পরিশোধিত এবং অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে শুল্ক অর্ধেক কমিয়েছে সরকার। তবুও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে পণ্যটির দাম বাড়িয়েই চলেছেন ব্যবসায়ীরা। দেশের বাজারে সরবরাহ কম এবং পরিবহন খরচ বৃদ্ধিকে দাম বাড়ার কারণ বলছেন ব্যবসায়ীরা। যদিও সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সিন্ডিকেট করে চিনির দাম বাড়ানো হচ্ছে। বাজারে প্যাকেটজাত চিনির দাম গায়ে ১৩৫ টাকা লেখা থাকলেও বিক্রি হচ্ছে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকা দরে। এক সপ্তাহ আগে চিনির কেজি ছিল ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা। সপ্তাহের ব্যবধানে খোলা চিনির কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকা। এদিকে মিল মালিকরা প্রতি কেজি চিনিতে ১০ টাকা বাড়ানোর বিষয়ে একটি প্রস্তাব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, মিল মালিকরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা চিনির বাজার অস্থির করে তুলেছেন। আমদানি শুল্ক কমানোয় বাজারে চিনির মূল্য না কমে উল্টো পাইকারি পর্যায়ে ৭ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
আর খুচরা বাজারে বেড়েছে ৫ টাকা।
প্রায় দুই সপ্তাহ আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চিনি আমদানিতে শুল্ক কমিয়ে অর্ধেক করলেও বাজারে পণ্যটির দাম কমেনি। এ ছাড়া সরকার ও চিনি বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যতবার চিনির দর নির্ধারণ করে দিয়েছে, তা একবারও কার্যকর হয়নি। প্রায় আড়াই মাস আগে খোলা চিনির কেজি ১৩০ এবং প্যাকেটজাত চিনির কেজি ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু বাজারে বিক্রি হচ্ছে এর চেয়ে বেশি দামে।
গত ১লা নভেম্বর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রতি টন অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে শুল্ক ৩ হাজার টাকা থেকে কমিয়ে দেড় হাজার টাকা এবং পরিশোধিত চিনি আমদানিতে শুল্ক ৬ হাজার টাকা থেকে কমিয়ে ৩ হাজার টাকা করেছে। ২০২৪ সালের ৩১শে মার্চ পর্যন্ত এই শুল্কহার বলবৎ থাকবে। দাম যেন ক্রেতার নাগালে থাকে, সেজন্যই শুল্ক কমিয়েছে সরকার। কিন্তু এরপর বাজারে পণ্যটির সরবরাহ বাড়েনি। এমনকি দামও কমেনি। আবার বেশি দাম দিয়েও অনেক ক্ষেত্রে চিনি কিনতে পাওয়া যাচ্ছে না। বাজারে বেশির ভাগ খুচরা দোকানে পাওয়া যাচ্ছে না চিনি। কাওরান বাজারে এসেছেন ক্রেতা হানিফ। তাকে একের পর এক দোকানে চিনি খুঁজতে দেখা যায়। হানিফ বলেন, পাঁচটি দোকানে দেখলাম; কিন্তু চিনি পেলাম না।
চিনি বিক্রেতা হোসেন মিয়া বলেন, হঠাৎ করে পাইকারি বাজারে চিনির দাম বেড়েছে। আমাদের বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এ কারণে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চিনি ১০-১৫ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।
কাওরান বাজারের মেসার্স সালমান ট্রেডার্স-এর বিক্রেতা আবদুল্লাহ জানান, একদিন আগেই তাদের চিনি শেষ হয়েছে। তিনি বলেন, চিনির প্যাকেটের গায়ে লেখা থাকে ১৩৫ টাকা কেজি। তবে পাইকারি কিনতে হয় ১৩৭ টাকা। তাই এখন চিনি দোকানে রাখি না। অনেক সময় ম্যাজিস্ট্রেট এসে প্যাকেটের গায়ের দামের চেয়ে বেশি দাম রাখায় জরিমানা করে। তাই অনেক দোকানে চিনি পাওয়া যাচ্ছে না।
কাওরান বাজারে ১৫টি দোকানের মধ্যে পাঁচটি দোকানে চিনি বিক্রি করতে দেখা গেছে। এই বাজারের আনোয়ার ট্রেডার্সের বিক্রেতা শামীম বলেন, আমাদের খোলা চিনি কেনা ১৩৭ টাকা করে। এরপর দোকানে আনতে পরিবহন খরচ আছে। তাই আমরা ১৪৫ টাকা কেজিতে বিক্রি করি। গত এক সপ্তাহে পাইকারিতে ৫০ কেজির বস্তা প্রতি চিনির দাম বেড়েছে ৪৫০ টাকা। এখন ৫০ কেজির বস্তা ৬৮৫০ টাকা। কিন্তু এক সপ্তাহ আগেও এর দাম ছিল ৬৪০০ টাকা। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা বাজারে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকায় চিনি বিক্রি হচ্ছে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এক বছর আগে এই সময় চিনির দাম ছিল প্রতি কেজি ১০৫ থেকে ১১৫ টাকা। টিসিবি’র তথ্যমতে, চিনির খুচরা দাম গত এক মাসের ব্যবধানে ৩.৭৭ শতাংশ বেড়েছে। এক বছরের ব্যবধানে এই হার আরও অনেক বেশি। এক বছরে চিনির দাম বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ।
দেশে চিনি বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সিনিয়র সহকারী ব্যবস্থাপক তাসলিম শাহরিয়ার বলেন, কারখানায় গ্যাসের চাপ কমায় উৎপাদন কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে। এ ছাড়া বিশ্ববাজারে দাম আবারো বেড়েছে। ডলারের দামও বেড়েছে অস্বাভাবিক। এ কারণে বাজারে চিনির সরবরাহ কমছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশে বছরে ১৮ থেকে ২০ লাখ টন চিনির চাহিদা রয়েছে। এরমধ্যে এক লাখ টনের মতো চিনি দেশে উৎপাদিত হয়। বাকি চিনি ভারত, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়। এসব দেশ থেকে পরিশোধিত এবং অপরিশোধিত দুই ভাবেই চিনি আমদানি করা হয়।
কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম স্বাভাবিক, দেশের সরবরাহ স্বাভাবিক। একই সঙ্গে কমানো হয়েছে শুল্ক। এতদিন তারা দাবি করছিল শুল্ক কমানোর। এরপরেও দাম বাড়ার মানে হলো সিন্ডিকেট। বাজারে দাম অন্তত স্বাভাবিক থাকার কথা, কিন্তু উল্টো দাম বেড়েছে।