গতকাল ছিল উপকূলের ভয়ংকার গতকাল ১২ নবেম্বর। ১৯৭০ সালের এ দিনে মহা প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস ভোলাসহ উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড় সমূহের মধ্যে এটি ছিল অন্যতম। এই ঘূর্ণিঝড়ে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের হিসেবেই পাঁচ লাখ মানুষ নিহত হওয়ার কথা স্বীকার করা হয়েছিল। কিন্তু বেসরকারি হিসেবে মৃত্যু সংখ্যা ছিল কমপক্ষে দশ লাখ। সেই ভয়াবহ স্মৃতি নিয়ে আজো বেঁচে আছেন অনেকে। স্বজন হারানো সেই বিভীষিকাময় দিনটি মনে পড়তেই আঁতকে উঠছেন কেউ কেউ। সেই দিনের সেই ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারি এখনো অনেকে। ঘূর্ণিঝড়ের পর বঙ্গবন্ধুর গঠিত ত্রাণকমিটির তৎকালীন ভাইস চেয়ারম্যান হাজী নুরুল ইসলামের মতে ঝড় থেমে যাওয়ার পর দেখি চারিদিকে শুধু লাশ আর লাশ, লাশের গন্ধে মানুষ কাছে যেতে পারেনি। ২০-৩০ ফুটের জলোচ্ছ্বাসের কারণে লাশ মাটি দেওয়া যায়নি। এছাড়া ১৯৮৮ সালের ১৪ নবেম্বরে উপকূলের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারায় ১১ হাজার ৬৮৩ জন। সব মিলিয়ে দিনটি স্মরণে আলোচনাসভা, সেমিনার, কোরআনখানি ও মিলাদ মাহফিল আয়োজন করা হয়েছে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে। দাবি উঠেছে ১২ নবেম্বরকে “উপকূল দিবস” ও “বিশ্ব উপকূল দিবস” ঘোষণা করা হোক।
বঙ্গোপসাগরে জন্ম নেয়া ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। গত ২০০ বছরে পৃথিবীর ৪২ শতাংশ ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় তান্ডব চালিয়েছে বাংলাদেশে। গত ২০০ বছরে বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ গেছে বাংলার ২০ লাখ মানুষের। জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) এ ঘূর্ণিঝড়কে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড় হিসেবে উল্লেখ করেছে। ১৯৭০ সালের ১২ নবেম্বর সন্ধ্যা থেকে ১৩ নবেম্বর ভোর পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়টি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ১৮৫ কিলোমিটার।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার মতে, বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তিস্থল বঙ্গোপসাগর। মূলত বঙ্গোপসাগরের ত্রিভুজ আকৃতি এবং ভৌগলিক অবস্থানের কারণেই সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের সবচেয়ে বড় শিকারে পরিণত হয়ে আসছে বাংলাদেশ। বিশেজ্ঞরা বলছে, আপাতদৃষ্টিতে বঙ্গোপসাগর এক শান্ত সুনীল বিস্তীর্ণ জলরাশি হিসেবে মানুষের চোখে ধরা পড়লেও বিশ্বের ইতিহাসে যত ভয়ংকর সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হেনেছে, তার বেশিরভাগেরই উৎপত্তিস্থল এই সমুদ্র।‘ওয়েদার আন্ডারগ্রাউন্ড’ নামের একটি ওয়েবসাইটে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর ৩৬টি মৌসুমী ঘূর্ণিঝড়ের তালিকায় ২৬টি ঘূর্ণিঝড়েরই উৎপত্তিস্থল বঙ্গোপসাগরে। তারা বলছে বিশ্বের মোট মহাসাগরীয় অঞ্চলের মাত্র শূন্য দশমিক ছয় শতাংশ স্থান অধিকার করে আছে বঙ্গোপসাগর। কিন্তু এর তটরেখা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ সমুদ্র উপকূল সেখানে বাস করে প্রায় অর্ধশত কোটি মানুষ। তাই ঘূর্ণিঝড়ে হতাহতের ঘটনাও বেশি হয় এই সমুদ্রকে ঘিরে। আর এর প্রধান কারণ জলোচ্ছ্বাস। আবহাওয়াবিদদের মতে,সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস সবচেয়ে ভয়ংকর হয়ে ওঠে অবতল আকৃতির অগভীর বা উপসাগরে। বঙ্গোপসাগরের জলোচ্ছ্বাসের কারণও সেটাই।
বিশেজ্ঞরা বলছে, উপকূলের সংকট, সমস্যা, সম্ভাবনা এবং উপকূলের মানুষের অধিকার ও ন্যায্যতার দাবি আদায়ে উপকূলের জন্য একটি বিশেষ দিন অপরিহার্য। কেননা উপকূলের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ, উপকূলকে প্রাকৃতিক বিপদ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবমুক্ত রাখা, উপকূলের দিকে নীতিনির্ধারণী মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ, উপকূলের মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা, উপকূলের সকল সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক বিকাশের ধারা সুগম করা, উপকূলের দিকে দেশী-বিদেশী প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার নজর বাড়ানো, উপকূলের ইস্যুগুলো জাতির সামনে সহজে তুলে ধরাসহ ৭০ সালের ১২ নবেম্বরের সাইক্লোনে নিহতদের স্মরণে ‘উপকূল দিবস’ দাবি প্রাসঙ্গিক।
প্রসঙ্গত, কক্সবাজারের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ এবং পশ্চিমে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের কালিঞ্চি গ্রাম পর্যন্ত উপকূলের প্রায় ৫ কোটি মানুষ প্রতনিয়তই বহুমূখী দুর্যোগের সঙ্গে বসবাস করেন।