চলতি বছর চালু হওয়া নতুন শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে দেশব্যাপী চলছে তীব্র সমালোচনা, উদ্বেগ উৎকন্ঠা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে নতুন এই কারিকুলামটি এ দেশের জন্য অনুপযুক্ত। নতুন কারিকুলাম পড়ে ছেলেরা হবে হোটেল বয় আর মেয়েরা হবে কাজের বুয়া। তারা থালা বাসনের ছবি তুলে প্রদর্শনী করবে। রান্না বান্না শিখানোর জন্য স্কুলে পাঠানোর কোন মানে হয় না। এ দিকে মুখস্থ-নির্ভরতার পরিবর্তে অভিজ্ঞতা ও কার্যক্রমভিত্তিক শিখনের প্রতি গুরুত্ব দিতে নতুন শিক্ষা কারিকুলাম চালু করা হয়েছে বলে সরকার দাবি করছে। কিন্তু চালু হওয়া এ কারিকুলাম নিয়ে বিভিন্ন মহলে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। শিক্ষাবিদরা বলছেন, সরকারের নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে সক্ষমতার অভাব রয়েছে শিক্ষকদের। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, নতুন কারিকুলামে দক্ষ করে তুলতে সারা দেশের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। আর এ কারিকুলাম বাতিল দাবিতে আন্দোলনের পেছনে রয়েছেন নোট-গাইড ব্যবসায়ী আর কোচিং মালিকরা। যদিও নোট-গাইড প্রকাশকরা বলেছেন, মন্ত্রীর এমন অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্কুলের সামনে বিক্ষোভ মিছিল করে অভিভাবকরা এ কারিকুলাম বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। এ ছাড়া আগামী ২৪ নবেম্বর সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলনের ব্যানারে জাতীয় শহীদ মিনারে অভিভাবক সমাবেশের ডাক দিয়েছেন অভিভাবকরা।
চলতি বছর চালু হওয়া নতুন শিক্ষাক্রম পর্যায়ক্রমে ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বাস্তবায়ন হবে। বর্তমান শিক্ষাক্রমে নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখা থাকলেও নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী ২০২৪ সালে নবম শ্রেণিতে বিভাগ (বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা) বিভাজন থাকছে না। ইতিমধ্যে প্রশাসনিক অনুমোদন দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির সবাইকে পড়তে হবে ১০টি অভিন্ন বিষয়। বর্তমানে নবম ও দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচি মিলিয়ে এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় কিন্তু নতুন কারিকুলামে কেবল দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ওপর অনুষ্ঠিত হবে এসএসসি পরীক্ষা।
চলতি বছর ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদান করানো হয়েছে। মূল্যায়নও হচ্ছে নতুন পদ্ধতিতে। ষান্মাসিক মূল্যায়নের পর এবার আসছে বছরের সামষ্টিক মূল্যায়ন। এরই মধ্যে বার্ষিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সময়সূচি প্রকাশ করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)।
কারিকুলাম নিয়ে নানা শঙ্কা ও বাতিলের দাবি জানিয়ে মানববন্ধন করে আসছেন অভিভাবকরা। তারা চলতি বছর থেকে দেশে চালু হওয়া নতুন শিক্ষাক্রম বাতিলসহ একাধিক দাবি জানান। ঘোষণা করেন বেশকিছু কর্মসূচি। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ কর্মসূচি পালিত হচ্ছে।
নতুন শিক্ষা কারিকুলাম বাতিল ও পরীক্ষা পদ্ধতি ফের চালুর দাবিতে সাংবাদিক সম্মেলন করেছে ‘সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলন’ নামে অভিভাবকদের একটি সংগঠন। অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, নতুন কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ অনুযায়ী বিজ্ঞান বা মানবিক বিষয় বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকবে না। ফলে তারা উচ্চশিক্ষার বিশেষায়িত বিষয়ে পড়তে গিয়ে নানানভাবে হোঁচট খাবে। এতে উচ্চশিক্ষায় অনেক ছাত্রছাত্রী ঝরে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। নতুন কারিকুলামে ছাত্রছাত্রীরা কোনো পাঠের তত্ত্বীয় বিষয় বা ব্যাখ্যার ব্যাপারে কিছু শিখছে না, তাদের মধ্যে ইলেকট্রনিক ডিভাইসনির্ভরতা বেড়েছে।
তারা বলেন, নতুন কারিকুলামে সাময়িক পরীক্ষার মতো লিখিত পরীক্ষাও নেই। আছে দলগত কাজ, প্রজেক্ট ও অ্যাসাইনমেন্ট। এগুলো কীভাবে করতে হবে তা ছাত্রছাত্রীরাও বুঝতে পারে না, শিক্ষকরাও বোঝাতে পারেন না। পরীক্ষা পদ্ধতি একেবারে বাতিল হওয়ার কারণে ছাত্রছাত্রীরা পাঠে মনোযোগ হারাচ্ছে। চালু হওয়া নতুন কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের ফলাফল মূল্যায়ন হবে নম্বর বা জিপিএর ভিত্তিতে নয়, চিহ্ন দিয়ে। ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ ও বৃত্তের মাধ্যমে ফলাফল দেওয়া হবে। এসব নিয়মের কারণে শিক্ষার্থীরা হতাশ হচ্ছে, মানসিকভাবেও ভেঙে পড়ছে।
অভিভাবকরা দাবি করেন, চালু হওয়া নতুন শিক্ষা কারিকুলাম সম্পূর্ণভাবে বাতিল করতে হবে। ৬০ নম্বরের দুটি সাময়িক লিখিত পরীক্ষা চালু রাখতে হবে। ক্লাস টেস্টগুলোয় ৪০ নম্বরের ধারাবাহিক মূল্যায়ন হিসেবে ধরতে হবে। নবম শ্রেণি থেকে সব শিক্ষার্থীর আগ্রহ অনুযায়ী বিষয় নির্বাচনের সুযোগ দিতে হবে। ফলাফল মূল্যায়নের ক্ষেত্রে চিহ্ন পদ্ধতি, ত্রিভুজ, বৃত্ত ও চতুর্ভুজ ইত্যাদি নির্দেশক বাতিল করে নম্বর ও গ্রেডভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি রাখতে হবে। শিক্ষার্থীদের ডিভাইসমুখী হতে নিরুৎসাহিত করে তাত্ত্বিক বিষয়ে অধ্যয়নমুখী করতে হবে। একই সঙ্গে সব শ্রেণিতে কারিকুলাম বাস্তবায়নের আগে অবশ্যই তা মন্ত্রিপরিষদ এবং সংসদে উত্থাপন করতে হবে।
তিনা ইসলাম নামে একজন অভিভাবক বলেন, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে নতুন এই কারিকুলামটি দেশের জন্য অনুপযুক্ত। তাই তারা ‘নতুন এই কারিকুলাম সংস্কার করে অন্তত ৫০/৬০ নম্বরে দুই সাময়িক লিখিত পরীক্ষা পদ্ধতি চালু, নম্বর ও গ্রেডভিত্তিক মূল্যায়ন, প্রতি বছর প্রতি ক্লাসে রেজিস্ট্রেশন ও সনদ প্রদানের সিদ্ধান্ত বাতিল, স্কুল পিরিয়ডে সমস্ত প্রজেক্ট সম্পন্ন করা এবং সমস্ত ব্যবহারিক ব্যয় স্কুলকে বহন করার দাবি জানান।
ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রীর মা বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষক, শ্রেণিকক্ষসহ বিদ্যমান অবকাঠামোতে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন কঠিন। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ছেন শিক্ষকরা। তারা নিজেরাই এখনো নতুন সিলেবাসের সঙ্গে খাপ খাইয়ে উঠতে পারেননি। তারা কীভাবে শিক্ষার্থীদের বুঝাবেন? তাই শিক্ষকরা আন্দাজের ওপর গ্রুপ স্টাডি এবং প্রজেক্ট দিচ্ছে। সন্তানরা তো বুঝেই না, কখনও কখনও আমরাও বুঝি না। তিনি বলেন, শহরের সচেতন অভিভাবকরা এই শিক্ষা উপকরণের যোগান দিতে পারলেও মফস্বল এলাকার অভিভাবকরা এগুলোর যোগান দিতে পারছেন না। ফলে দরিদ্র পরিবারের ছাত্রছাত্রী ঝরে পড়ছে আগের তুলনায় অনেক বেশি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, এই কারিকুলামটা বিদেশী কারিকুলাম অনুসরণ করতে যেয়ে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, দেশের শিক্ষকদের অবস্থা, অভিভাবক-স্কুলের অবস্থা চিন্তা করা হয়নি। এই কারণে এটা দেশের জন্য অনুপযোগী। তবে এই কারিকুলামকে আমি ভুল বলছি না, এটা অনুপযোগী। তিনি বলেন, এই কারিকুলাম অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী। যা বাস্তবায়ন করা খুবই কঠিন। এটি অনুসারে বইপত্র লেখাও একটা চ্যালেঞ্জ। এবার বই নিয়ে কতো হইচই। সামনের বছর আরও বই আসছে। এই কারিকুলাম অনুযায়ী বই লেখার যোগ্যতাসম্পন্ন লেখকও নাই আমাদের। আর মূল্যায়ন তো একেবারেই যাচ্ছেতাই। যারা করেছেন কারিকুলাম, তাদের কাছেও স্বচ্ছ ধারণা আছে বলে মনে হয় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন বলেন, শিক্ষাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য এই শিক্ষাক্রমকে রুখে দিন। নাহিদ, দীপুমনিরা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে একদম শেষ করে দিচ্ছে। ষড়যন্ত্র শুধু এখানেই শেষ না। একদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ও শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ছে মানে খরচ বাড়ছে আর অন্যদিকে শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ দিন দিন কমছে।
কারিকুলাম বাতিল দাবিতে অভিভাবকদের বিভিন্ন কর্মসূচির ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি সাংবাদিকদের জানান, নোট-গাইড ব্যবসায়ী আর কোচিং মালিকরা এ আন্দোলনের নেপথ্যে রয়েছেন। কারণ এ কারিকুলাম পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হলে তাদের ব্যবসা থাকবে না। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে এখনও হয়তো অনেকের অনেক রকম সন্দেহ, সংশয় রয়েছে। অধিকাংশ মানুষ ভালো বলছেন, আবার অনেকেরই সংশয় রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, পরীক্ষা থাকবে না। তাহলে কেমন হলো? পরীক্ষা থাকবে না, আসলে তা ঠিক নয়। অনেক পরীক্ষাই থাকবে, আবার অনেক পরীক্ষা থাকবে না। কিন্তু পরীক্ষা থাকবে না তার মানে মূল্যায়ন থাকবে না তা নয়। ধারাবাহিক মূল্যায়ন হবে।
বাংলাদেশ আদর্শ শিক্ষক ফেডারেশনের জেনারেল সেক্রেটারি অধ্যাপক এবিএম ফজলুল করীম বলেন, জাতীয় শিক্ষানীতি, শিক্ষা আইন ও বিভিন্ন সময় জারি করা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে গত ১৩ বছরে বর্তমান সরকার শিক্ষা ব্যবস্থাকে মেধাহীনতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। বর্তমান প্রজন্ম ধর্মহীন ও মেধাহীন জাতিতে পরিণত হচ্ছে। তিনি বলেন, প্লে-২য় শ্রেণি পর্যন্ত ধর্মীয় শিক্ষা উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। মাধ্যমিক থেকে শুরু করে উপরের দিকে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা বাদ দিয়ে অধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। পরীক্ষা উঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীরা বই-বিমুখ হয়ে পড়ছে। ৯ম ও ১০ শ্রেণিতে বিভাগ বিভাজন উঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। তার কারণে ১০ বছর পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা বিশেষায়িত শিক্ষা গ্রহণ করতে পারলো না। তিনি আদর্শ শিক্ষক ফেডারেশনের পক্ষ থেকে বর্তমান শিক্ষাক্রম স্থগিতের আহ্বান জানিয়ে বলেন, পরীক্ষা ব্যবস্থা পুনর্বহাল করতে হবে, প্লে-২য় শ্রেণী পর্যন্ত উঠিয়ে দেয়া ধর্মীয় শিক্ষা পুনর্বহাল করতে হবে। নতুন শিক্ষা কমিশন করে সকল ধর্মের মানুষের উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে।