেছিলেন, তাড়াহুড়া করে একতরফা নির্বাচনী তপশিল ঘোষণা দেশে বিদ্যমান সংঘাতপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলবে।
তবে তপশিল ঘোষণার দিন জাতির উদ্দেশে ভাষণে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছিলেন, ‘দেশের সার্বিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা ও সমাধান অসাধ্য নয়।’ যদিও সেদিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, তপশিল ঘোষণার পর সংলাপের সময় কোথায়?
এমনিতে সরকারের পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন করার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আছে। চলতি সংসদের মেয়াদ পূর্ণ হবে আগামী ২৯ জানুয়ারি। তার আগেই ৭ জানুয়ারি ভোট গ্রহণের তারিখ ঘোষণা করেছে ইসি। জাতীয় নির্বাচন-সংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে বলা হয়েছে, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের দিন থেকে ভোটের দিনের মধ্যে অন্তত ১৫ দিন সময় রাখতে হবে। এবারের তপশিলে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ১৭ ডিসেম্বর। অর্থাৎ প্রার্থিতা প্রত্যাহারের দিন থেকে ভোট পর্যন্ত ২১ দিন সময় হাতে রেখেছে আউয়াল কমিশন।
এদিকে তপশিল ঘোষণায় তাড়াহুড়ার অভিযোগের মধ্যেই রাজনৈতিক দলগুলোকে জোটভুক্তির বিষয়ে জানাতে মাত্র তিন দিন সময় দিয়েছে ইসি। গত ১৬ নভেম্বর এক নির্দেশনায় নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোকে ১৮ নভেম্বরের মধ্যে জোটভুক্তির বিষয়ে জানাতে বলা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক সমকালকে বলেন, ‘সংবিধান অনুসারে ২০২৪ সালের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহের মধ্যে নির্বাচনের সুযোগ রয়েছে। সে হিসাবে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি তপশিল ঘোষণা করা যেত। কারণ, প্রধান দুই দল নির্বাচন নিয়ে এখন দুই মেরুতে। সংলাপের মাধ্যমে বর্তমান বিরূপ রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে বের হতে হবে। আরও পরে তপশিল হলে আলাপ-আলোচনার সুযোগ পাওয়া যেত। তপশিল ঘোষণায় তাড়াহুড়া করে সংলাপের সুযোগ নষ্ট করা হয়েছে। ফলে ২০২৪ সালেও ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো আবার একতরফা নির্বাচন হতে যাচ্ছে।’
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘তপশিল ঘোষণার পর নির্বাচনের কমিশনের দায় বেড়ে যায়। নির্বাচনের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ পরিবেশ বজায় রাখতে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামলানো, রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ন্ত্রণসহ নানান দিক সামলাতে হয়। এ জন্য নির্বাচনের আগে একটু সময় কম রেখে তপশিল ঘোষণা করা হতো আগে, যাতে পরিস্থিতি সহজে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এবার বেশ সময় নেওয়া হয়েছে। আবার দেশে এখনও গ্রহণযোগ্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন করার পরিবেশ তৈরি হয়নি। একটা সংকট চলছে। অনেক দল তপশিল প্রত্যাখ্যান করেছে। এমন সংঘাতময় পরিস্থিতিতে তপশিলের পর পরিস্থিতির ওপর নির্বাচন কমিশনের যে নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা, সেটা তারা কীভাবে প্রতিষ্ঠা করবে, তা নিয়ে শঙ্কা থেকে যাচ্ছে।’
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবীব খান সমকালকে বলেন, ‘আসন্ন সংসদ নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক করতে নির্বাচন কমিশন সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের আত্মবিশ্বাস রয়েছে, সব অংশীজনের সহযোগিতায় ভোট সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর হবে। ইতোমধ্যে বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের তাদের দায়িত্ব ও করণীয় সম্পর্কে সচেতন করা হয়েছে। এ জন্য ভিন্ন ভিন্ন পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে। অচিরেই জেলা পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বৈঠক, সম্ভাব্য প্রার্থী/ রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করার পরিকল্পনা রয়েছে। সকল দলের প্রতি আহ্বান থাকবে- মতভেদ, মতানৈক্য নিরসন করে নির্বাচনে এসে ভোটারদের কাঙ্খিত প্রার্থীকে নির্বাচিত করতে উৎসাহিত করুন। সম্মানিত ভোটারদের প্রত্যাশা পুরনে সর্বদাই গুরুত্ব দিয়ে আসছে এ কমিশন এবং একটা সুন্দর নির্বাচন উপহার দিতে সর্বাত্মক সব কিছুই করব ইনশাআল্লাহ।’’
বিগত কয়েকটি নির্বাচনের তপশিল
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করা হয়েছিল ২০০৮ সালের ২ নভেম্বর। এর ৪৭ দিন পর ১৮ ডিসেম্বর ছিল ভোটের তারিখ। পরে তারিখ পিছিয়ে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর ভোট হয়। এই নির্বাচন পরিচালনা করে এটিএম শামসুল হুদা কমিশন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করা হয়েছিল ২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর। ৪৫ দিন হাতে রেখে ভোটের দিন ঘোষণা করা হয়েছিল ২৩ ডিসেম্বর। পরে এক সপ্তাহ পিছিয়ে ৩০ ডিসেম্বর ভোট গ্রহণ করা হয়। নির্বাচন পরিচালনা করে রকিবউদ্দীন কমিশন।
দশম সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করা হয়েছিল ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর। ৪০ দিন সময় রেখে ভোট গ্রহণ করা হয় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। নির্বাচন পরিচালনা করে কে এম নুরুল হুদা কমিশন।