ফাইল ছবিদেশে আলুর বার্ষিক চাহিদা ৯০ লাখ টনের কিছু বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ কোটি ৪ লাখ টন আলু উৎপাদনের তথ্য দিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। সে হিসাবে চাহিদার চেয়ে উদ্বৃত্ত আলু আছে দেশে। তারপরও সম্প্রতি আলুর দাম রেকর্ড করেছে বাজারে। এর পেছনে হিমাগার গেটে আড়তদারদের কারসাজি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফা করার প্রবণতাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত অক্টোবরের শেষ ১০ দিন দেশের বিভিন্ন এলাকায় খুচরা পর্যায়ে আলুর কেজি ৮০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। বাজার বেসামাল হয়ে পড়লে একপর্যায়ে সরকার প্রথমে আলুর দাম নির্ধারণ করে দেয়। এতেও কাজ না হওয়ায় পরে ভারত থেকে আলু আমদানির অনুমতি দেয়। এরপর কয়েক দিন দাম কমতে শুরু করে। তবে ডলারের দাম বাড়ার অজুহাতে তিন দিন ধরে আবারও বাড়তে শুরু করেছে কৃষিপণ্যটির দাম। গতকাল ঢাকার বিভিন্ন বাজারে খুচরা পর্যায়ে আলু ৫৫ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে। রাজধানী ঢাকায় পাইকারি আলু বিক্রির সবচেয়ে বড় স্থান শ্যামবাজার।
গতকাল শ্যামবাজারের পাইকারি আলু ব্যবসায়ী মেসার্স কাজী এন্টারপ্রাইজের স্বপন কুমার দাশ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ডলারের দাম বাড়ায় আলুর দাম আবার বাড়তে শুরু করেছে। দেশি আলু ৪০-৪২ টাকা, রাজশাহীর আলু ৪৫-৪৬ টাকা, আর ভারতীয় আলু ৩২-৩৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এই ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, রাজশাহীর আলুর চাহিদা বেশি, ভারতীয় আলুর কম।
পাঁচ হাত ঘুরে বাড়ছে দাম
চলতি বছরের মার্চে মৌসুমের শুরুতেই জমিতে প্রায় ১৫০ মণ আলু পেয়েছিলেন মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার উত্তর আবিরপাড়ার কৃষক বাদল শেখ। মাঠ থেকেই সে আলু ১২ টাকা কেজি দরে ছোট ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেন তিনি। ছোট ব্যবসায়ীরা ওই আলু ১৫ থেকে ১৭ টাকা দামে বেচেন আড়তদারদের কাছে। আড়তদার তা মজুত করেন হিমাগারে। এ ক্ষেত্রে এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আলু মজুত করতে হিমাগারমালিককে দিতে হয় কেজিপ্রতি সাড়ে ৫ টাকা। সে হিসাবে ক্রয়মূল্য হিমাগার খরচসহ প্রতি কেজি আলুতে আড়তদারের খরচ পড়ে সর্বোচ্চ ২২ টাকা। অথচ এই আলুই গত অক্টোবরের শেষ দিকে ৫০ থেকে ৫২ টাকা দামে বিক্রি করেছেন তাঁরা। সর্বশেষ গতকাল সোমবারও হিমাগারের গেটে আড়তদারের কাছ থেকে ৪০-৪২ টাকা দরে আলু কিনেছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা।
পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, তাঁরা পরিবহন খরচসহ কেজিপ্রতি ২ টাকা যোগ করে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে আলু ছেড়ে দেন। মূলত খুচরা বাজারে গিয়েই চড়ে আলুর দাম। ক্ষেত্রবিশেষে খুচরা ব্যবসায়ীরা আলু কেজিতে ৫ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত লাভ করেছেন এবার।
সিরাজদিখান উপজেলার পাইকারি ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শামীম হোসেন বলেন, ‘আমরা কেজিতে পাইকারি ৫০ পয়সা লাভ হলেই ছেড়ে দিই। খুচরা ব্যবসায়ীরা ৫ টাকা লাভ করলেই হয়, কিন্তু তাঁরা ১৫-২০ টাকা লাভ করেন। কখনো তার চেয়ে বেশি।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘দেশে আলুর উৎপাদন স্বাভাবিক রয়েছে। যে পরিমাণ আলু আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, তার খুব কম অংশই আমদানি করা হয়েছে। এতে বোঝা যায় বাজারে পর্যাপ্ত আলু আছে। নতুন আলুও আসা শুরু হয়েছে। তবু দাম নিয়ে নয়ছয় করা হচ্ছে।’
নির্দেশনা মানছে না হিমাগারমালিক ও ব্যবসায়ীরা
বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার গত ১৪ সেপ্টেম্বর পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে আলুর দাম নির্ধারণ করে দেয়। কেজিপ্রতি আলুর পাইকারি মূল্য নির্ধারণ করা হয় ২৬-২৭ টাকা। আর খুচরা বাজারে আলুর দাম নির্ধারণ করা হয় ৩৫-৩৬ টাকায়। সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বশীল সংস্থা হিমাগার ও পাইকারি বাজারগুলোতে সরকার-নির্ধারিত দামে বিক্রির বিষয়ে বিশেষ বিজ্ঞপ্তি ঝুলিয়ে দেয়। কিন্তু রংপুর, বগুড়া ও মুন্সিগঞ্জের কয়েকটি হিমাগার ঘুরে সরকারের নির্দেশনার বাস্তবায়ন চোখে পড়েনি। বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার আর অ্যান্ড আর হিমাগারে গতকাল সরকার-নির্ধারিত দামের চেয়ে ১০ টাকা বেশি দামে অর্থাৎ ৩৫-৩৬ টাকা দামে পাইকারি আলু বিক্রি করা হয়েছে। কাউকে পাকা রসিদও দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া ‘ভারত থেকে আলু আমদানি বন্ধ’—এমন গুজব ছড়িয়ে বাজারে আলুর দাম আরও বাড়ানোর চেষ্টা করছেন ব্যবসায়ীরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হিমাগার থেকে বেশি দামে আলু বিক্রির প্রভাব সরাসরি পড়ছে খুচরা বাজারে। নির্ধারিত দামের চেয়ে বাজারে বেশি দামে আলু বিক্রি করা হলেও সরকার তা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। রংপুরের তারাগঞ্জের সিনহা হিমাগারের ব্যবস্থাপক দুলাল হোসেন বলেন, হিমাগারে আলু মজুত আছে ৯২৯ টন। এর মধ্যে খাওয়ার আলু মাত্র ৩৩১ টন। বাকি আলু বীজ হিসেবে রাখা হয়েছে। সংরক্ষণকারীরা এসব আলু বেশি দামে বিক্রির আশায় এখনো বের করছেন না।
গত সপ্তাহে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানের শবনম হিমাগারে গিয়ে দেখা যায়, ব্যবসায়ীরা আলু স্তরে স্তরে সাজিয়ে রেখেছেন প্লাস্টিকের বস্তায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হিমাগারটিতে গতকাল পাইকারি দরে আলু বিক্রি হয়েছে ৪০ থেকে ৪২ টাকা। সরকারের নির্দেশনা না মানার কথা শবনম হিমাগারের হিসাবরক্ষক আব্দুর রহমান অকপটে স্বীকারও করেছেন। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সরকারি নির্দেশনা কেউ মানে না, এগুলো বলে লাভ নেই। এসব আইওয়াশ (লোকদেখানো) ছাড়া আর কিছুই না। এখন যে পরিস্থিতি দাঁড়াচ্ছে আলুর দাম মনে হয় আর কমবে না।’
সারা দেশে চার শতাধিক হিমাগারে আলু মজুত করা হয়ে থাকে। হিমাগার মালিক সমিতির সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী মনে করেন, চাহিদা অনুসারে আলুর জোগান না থাকায় আলুর দাম বেড়েছে। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সংকটকে পুঁজি করেই আলুর দাম বেড়েছে। এখন সরকার বলছে আলু আমরা লুকিয়ে রেখেছি। এটা তো লুকিয়ে রাখার জিনিস না। আলু কম আছে, তাই আড়তদারেরা ইচ্ছেমতো ছাড়ছেন।’
কৃষক–ভোক্তা ঠকছে
আলুর বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে গবেষণা কাজে যুক্ত রয়েছেন কৃষি অর্থনীতিবিদ ও ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজের উপাচার্য ড. জাহাঙ্গীর আলম খান। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে কৃষক গড়ে ১২-১৩ টাকা দাম পায়। হয়তো বেশি হলে ১৫ টাকা পর্যন্ত দাম পায়।এর বেশি তাঁরা পান না। এরপর আলুর নিয়ন্ত্রণ আর কৃষকের হাতে থাকে না। আড়তদার ও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট মৌসুমের শেষ দিকে আলু আস্তে আস্তে ছাড়ে। সরবরাহ আসলে কম না, তারাই কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজারের নিয়ন্ত্রণ রাখে। বাজার ব্যবস্থাপনার নৈরাজ্যের কারণে এমনটা হচ্ছে। সরকার এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, ক্ষমতাসীনদের ছত্রচ্ছায়ায় সিন্ডিকেটগুলো হচ্ছে। এতে প্রতিনিয়ত ঠকছে আলুর সাধারণ ক্রেতারা।
আলুর বাজারে সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়ন কেন হচ্ছে না, জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে যে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে, তা মানা হচ্ছে না, সেটা আপনারাও দেখছেন, আমিও দেখছি। সম্প্রতি আলু আমদানির কারণে দাম কিছুটা কমছে। এখন আবার বাড়ছে। ব্যবসায়ীদের তো অজুহাতের শেষ নেই।’ তবে বাজার স্থিতিশীল রাখতে স্থানীয় প্রশাসনকে পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।