দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো যখন রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে নিজেদের ব্যবধান ও ভিন্নতা কমিয়ে এনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনায় ব্রতী হয় তাকে বলা হয় রাজনৈতিক সমঝোতা।
যেকোনো দেশের রাজনৈতিক বিকাশ এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে রাজনৈতিক সমঝোতা অপরিহার্য। রাজনৈতিক সমঝোতা একটি দেশের স্থিতিশীলতার পূর্বশর্ত। আমাদের দেশে ১৯৯০ সালের গণআন্দোলনে এরশাদ সরকারের পতন-পরবর্তী গণতন্ত্রের নবযাত্রার সূচনা হয়। রাজনৈতিক সমঝোতায় এরশাদ সরকারের পতন-পরবর্তী কর্মরত প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে অস্থায়ী সরকার গঠন সম্ভব হয়েছিল। সে অস্থায়ী সরকারের সাংবিধানিক বৈধতা না থাকলেও রাজনৈতিক সমঝোতার কারণে ওই সরকার সুচারুরূপে কার্যসম্পাদন করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরপূর্বক বিদায় নিতে সমর্থ হয়েছিল।
আমাদের সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার সন্নিবেশন একতরফা হলেও সংসদের বাইরের রাজনৈতিক সমঝোতা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিল আনয়নের এবং বিলটিকে কার্যকরণের প্রেক্ষাপট রচনা করেছিল। নির্বাচনে কোন দল বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে দেশ পরিচালনা করবে তা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে জনমতের ওপর। জনমতের প্রকৃত প্রতিফলনে প্রয়োজন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। দলীয় সরকার নির্বাচন পরিচালনা করলে সে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা ক্ষুণœ হবে সে বিশ্বাস থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্ম।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দেশে তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই তিন নির্বাচনের মধ্যে সপ্তম ও অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন সংবিধানসম্মতভাবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিল। অপর দিকে, যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করেছিল সেটির কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি ছিল না।
সপ্তম, অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কোনোটিতে অব্যবহিত পূর্বের ক্ষমতাসীন দল বিজয়ী হতে পারেনি। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিরপেক্ষ হলেও নির্বাচনে বিজিত দলের কাছে সে নিরপেক্ষতা গ্রহণযোগ্য ছিল না, যে কারণে তিনটি নির্বাচনের কোনোটিতে বিজিত দলের প্রধান বিজয়ী দলের প্রধানকে অভিনন্দন জানাননি।
আমাদের দেশে ক্ষমতাসীন দলের কার্যকলাপ নিয়ে জনগণ সন্তুষ্ট কী অসন্তুষ্ট সেটি তাদের কাছে অপ্রাসঙ্গিক। তাদের প্রধান বিবেচ্য নিজেদের পুনঃনির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসতে হবে, আর সে ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হিসেবে দেখা হচ্ছে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে। তাই রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া একতরফাভাবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অবসান।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের তিনটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে প্রধান বিরোধী দলের উপলব্ধি জনসমর্থন পক্ষে থাকলেও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ব্যতীত দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তারা কাক্সিক্ষত বিজয় থেকে বঞ্চিত হবেন। এ উপলব্ধি থেকে তারা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে অনড়।
বিষয়টি নিশ্চয় দেশবাসীর বিস্মৃতিতে যায়নি যে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি যুগপৎ আন্দোলন করে হরতাল ও অবরোধের মাধ্যমে দেশের যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন এবং অবকাঠামোর ক্ষতি করে এমন অসহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল যে, তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপির কাছে সংসদে একতরফাভাবে হলেও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাস্তবায়ন ব্যতীত অপর কোনো বিকল্প ছিল না।
আমাদের প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস না থাকায় সব মানুষ শ্রেণীপেশা নির্বিশেষে দ্বিধাবিভক্ত। সম্পদ ও সুযোগের সীমাবদ্ধতা এবং দুর্নীতির কারণে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে কখনো নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী জনমানুষের আকাক্সক্ষা ও চাহিদা পূরণ সম্ভব হয় না। এ কারণে নির্বাচন-পরবর্তী ক্ষমতাসীনদের জনসমর্থনে ব্যাপক ভাটা পরিলক্ষিত হয়।
আমাদের প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি নিজ নিজ দলের শীর্ষ নেতার একক সিদ্ধান্তে পরিচালিত। এ কারণে এসব দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারেনি। এ তিনটি দলের যেকোনো নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ বিষয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা হলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার দলীয় প্রধানের উপর ছেড়ে দেয়া হয়।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় দেখা গেছে, চাটুকারদের দৌরাত্ম্যে উভয় দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে দলের ত্যাগী নেতাকর্মী ও সমর্থকরা মনের কথা বলার এবং দেশের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার সুযোগ পাননি। এর ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, অযোগ্যরা হয়েছে পদ ও পদোন্নতিপ্রাপ্তিতে মূল্যায়িত আর যোগ্যরা হয়েছে বঞ্চিত।
২০০১ সালে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদের মেয়াদ অবসান-পরবর্তী বড় দু’টি দলের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতার অনুপস্থিতিতে জনআকাক্সক্ষায় সেনাসমর্থিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আবির্ভাব ঘটে। বর্তমান ক্ষমতাসীনদের ভূমিধস বিজয়ে সে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে কোন দেশ ও কারা নেপথ্য থেকে পরিচালিত করেছিল সে সত্য আজ আর অজানা নয়।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ২০০৯ সালের ক্ষমতাসীন হলে শেয়ারবাজার, কুইক রেন্টাল, বিদু্যুৎ, জ্বালানি, টেলিযোগাযোগ, পদ্মা সেতু, রেলের কালো বিড়াল, হলমার্ক, ডেসটিনিসহ নানামুখী দুর্নীতিতে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। ভোটের হিসাবে এর নেতিবাচক প্রভাব কী হতে পারে সেটি বিবেচনায় নিয়ে তারা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলপূর্বক দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের সাংবিধানিক বিধি-বিধান সম্পন্ন করে। এরপর থেকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হতে থাকে। ১৯৯৬ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাস্তবায়নকালীন দেশে যে অসহনীয় পরিস্থিতি বিরাজ করছিল বর্তমানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল-পরবর্তী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃবাস্তবায়নে একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ বাস্তবতায় রাজনৈতিক সমঝোতা জরুরি হয়ে পড়েছে।
রাজনৈতিক সমঝোতা বিষয়ে ফিরে তাকালে দেখা যায়, ১৯৯০ সালে দু’টি বৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছাতে পারার কারণে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এরশাদ সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব হয়েছিল এবং এরপর রাজনৈতিক সমঝোতার কারণে কর্মরত প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে অস্থায়ী সরকার গঠনপূর্বক অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্ভব হয়েছিল। এরপর জাতীয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বড় দু’টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছানোর কোনো নজির নেই। ১৯৯৬ সালে দেখা গেছে, উভয় দলের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা, এমনকি বিদেশীদের মধ্যস্থতা রাজনৈতিক সমঝোতার পথ প্রশস্ত করতে পারেনি।
এখন প্রশ্ন- রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে বিকল্প কী হতে পারে? সাংবিধানিক বিধি-বিধানের আলোকে আমরা যদি বিকল্প খুুঁজে দেখার চেষ্টা করি তাহলে প্রথম বিকল্প হতে পারে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী আনয়ন-পরবর্তী সংশোধিত ১২৩ অনুচ্ছেদের বিধানাবলির আলোকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন। সে ক্ষেত্রে মেয়াদ অবসানে সংসদ ভেঙে গেলে ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে আর যদি মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে যায় সে ক্ষেত্রে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে। সংসদ বহাল রেখে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলে একজন সংসদ সদস্যের পদ প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদ হওয়ায় তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচনে কিভাবে অংশগ্রহণ করবেন সে বিষয়টির সুরাহা জরুরি হলেও ইতোপূর্বে অনুষ্ঠিত দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। দেশের বিরাজমান বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি যদি দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে সে ক্ষেত্রে দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সে নির্বাচন কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে আর সে সরকারের স্থায়িত্ব বা কতদিন হবে সে বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়া একান্ত প্রয়োজন মর্মে অনুভূত হয়।
বর্তমান ক্ষমতাসীনদের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হলে এবং নিজেদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সঙ্ঘাত এড়াতে চাইলে এখনই তাদের উচিত হবে ১৯৯৬ সালের একতরফাভাবে সংসদে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিল এনে বিএনপি যে উদারতা দেখিয়েছিল সে উদারতার আলোকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিল এনে দেশকে সম্ভাব্য বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করা।
বর্তমান ক্ষমতাসীনরা একক উদ্যোগে রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেছিল। তাই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনেও তাদের একক উদ্যোগ নিতে হবে। এর ব্যত্যয়ে গণআন্দোলনের মুখে জনআকাক্সক্ষার চাপে বর্তমান ক্ষমতাসীনরা পদত্যাগে বাধ্য হতে পারে অথবা অসাংবিধানিকভাবে দেশ শাসনের পথ সুগম হতে পারে। গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হলে দেশ ও জনগণের স্বার্থের কথা চিন্তা করে রাজনৈতিক সমঝোতাই হতে পারে সাংবিধানিক শাসন অব্যাহত রাখার একমাত্র পাথেয়।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail : iktederahmed@yahoo.com