জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের বিশ্বজনীন পর্যায়ক্রমিক পর্যালোচনায় (ইউপিআর) বাংলাদেশ সরকারকে অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা এবং বিরোধী মতের অধিকারকে সমুন্নত রাখা, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণকে তাদের নেতা নির্বাচনের সুযোগ দেয়া এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের জবাবদিহিতা, তদন্ত ও বিচারের আওতায় আহ্বান জানানো হয়েছে। বাংলাদেশকে গুমবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদ সই করার তাগিদ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া মৃত্যুদণ্ড রোহিত করা, নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা এবং বৈষম্য রোধবিষয়ক জাতীয় কর্মপরিকল্পনা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন, বাল্যবিয়ে বন্ধ এবং সর্বস্তরে শিক্ষার বিস্তারে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়া জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করা হয়েছে।
গতকাল জেনেভায় জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে বাংলাদেশবিষয়ক চতুর্থ ইউপিআর অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী আনিসুল হক। ইউপিআরে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব, চীন, রাশিয়া, ভারতসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দেশের প্রতিনিধি অংশ নিয়ে বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে তাদের মতামত ও সুপারিশ তুলে ধরেন। পর্যালোচনার পর বাংলাদেশ সংক্রান্ত ইউপিআরের সুপারিশগুলো আগামীকাল বুধবার গ্রহণ করা হবে।
ইউপিআরে অংশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি বলেন, বাংলাদেশের মানুষের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের আকাক্সক্ষাকে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করে। আমরা বাংলাদেশ সরকারকে অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা এবং বিরোধী মতের অধিকারকে সমুন্নত রাখার আহ্বান জানাই। সহযোগিতার চেতনায় আমরা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণকে তাদের নেতা নির্বাচনের সুযোগ দেয়ার আহ্বান জানাই। গণমাধ্যম, মানবাধিকার ও শ্রম অধিকার সমুন্নত রাখার জন্য কাজ করার অধিকার কর্মী ও অন্যদের মত প্রকাশ ও সমাবেশের জন্য বিচারের মুখোমুখি করা উচিত না। একই সাথে সব ব্যক্তির জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের জবাবদিহিতা, তদন্ত ও বিচারের আওতায় আনাটা জরুরি।
অস্ট্রেলিয়ার প্রতিনিধি বাংলাদেশে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। দেশটি সুষ্ঠু ও অবাধ জাতীয় নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছে। একই ধরনের অভিমত ব্যক্ত করেছে স্লোভাকিয়া। অর্জেন্টিনা গুমবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদ সইয়ের জন্য বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সুইডেন মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে। স্পেন মৃত্যুদণ্ডের বিধান রোহিত করা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে। ফরেন ডোনেশন অ্যাক্ট সংশোধনের আহ্বান জানিয়েছে বেলজিয়াম। কানাডা রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে বাংলাদেশের সাথে কাজ করার আগ্রহের কথা জানিয়েছে। দেশটি সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট রোহিত করা, শ্রম নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সনদ অনুযায়ী সমাবেশ ও সিবিএর অধিকার নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে। ডেনমার্ক বাংলাদেশবিষয়ক তৃতীয় ইউপিআরের সুপারিশগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছে। দেশটি পার্বত্য শান্তি চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছে। ফ্রান্স আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে বাংলাদেশের দেয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছে। জার্মানি নির্বাচনের আগে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণœ হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। দেশটি ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের আওতায় দেয়া সব শাস্তি রোহিত করার আহ্বান জানিয়েছে। রোমানিয়া মৃত্যুদণ্ড বিলুপ্ত করার আহ্বান জানিয়েছে। ইউপিআরে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির ইতিবাচক অগ্রগতির প্রশংসা করেছে রাশিয়া। চীন বলেছে, দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক খাতে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে। দেশটি জীবনযাত্রার মান বাড়াতে বাংলাদেশের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছে। ভারত পূর্ববর্তী ইউপিআর বাস্তবায়ন অগ্রগতিকে স্বাগত জানিয়েছে। দেশটি সব ক্ষেত্রে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেয়ার জন্য বাংলাদেশে প্রশংসা করেছে সৌদি আরব। ইন্দোনেশিয়া সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশের পদক্ষেপ অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছে।
ইউপিআরে অংশ নেয়া দেশগুলোর মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও জনগণের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার জন্য বাংলাদেশ সরকার প্রতিশ্রতিবদ্ধ। এ জন্য নির্বাচন কমিশন আইনসহ বেশ কয়েকটি সহায়ক আইন করা হয়েছে। নির্বাচনের সময়ে প্রশাসনের ওপর নির্বাচন কমিশনের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে। তফসিল ঘোষণার পর সরকার কেবল রুটিন কাজ করে। নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য আমরা বিদেশী পর্যবেক্ষকদের স্বাগত জানাচ্ছি। তিনি বলেন, বিরোধী দলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি বাংলাদেশের সংবিধান পরিপন্থী। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়েছে। বিরোধী দলগুলোর জন্য সরকার শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার নিশ্চিত করেছে। তবে গত ২৮ অক্টোবর বিএনপি মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সহিংসতার আশ্রয় নিয়েছে। তাদের দলীয় নেতাকর্মীরা পুলিশকে পিটিয়ে হত্যা করেছে, ঘুমন্ত অবস্থায় মানুষসহ বাস পুড়িয়ে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা করেছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে বিএনপির নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হয়েছে।
আইনমন্ত্রী বলেন, দুর্নীতির অভিযোগে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সাজা হয়েছে। সরকার নির্বাহী আদেশে তার সাজা স্থগিত করে দেশে থেকে চিকিৎসার জন্য মুক্তি দিয়েছে। তিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে উন্নত একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে তার জন্য চিকিৎসক আনার অনুমতি দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, তৃতীয় ইউপিআরে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার সুপারিশ করা হয়েছিল। এর পর থেকে পুলিশের বিরুদ্ধে এক হাজার ২৯৩টি নিয়মিত এবং আট হাজার ৪৮৮টি বিভাগীয় মামলা হয়েছে। এ ছাড়া ছোটখাটো অপরাধের জন্য লক্ষাধিক ব্যবস্থা গ্রহণের নজির রয়েছে। ২০১৪ সালের একটি হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) আটজনের ফাঁসির আদেশ হয়েছে।
বাংলাদেশে মিডিয়া সেন্সরশিপ ছাড়াই পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করছে উল্লেখ করে আইনমন্ত্রী বলেন, শ্রম আইন সংশোধনের জন্য অনেক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কেবল জঘন্য অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে আজীবন কারাদণ্ড দেয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা, নিষেধাজ্ঞা-পাল্টা নিষেধাজ্ঞার জন্য বাংলাদেশ ভুক্তভোগী। ইউক্রেনে যুদ্ধ চলছে। গাজায় সামরিক অভিযান চালাচ্ছে ইসরাইল। তবে এই অভিযানের নামে ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানায় বাংলাদেশ।