নিউমোনিয়া এখনও পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর প্রধান কারণ* ঘরে বাতাসের মান উন্নত করে শিশুর নিউমোনিয়া অর্ধেকে নামানো সম্ভব * হাত ধোয়ার অভ্যাস ২১ শতাংশ নিউমোনিয়া কমাতে পারে * মায়ের দুধে শিশুর নিউমোনিয়া কমে ১৫ ভাগ
ইবরাহীম খলিল : ঘরে বাতাসের মান উন্নত করে নিউমোনিয়ায় শিশুর মৃত্যুঝুঁকি অর্ধেক কমিয়ে আনা যায় বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। একইসাথে শিশুকে মায়ের বুকের শাল দুধ খাওয়াতে পারলে নিউমোনিয়া হওয়ার সম্ভনা শতকরা ১৫ ভাগ কমে যায় বলেও জানিয়েছেন তারা। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআরবির এক গবেষণা প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়।
নিউমোনিয়া হচ্ছে মানুষের ফুসফুসের রোগ। ফুসফুস জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হলে শরীরে অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়। ফলে সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে এর প্রভাব পড়ে। এই রোগে শিশু এবং বৃদ্ধ মানুষ বেশি আক্রান্ত হয়। এই রোগের অন্যতম লক্ষণ হচ্ছে জ্বর, শ্বাসকষ্ট, হাঁপিয়ে ওঠা, ঠোঁট এবং জিহ্বা কালো রঙ ধারণ এবং শ্বাস নেওয়ার সময় শিশুদের বুকের নিচে দেবে যাওয়া। নিউমোনিয়ার লক্ষণ দেখা দিলে খুব দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিতে পরামর্শ দেন গবেষকরা। এতে শিশুর মৃত্যু ঝুঁকি কমে যায় বলে জানান তারা। এব্যাপারে সচেতনতাও খুব জরুরী বলেও মনে করে বিশেষজ্ঞরা।
গবেষণার তথ্য তুলে ধরে আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী ড. চিশতী বলেন, নিউমোনিয়া এখনও বিশ্বব্যাপী পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর প্রধান সংক্রামক কারণ। এ রোগের ফলে প্রতি বছর প্রায় ৭ লাখ শিশুর মৃত্যু হয়, যা পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের সমস্ত মৃত্যুর ১৪ শতাংশ। বাংলাদেশে এ পরিস্থিতি কিছুটা খারাপ। পরিবেশের প্রভাব ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা তুলে ধরে ড. চিশতী বলেন, ঘরের মধ্যে বাতাসের গুণগতমান উন্নত করার মাধ্যমে নিউমোনিয়া মৃত্যুর ঝুঁকি অর্ধেক করা সম্ভব। হাত ধোয়া ২১ শতাংশ কেস কমাতে পারে। শিশুর জন্মের প্রথম ছয়মাস শুধুমাত্র মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো একটি বড় ভূমিকা পালন করে। এর ফলে নিউমোনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা ১৫ ভাগ কমে যায়।
গবেষকরা জানান, নিউমোনিয়ার শুরুতে কাশি হয়, যা সাধারণত ২ থেকে ৪ সপ্তাহের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। তবে কিছু ক্ষেত্রে এর থেকে শ্বাসকষ্ট এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে অল্পবয়সী, প্রবীণ এবং যাদের হৃৎপি- বা ফুসফুসের সমস্যা রয়েছে তাদের গুরুতর নিউমোনিয়া হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এসব ব্যক্তিকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। সচেতনতা ও সঠিক সময়ে চিকিৎসার মাধ্যমে জীবন বাঁচানো সম্ভব হবে।
আইসিডিডিআরবির গবেষণায় দেখা গেছে গর্ভবতীদের আরএসভি ভ্যাকসিন দেয়া হলে তা নবজাতক শিশুদের গুরুতর নিউমোনিয়া এবং হাইপোক্সেমিয়া (রক্তে অক্সিজেনের স্বল্পতা) প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলেও আলোচনা সভায় উঠে এসেছে।
নিউমোনিয়া পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর প্রধান সংক্রামক কারণ উল্লেখ করে জানানো হয়, বাংলাদেশে গত ৪/৫ বছর ধরে নিউমোনিয়াতে শিশু মৃত্যুর হার একইরকম। ফলে দেশের টেকসই উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। এতে আরও জানানো হয়, বিশ্বব্যাপী পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর প্রধান সংক্রামক কারণ নিউমোনিয়া। প্রতি বছর প্রায় ৭ লাখ শিশু নিউমোনিয়ায় মৃত্যুবরণ করে। তবে বাংলাদেশে এ অবস্থা আরও খারাপ।
দেশে প্রতি বছর ২৪ হাজার শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায়। প্রতি ঘণ্টায় এ সংখাটি অনুমানিক ২-৩ জন। বিগত কয়েক দশক ধরে মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা সত্ত্বেও গত পাঁচ বছরে প্রতি হাজার জীবিত জন্মে প্রায় ৭ দশমিক ৪ জন শিশু মৃত্যুবরণ করেছে নিউমোনিয়ায়। পাশাপাশি প্রায় ৪০ লাখ নতুন রোগীসহ প্রতি বছর আনুমানিক ৬ লাখ ৭৭ হাজার শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এসময় বাংলাদেশের শিশুদের নিউমোনিয়ার কারণগুলো বৈশ্বিক পরিস্থিতি থেকে একটু আলাদা বলে জানান ড. চিশতী। তিনি বাংলাদেশের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া শিশুদের নিউমোনিয়ার পেছনে বিশেষ কারণ তুলে ধরেন। এতে ২০১৯ এবং ২০২১ সালে আইসিডিডিআর, বি-র গবেষণায় অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী, গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের বিষয়টি উঠে আসে। এ ফলাফলগুলো দেখায় যে বিরল গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া শৈশবকালীন নিউমোনিয়ার নতুন কারণ হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। আইসিডিডিআর,বি-র নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ জানান, ইতিপুর্বে ডায়রিয়া শিশুমৃত্যুর প্রধান ঘাতক হলেও, বর্তমানে নিউমোনিয়া শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ। নিউমোনিয়ায় প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী অনেক শিশু মারা যায়। আক্রান্ত হন প্রাপ্তবয়স্করাও এবং তাদেরও মৃত্যু ঝুঁকি রয়েছে।
দেশে নিউমোনিয়ার সংক্রমণ নিয়ে ২০১৯ এবং ২০২১ সালে আইসিডিডিআর, বি গবেষণা করেছে। তাদের গবেষণায় অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী, গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের বিষয়টি উঠে আসে। এই ফলাফলগুলো দেখায় যে বিরল গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া শৈশবকালীন নিউমোনিয়ার নতুন কারণ হিসাবে আবির্ভূত হচ্ছে। এদিকে নানা আয়োজনে গতকাল পালিত হয়েছে বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস। নিউমোনিয়ার মৃত্যু ও সচেতনতা তৈরির উদ্দেশে ২০০৯ সাল থেকে বিশ্ব জুড়ে দিবসটি পালন হয়ে আসছে। দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য– ‘নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করুন: প্রতিটি প্রশ্বাসই গুরুত্বপূর্ণ’। দিনটি উপলক্ষে নানা কর্মসূচি হাতে নেয় সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।