ভয়াবহ সংকটের আবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়েছে বাংলাদেশ। এ যেন পাহাড় থেকে খাড়া গিরি খাদে পতনের অবস্থা। এমন ভয়াবহ সংকটে বাংলাদেশ একবার নিক্ষিপ্ত হয়েছিল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়। তখন বাংলাদেশের সমস্ত জনগণ এক দিকে। পেছনে সক্রিয়ভাবে ছিল বিশাল প্রতিবেশী ভারত। ৯ মাসের গেরিলা যুদ্ধ এবং ১৩ দিনের ভারতের প্রত্যক্ষ সামরিক হস্তক্ষেপে স্বাধীন হয়েছিল বাংলাদেশ।
৫২ বছর পর এই ২০২৩ সালে আবার তেমন ভয়াবহ সংকটের আবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়েছে প্রিয় পিতৃভূমি বাংলাদেশ। সেবার জনগণের সঙ্গে ছিল ভারত ও সোভিয়েট ইউনিয়ন (এর উত্তরসূরী বর্তমান রাশিয়া)। আর জনগণের বিপক্ষে ছিল আমেরিকা ও চীন। এবার জনগণের বিপক্ষে অর্থাৎ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামের বিপক্ষে রাশিয়া, চীন ও ভারত। আর জনগণের পক্ষে অর্থাৎ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সপক্ষে আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান প্রভৃতি দেশ।
গত ২৮ অক্টোবর শনিবার নয়া পল্টনে ১০ লক্ষাধিক লোকের জনসভাকে প্রচন্ড পুলিশী ক্র্যাকডাউনের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে প- করে দেওয়ার পর সরকার বিএনপি এবং আংশিকভাবে জামায়াতে ইসলামীর ওপর প্রচন্ড ক্র্যাকডাউন (মার্কিন ইংরেজিতে ডাবল ডাউন) শুরু করেছে। নির্বিচার ও বেপরোয়া ধরপাকড় শুরু হয়েছে। বিএনপির দাবি মতে শুধুমাত্র ২৮ অক্টোবর থেকে ১৫ নভেম্বর- এই ১৮ দিনে মির্জা ফখরুল, মির্জা আব্বাস ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ ১২ হাজার ৭০০ নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রতিবাদে বিএনপি ও জামায়াতসহ সমস্ত বিরোধীদল এক দিন হরতাল এবং তারপর অবরোধ প্রায় লাগাতার চালিয়ে যাচ্ছে।
এমন একটি পটভূমিতে দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু নিঃশর্ত আলোচনা বা ডায়ালগের মাধ্যমে সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য চিঠি দিয়েছিলেন বিএনপি, আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টিকে। ১৪ নভেম্বর এই খবর শোনার পর ১৫ নভেম্বর তড়িঘড়ি করে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে এই তড়িঘড়ি তফসিল ঘোষণা মার্কিন উদ্যোগে ডায়ালগের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের যে চেষ্টা নেওয়া হয়েছিল তার সামনে রোড ব্লক সৃষ্টি করা হলো। ১০ নভেম্বর দিল্লীতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিংকেন এবং ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শংকরের মধ্যে বাংলাদেশ বিষয়ে আলোচনা করার পর আমেরিকার সম্পূর্ণ নিজস্ব সিদ্ধান্তে ডোনাল্ড লু অফিসিয়ালি এই চিঠি পাঠান। এই চিঠিকে পত্রপাঠ বিদায় দেওয়ার ফলে এই সরকার এবং আমেরকার মধ্যে সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সেটা এখন দেখার বিষয়।
এরমধ্যে আন্দোলনে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে না হলেও জামায়াতে ইসলামী আলাদাভাবে কিন্তু একই কর্মসূচী বিএনপির সাথে পালন করছে। গত ১৪ নভেম্বর থেকে এই আন্দোলনে সহযাত্রী হয়েছে চরমোনাই হুজুরের ইসলামী আন্দোলন। ১৫ নভেম্বর এই আন্দোলনে সহযাত্রী হয়েছে খেলাফত মজলিশ। যার অন্যতম নেতা হলেন এখনও কারাবন্দী মওলানা মামুনুল হক।
আজ রোববার ও সোমবার ১৯ ও ২০ নভেম্বর বিএনপি সারা বাংলায় সকাল সন্ধ্যা সর্বাত্মক হরতাল ডেকেছে। তার মিত্ররাও আলাদা বিবৃতিতে একই কর্মসূচী ঘোষণা করেছে।
প্রচন্ড দমননীতি প্রয়োগ করে প্রতিবাদী কন্ঠ স্তব্ধ করা যাবে বলে সরকার মনে করেছিল। কিন্তু ফল হয়েছে এই যে তিনটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পুলিশ, র্যাব ও বিজিবিকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে। ইংরেজিতে বলতে পারি, It is a bad omen for the country. অর্থাৎ দেশের জন্য এটি একটি অশুভ সংকেত।
এক দিকে আমেরিকা ও পশ্চিমা দুনিয়ার বৈরীতা, অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরে নতুন দুইটি ইসলামী শক্তি যুক্ত হওয়ার ফলে এই আন্দোলনে প্রবল গতিবেগ সৃষ্টি হবে বলে দেশী ও বিদেশী পর্যবেক্ষকদের মত। দমননীতির মাধ্যমে কন্ঠ রোধের পলিসি সম্ভবত ব্যর্থ হতে চলেছে।
গণতন্ত্র ফিরে পাওয়ার জন্য জনগণকে কতবড় মূল্য দিতে হবে সেটা কে জানে? তবে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে দুর্বার গণআন্দোলন শুরু হয়েছে। কিন্তু এখনও গণঅভ্যুত্থান ঘটেনি।
॥ দুই ॥
কথায় বলে, আমি কমলিকে ছাড়তে চাইলে কি হবে, কমলি তো আমাকে ছাড়ে না। এই কথারই প্রতিধ্বনি দেখছি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতি, বিশেষ করে নির্বাচনী রাজনীতিতে। গুজবে ভরে গেছে সারা দেশ। গত ১৬ নভেম্বর বৃহস্পতিবার ইউটিউবে দেখলাম পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের কিছু বক্তব্য। তিনি বললেন, সারা দেশটাই গুজব বাজিতে ভরে গেছে। তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করে তিনি বললেন, ২/৩ দিন আগে সারা দিন অফিস করে সন্ধ্যায় সবেমাত্র তিনি বাসায় ফিরেছেন। তিনি তখনো গাড়ি থেকে নামতে পারেননি। এমন সময় তার ভাষায়, তার ‘কাজের বেটি’ দৌড়ে এসে তাকে জানালো যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নাকি রিজাইন করেছেন। তিনি ঐ কাজের বুয়াকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কোথা থেকে এই খবর পেলে? সাথে সাথে কাজের বুয়া তার মোবাইল বের করে একটি টিপ দিল এবং সাথে সাথে একটি অডিও ক্লিপ শোনা গেল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমি তো হতভম্ভ। একটু আগেই তো আমি প্রাইম মিনিস্টারের সাথে কথা বলে আসলাম। কই, কোনো কিছু তো ঘটেনি। অতঃপর তিনি বলেন, এই হলো বাংলাদেশের সাংবাদিক এবং ইউটিউবারদের সংবাদের ভিত্তি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের কথা বাদ দিন। গত ১৬ নভেম্বর বৃহস্পতিবার বেলা ১২ টা থেকে রাত ১১ টা পর্যন্ত একটি খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিও ক্লিপে দেখা যায়, মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস হনহন করে হেঁটে যাচ্ছেন। তার পেছনে একদল সাংবাদিক এবং ডানে বামে তার নিরাপত্তা কর্মী। অতঃপর খবরে বলা হলো যে পিটার হাসকে ওয়াশিংটনে ফিরে আসার জন্য জরুরি এত্তেলা (জরুরি তলব) দিয়েছে পররাষ্ট্র দফতর। তাই তিনি ওয়াশিংটন যাচ্ছেন। একটু পরেই অন্য একটি খবরে বলা হয় যে তিনি তো শ্রীলঙ্কান এয়ারওয়েজ অর্থাৎ শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রীয় বিমানে উঠেছেন। যারা বিমানে আসা যাওয়া করেন তারা জানেন যে কোনো দেশের এয়ারলাইন্স যখন বিদেশে যাত্রা করে তখন তারা যাওয়া বা আসার পথে তাদের নিজ দেশের রাজধানীতে টাচ করে। তো শ্রীলঙ্কান এয়ারওয়েজ তো তাদের রাজধানী কলম্বোতে নামবে। তারপর অন্যত্র যাত্রা। তখন আবার সংবাদ এলো যে তিনি হয়তো কোনো অফিসিয়াল কাজে শ্রীলঙ্কা যাচ্ছেন। সেখানে কাজ সেরে সেখান থেকে তিনি সরাসরি ওয়াশিংটন যাবেন। আর না হলে সেখান থেকে ফিরে এসে তিনি ওয়াশিংটন যাবেন।
তখনকার মতো গুজব সেখানেই থেমে গেল। সন্ধ্যার পর দেখলাম, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ ব্রিফিং দেখানো হচ্ছে। আমাদের ফরেন অফিসের মুখপাত্র মিসেস সাবরিনা বললেন যে পিটার হাস কোথায় গেছেন সেটি বাংলাদেশ সরকার জানে। কারণ ডিপ্লোম্যাটিক প্রোটোকল বলে যে কোনো দেশে বিদেশের কোনো রাষ্ট্রদূত যখন তার কর্মস্থল ত্যাগ করে বিদেশে যান তখন তাকে স্টেশন লিভ করে কোথায় যাচ্ছেন এবং কত দিনের জন্য যাচ্ছেন সেটি বাংলাদেশ সরকারকে জানাতে হয়। বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্রদূত যখন সেই দেশ সাময়িকভাবে ছাড়েন তখন তাকেও অনুরূপভাবে স্টেশন লিভের খবরটি জানাতে হয়।
॥ তিন ॥
মিসেস সাবরিনার বক্তব্যে এটুকু কনফার্মড হলো যে পিটার হাস বাংলাদেশ সাময়িকভাবে হলেও ছাড়ছেন। তিনি কি ওয়াশিংটন যাবেন? যদি যান তাহলে কি সেটি ব্যক্তিগত বা পারিবারিক কাজে ছুটিতে যাচ্ছেন? নাকি ওয়াশিংটন থেকে তাকে জরুরি খবর পাঠিয়ে ওয়াশিংটনে ডাকা হয়েছে? আগেই বলেছি যে আমরা গুজবকে ছাড়তে চাইলে কি হবে, গুজব তো আমাদেরকে ছাড়ে না। তাই তার কলম্বো বা ওয়াশিংটন যাত্রার খবর ছাপিয়ে আরেকটি গুজব পত্র পল্লবে সুশোভিত হয়ে ওঠে। সেটি হলো, বাংলাদেশ যেভাবে ডোনাল্ড লু তথা মার্কিন সরকারের আলোচনার প্রস্তাব পত্রপাঠ নাকচ করে দিয়েছে সেটিকে ওয়াশিংটন ভালভাবে নেয়নি। অনুরূপভাবে ডোনাল্ড লুর চিঠি পাওয়ার সাথে সাথে বাংলাদেশ সরকার যেভাবে আলোচনার সমস্ত পথ, বিশেষ করে মার্কিন উদ্যোগে যে আলোচনার চেষ্টা হয়েছিল, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করে আলোচনার সমস্ত পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এটিকে মার্কিন সরকার সম্ভবত খুব সহজভাবে নেয়নি। তাই গুজব বিলাসীরা বলছেন যে ভিসা স্যাংশনের চেয়েও সম্ভবত আরো বড় কোনো স্যাংশন আসছে।
প্রিয় পাঠক, আমরা গুজব বিলাসী নই। তাই দিল্লীতে অনুষ্ঠিত টু প্লাস টু বৈঠক থেকে শুরু করে বাংলাদেশের নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা এবং পিটার হাসের ওয়াশিংটন গমনের যেসব গুজব ছড়িয়েছিল সেগুলো সত্য নাকি মিথ্যা সে সম্পর্কে আমাদের কোনো মন্তব্য নাই। তবে তড়িঘড়ি করে যেভাবে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে সেটি কতদূর বিজ্ঞজনোচিত হয়েছে সে ব্যাপারে আমাদের সন্দেহ রয়েছে। তফসিল ঘোষণা সম্পর্কে ব্রতি নামক পর্যবেক্ষক সংস্থাটির প্রধান শারমিন মোর্শেদ যেসব প্রশ্ন তুলেছেন সেগুলো বিবেচনার দাবি রাখে বলে আমরা মনে করি। তিনি বলেছেন, আমার ২০ বছরের নির্বাচনী পর্যবেক্ষকের জীবনে এই রকম অসহনশীল সহিংস নির্বাচনী পরিবেশ আমি দেখিনি। এখনকার উত্তপ্ত পরিবেশ কি ইসি অর্থাৎ নির্বাচন কমিশন সামলাতে পারবেন? এরপর তিনি অনেকগুলো প্রশ্ন করেন। তিনি বলেন, ইসি কি জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে? আওয়ামী লীগ যেভাবে জনপ্রশাসনকে দলীয়করণ করেছে ইসি কি সেগুলো অদল বদল করে নিরপেক্ষ করতে পারবেন? হাজার হাজার বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক কর্মী, যারা কারাগারে বিনা অভিযোগে এবং বিনা বিচারে দুঃসহ জীবন যাপন করছেন ইসি কি তাদের মুক্তি দিতে পারবে? যেভাবে আওয়ামী লীগকে আকাশে মুক্ত বিহঙ্গের মতো ছেড়ে দেওয়া হয়েছে সেভাবে কি বিএনপি এবং জামায়াতসহ অন্যান্য বিরোধীদল নির্বাচনী মাঠে অবাধে বিচরণ করতে পারবে? মার্কিনী চাহিদা মোতাবেক অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সমতল ক্ষেত্র প্রয়োজন, ইসি কি সেই ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে পারবে?
১৫ নভেম্বর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন যে তফসিল ঘোষণার পর সরকার শুধু রুটিন কাজগুলো করবে। অন্য কোনো কাজ করবে না। অন্য কথায়, সরকারের অন্য সব কাজ এখন ইসি করবে। তাই যদি হয় তাহলে বিএনপি এবং জামায়াতকে কি প্রকাশ্যে সভা সমিতি ও মিছিল করতে দেওয়া হবে? হরতাল, অবরোধ এবং অবস্থান কর্মসূচী তো গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মসূচী। সেগুলোতে এমনভাবে বাধা দেওয়া হচ্ছে যেন মনে হয় ঐ সব দল কোনো নিষিদ্ধ দল। এই চরম অন্যায় ও চরম অনিয়মের কী বিহিত করবেন জনাব হাবিবুল আউয়াল?
Email: asifarsalan15@gmail.com