আগামী ৭ জানুয়ারি হতে যাচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এরই মধ্যে সব ধরনের প্রস্তুতিও নেয়া শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ আটঘাট বেঁধে নির্বাচনে যাওয়ার কথা ভাবলেও বিরোধীরা এখনো দোলাচলে। তারা সরকারের পদত্যাগের দাবিতে এখনো রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। যদিও রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মী এখন কারাবন্দী।
সরকারবিরোধীদের অভিযোগ, সারা দেশে বিভিন্ন মামলায় রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করছে পুলিশ। খোদ পুলিশের তথ্য বলছে, গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সহিংসতা এবং পরবর্তীতে হরতাল-অবরোধের জেরে বাসে অগ্নিসংযোগ, ককটেল বিস্ফোরণ, গাড়ি ভাঙচুরের মামলায় সারা দেশে প্রায় ৯ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আর এসব অভিযোগের মামলায় তাদের পাঠানো হচ্ছে কারাগারে। ফলে কারাগারগুলোতে ধারণক্ষমতার তুলনায় বন্দীর সংখ্যা এখন অনেক বেশি। এই অবস্থায় কারাবন্দীদের মানবাধিকার রক্ষা করা হচ্ছে কতটুকু- এমন প্রশ্ন অনেকের। জাগো নিউজ।
প্রতিদিনই নানা অপরাধে আসামিদের গ্রেফতার ও কারাগারে পাঠানোর ঘটনা ঘটছে অহরহ। দেশে মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধে কারাগারগুলোতে আগে থেকেই বন্দীর সংখ্যা ধারণক্ষমতার বেশি। তবে রাজনৈতিক সহিংসতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশেষ অভিযানে গ্রেফতারের কারণে কারাগারগুলো এখন বন্দীতে ঠাসা। অনেকে বলছেন, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরুর পর থেকে সারা দেশেই বন্দীর সংখ্যা আরো বাড়ছে।
কারা সদরদফতরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৬৮টি কারাগারের বন্দী ধারণক্ষমতা প্রায় ৪৩ হাজার হলেও ১২ নভেম্বর পর্যন্ত কারাবন্দী ছিলেন প্রায় ৮৯ হাজার। যেখানে গত ২ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান নিজেই জানিয়েছিলেন কারাগারে বন্দী ৭৭ হাজারের কিছু বেশি।
দেশে ১৩টি কেন্দ্রীয় ও ৫৫টি জেলা কারাগারসহ মোট ৬৮টি কারাগার চালু রয়েছে। এসব কারাগারে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত বন্দী সংখ্যা ৮৮ হাজার ৭৪২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৮৫ হাজার ৬৭৭ জন এবং নারী ৩ হাজার ৬৫ জন। অথচ কারাগারগুলোর ধারণক্ষমতা ৪২ হাজার ৮৬৬ জনের। পুরুষ কারাবন্দীর ধারণ ক্ষমতা ৪০ হাজার ৯৩৭ জন এবং নারী এক হাজার ৯২৯ জন।
কারাবিধি অনুযায়ী, একজন বন্দীর থাকার জন্য ন্যূনতম ৩৬ বর্গফুট জায়গা থাকতে হয়। কিন্তু কারাগারে সেটা মানা সম্ভব হয় না। কারাগারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বলছেন, বিধিতে যা আছে তা মানা যায় না। ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি বন্দী থাকায় দ্বিগুণ রাখতে হয়। এতে কারাগারে শৃঙ্খলা রক্ষা করাও কঠিন।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে (কেরানীগঞ্জ) বন্দী ধারণক্ষমতা চার হাজার ৫৯০ জন। গত ২৮ অক্টোবরের পর থেকে বন্দীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে অনেককে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তারপরও সেখানে ৯ হাজারের বেশি কারাবন্দী রয়েছেন। তাদের অধিকাংশই রাজনৈতিক মামলার আসামি। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য মতে, গত ২৮ অক্টোরব থেকে ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত রাজধানীতে এক হাজার ৯৬৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ জেল সুপার সুভাষ কুমার ঘোষ বলেন, বিধি অনুযায়ী যে সংখ্যক বন্দী থাকার কথা তার চেয়ে বেশি রয়েছে। তবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কয়েক দিন আগে যে চাপ ছিল তার তুলনায় বন্দীর সংখ্যা এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। আমাদের অতিরিক্ত যে বন্দী ছিল তাদের কাশিমপুর কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এখন বন্দী কমই আছে।
কারা সদরদফতর সূত্রে জানা গেছে, দেশের ৬৮টি কারাগারের জন্য কারা অধিদফতরের চিকিৎসক পদ ১৪১টি। অথচ কারা অধিদফতরের অধীনে নিজস্ব মাত্র তিনজন চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বাকি সব কারাগারে চিকিৎসা চলে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে সংযুক্ত চিকিৎসকদের মাধ্যমে। এতে বন্দীদের যথাযথ চিকিৎসাসেবা দেয়াও সম্ভব হচ্ছে না। কারাগারগুলোতে কারাবন্দীরা থাকা, খাওয়া, ঘুম, চলাফেরাসহ নানা সমস্যায়ও পড়েন বলে জানিয়েছেন স্বজনরা। যক্ষ্মা, ডায়াবেটিস, চুলকানি, জ্বর, কাশি, কিডনি, লিভারজনিত সমস্যাসহ নানা রোগে ভোগেন কেউ কেউ। কারাগার সংশোধনাগার না হয়ে যেন সঙ্কটস্থল হয়ে দাঁড়িয়েছে বলছেন অনেকে।
রাজধানীর বনানী ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের একটি ইউনিটের বিএনপির সহসভাপতি মো: গিয়াস উদ্দিনের স্ত্রী খালেদা বেগম বলেন, আমার স্বামীকে গত ১৮ অক্টোবর গ্রেফতার করেছে। তিনি মাঝে মধ্যেই অসুস্থ থাকতেন। কারাগারে যাওয়ার পর এখন আরো অসুস্থ দেখে আসলাম। শরীর আগের থেকে কিছুটা ফুলে গেছে।
সম্প্রতি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো বন্দীদের মধ্যে বেশির ভাগই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্য। কেউ সহিংসতার মামলায়, কেউ পুলিশের ওপর হামলার মামলাসহ বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন। বন্দীদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা।
কারা সদরদফতর থেকে জানা গেছে, বন্দীদের প্রতিদিন সকালে আগে যেখানে দেয়া হতো রুটি আর গুড় এখন দেয়া হয় সবজি, রুটি বা হালুয়া রুটি অথবা খিচুড়ি। দুপুরে দেয়া হয় ভাত, সবজি, ডাল, মাছ অথবা মাংস। আর রাতে দেয়া হয় ভাত, সবজি, ডাল। কারাগারে থাকা অধিকাংশই হাজতি ((বিচারাধীন বন্দী)। তবে বিশেষ ব্যক্তিদের আইন অনুযায়ী যাদের ডিভিশন দেয়ার কথা তাদের ডিভিশন দেয়া হচ্ছে।
এসব বিষয়ে কারা অধিদফতরের সহকারী কারা মহাপরিদর্শক মো: মাইন উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, সাধারণত ৮০ হাজার কারাবন্দী থাকেন। তবে রাজনৈতিক সহিংসতার সময় কিছুটা বাড়ে। কারাবন্দীদের অধিকাংশই হাজতি এবং তাদের খাবারো এখন আগের তুলনায় ভালো দেয়া হয়। ডিভিশন পাওয়া ব্যক্তিরাও ডিভিশন পাচ্ছেন।
কারাগারগুলোতে দ্বিগুণ বন্দী ও নানান সমস্যা থাকার পরও ধারণক্ষমতা বাড়ানোর পরিকল্পনা নেই বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। গত ২ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, ৪২ হাজার বন্দী রাখার ধারণক্ষমতা থাকলেও আমরা কারাগারগুলোতে ৯০ হাজার বন্দী রাখতে পারব। তাই আপাতত ধারণক্ষমতা বাড়ানোর দরকার নেই। প্রয়োজন হলে আমরা পরে ব্যবস্থা নেবো। ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, খুলনা, নরসিংদী ও জামালপুরে কারাগার নির্মাণ অথবা সম্প্রসারণের কাজ চলছে। নির্মাণাধীন কারাগারগুলোর কাজ শেষ হলে বন্দী ধারণক্ষমতাও বাড়বে বলে জানান তিনি। আসামির বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ থাকে মানুষ খুন করেছে, বোমা মেরেছে, বাসে আগুন জ্বালিয়েছে তাহলে কোথায় পাঠাবে? কী অপরাধে অভিযুক্ত তা দেখতে হবে। সত্য-মিথ্যা সেটা পরের কথা। তবে তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয়েছে সেগুলো অনেক কঠিন ধারায়। ফলে জেলে পাঠাবে না তো কোথায় পাঠাবে? রাজনৈতিক গ্রেফতার বলবেন, পুলিশ অভিযোগটা কী বলছে সেটা দেখতে হবে। তারা যদি বলে পকেটে ককটেল পাওয়া গেছে। এক্ষেত্রে বিচারকরা কী করবেন?
বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, কারাগারে যারা থাকেন তাদেরও মানবাধিকার আছে। তাদের থাকা, খাওয়া সবকিছু নিশ্চিত করতে হবে কারাগার সংশ্লিষ্টদের অর্থাৎ সরকারের। এখন এক জায়গায় যদি পাঁচজন থাকার ব্যবস্থা থাকে সেখানে ১০ জনকে রাখা হয়, তাহলে ১০ জনেরই মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়। কারাবন্দীর অধিকার নিশ্চিত করেই ধারণক্ষমতা নির্ধারণ করা হয়। ২০ জনের একটি টয়লেটে যদি আরো ২০ জন যোগ হয় তাহলে তারা কতক্ষণে টয়লেটে যাবেন। এতে তাদের স্বাস্থ্যের ওপরই প্রভাব পড়বে। জায়গার অভাবে হয়তো ঘুমাতে পারছে না, এমন আরো অনেক সমস্যা রয়েছে। কিন্তু গ্রেফতার তো সরকার কমাচ্ছে না। বিষয়গুলো সরকারের বিবেচনা করা দরকার। গ্রেফতার করে যদি লোক বেশিও রাখতে চায় তাহলে তাদের জায়গার ব্যবস্থা করা উচিত। আইনের শাসনের দুর্বলতার কারণেই এমনটা হচ্ছে বলে মনে করেন মনজিল মোরসেদ।
নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক নেতাদের যেসব অপরাধে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে তারা সবাই সেসব অপরাধে জড়িত নাকি রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করা হচ্ছে- সে প্রশ্ন রয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক। তিনি বলেন, রাজনৈতিকভাবে হয়রানিমূলক মামলা দিয়ে বিরোধী মতকে দমন করা হয়। অতীতে যারাই ক্ষমতায় থেকেছে তাদের সময়েও একই রকম হয়েছে। এখন যেসব মামলায় কারাগারে পাঠাচ্ছে সেগুলো আইনের দৃষ্টিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মামলাগুলো কিভাবে হয়েছে তা নিয়ে নানান আলোচনা রয়েছে। মামলাগুলোর পেছনে রাজনৈতিক প্রভাবের যে অভিযোগ তা তো রয়েছেই। তিনি বলেন, আমাদের দেশে নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন দল নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। বিরোধীপক্ষ থেকে পরিস্থিতি অস্থির করা আর সরকারের পক্ষ থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা- এমনটাই চলে আসছে। আমাদের গণতন্ত্র পড়ে গেছে এই দুটো প্রক্রিয়ার মাঝখানে। সে কারণে আমাদের এত অসুবিধা। সামনের দিনে কারাগারে বন্দীর সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। আর এই গ্রেফতার দিয়ে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব হবে না।