আমরা সাংবাদিকরা বহু চোখে দেখি। খালি চোখে, ক্যামেরার চোখের সিসিটিভির ফুটেজ থেকে, কাগজে বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে খবর সংগ্রহ করি। খবর দেখি। কোনো ঘটনা সম্পর্কে ধারণা পাই। খবর পাই। খবর সত্য বা মিথ্যা সেটি খতিয়ে দেখার সুযোগ পাই।
বাংলাদেশে ইলেকট্রনিক বা প্রিন্ট মিডিয়া সব সরকারের স্বার্থরক্ষায় ব্যতিব্যস্ত। যে নিউজ ছাপলে সরকারের দোষ বা দুর্নাম হতে পারে সেগুলো মিডিয়া কৌশলে এড়িয়ে চলে। কিংবা একেবারে বিপরীত চিত্র তুলে ধরে। কখনো কখনো, কেন বলতে পারি না, বড় বড় দুর্নীতিবাজ বা ব্যাংক ডাকাতকে প্রমোট করে। আবার প্রতিটি মিডিয়া, ইলেকট্রনিক বা প্রিন্ট, কোনো না কোনোভাবে সরকারের মন্ত্রী, এমপি বা প্রভাবশালীরা নিয়ন্ত্রণ করে, বা তাদের মালিকানাধীন। ফলে এই স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের কোনো দুর্বলতার খবর প্রকাশ হয় না বললে চলে।
সরকারের জন্য মিডিয়ার পক্ষপাত কখনো একেবারে হাস্যকর পর্যায়ে চলে যায়। একবার এক পত্রিকার সম্পাদক রাজউকের সাথে কিছু একটা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। ওই সম্পাদকের একটি টিভি চ্যানেলও রয়েছে। রাজউকের সাথে এ ঝামেলায় রাজউক প্রতিপক্ষ তার গুলশানের বাড়ির বহিরাংশ গুঁড়িয়ে দেয়। আমি বিরোধীদলীয় পত্রিকা দিনকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। একজন সম্পাদকের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেয়াকে আমি স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারিনি। তাই নিউজটি যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে ছেপে দেই। কিন্তু পরদিন দেখলাম সরকারঘেঁষা ওই পত্রিকায় বাড়ি ভেঙে দেয়ার খবরটি এক লাইনও প্রকাশিত হয়নি। এমনকি তার টিভি চ্যানেলেও নিউজটি কাভার করা হলো না। সকাল বেলা পত্রিকা দেখে আমি বোকা বনে গেলাম। শুধু ওই সম্পাদকের পত্রিকা নয়, সরকার সমর্থক কোনো পত্রিকায় খবরটি বিস্তারিত ছাপা হয়নি। ভাবলাম, ওই সম্পাদক হয়তো সীমানার বাইরে খানিকটা জায়গা দখল করে ভবনের আয়তন বাড়িয়ে ছিলেন। সে ক্ষেত্রে ভেঙে দেয়াই তো স্বাভাবিক। ফলে অন্য পত্রিকাগুলোর কাছে সেটি সংবাদ মনে হয়নি।
ধরা যাক তখন আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপি ক্ষমতায়। সে সময় যদি রাজউক তার বাড়ি ভেঙে দিত তাহলে সরকারের উচ্ছিষ্টভোগী সাংবাদিকরা কী তুলকালামই না করতেন। সভা-সমাবেশ, বক্তৃতা-বিবৃতি, মানববন্ধনে সয়লাব হয়ে যেত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমরা কিল খেয়ে কিল হজম করতে দেখলাম। শয়তানের কাছে আত্মা বিক্রি করে দিলে মানুষের এই পরিণতিই হয়।
গত ২৮ অক্টোবর দেশব্যাপী বিরোধী দলগুলো হরতাল ডেকেছিল। ওই হরতালে পুলিশের গুলিতে কমপক্ষে চারজন মানুষ নিহত হন। একজন পুলিশ সদস্যও মারা যান। আহত হন কয়েকজন পুলিশ সদস্য। যানবাহনে আগুন দেয়ার ঘটনাও ঘটে। তার মধ্যে একটি যানবাহন ছিল পুলিশ হাসপাতালের ভেতরে। সেটি ছিল অ্যাম্বুলেন্স। পুলিশ হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে গাড়িতে আগুন দিয়ে কোনো বিএনপি কর্মীর পক্ষে নির্বিঘেœ পালিয়ে যাওয়া কি সম্ভব ছিল? আওয়ামীপন্থী সাংবাদিকরা টেলিভিশন টকশোতে এসে ‘পুলিশের ওপর হামলার প্রতিবাদে কাঁদো কাঁদো হয়ে গলা কাঁপিয়ে বক্তব্য দিলেন।’ কিন্তু একবারও পুলিশের গুলিতে নিহত চার ব্যক্তির কথা বললেন না।’ বললেন না পুলিশি হামলায় ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হাতে আহত ডজন ডজন মানুষের কথা। এর আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও একই ধরনের বক্তব্য দিলেন।
তার চেয়েও বড় ঘটনা প্রবীণ সাংবাদিক রফিক ভুইয়ার নিহত হওয়ার ঘটনা। রফিক ভুইয়া আওয়ামী ঘরানার সাংবাদিক ছিলেন। ভিন্নমত-পথের লোক হলেও আমার সাথে তার সুসম্পর্ক ছিল। বিরোধী দলের হরতালের মধ্যে তিনি তার মাদারটেকের বাসা থেকে রিকশা করে প্রেস ক্লাবের দিকে আসছিলেন। বিজয় নগরে পুরোনো রাজস্ব ভবনের কাছে এলে পুলিশের এলোপাতাড়ি টিয়ার শেল নিক্ষেপে একটি শেল এসে তার গায়ে লাগে এবং তিনি রিকশা থেকে পড়ে যান। সেখান থেকে তাকে বারডেম হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। কিন্তু আওয়ামীপন্থী সাংবাদিকরা সভা-সমাবেশ করে বলার চেষ্টা করলেন যে, বিরোধী দলের পিকেটারদের হাতে আহত হয়ে রফিক ভুইয়ার মৃত্যু হয়েছে। দলকানা সাংবাদিকরা এভাবে হয়তো নিজের কোনো স্বজন মারা গেলেও সরকারের দোষ ঢাকার চেষ্টা করবেন। এগুলো সাংবাদিক সমাজকে ছোটই করছে। আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে।
হরতালের দিনগুলোতে সরকার ইনটারনেট বন্ধ করে দিয়েছিল। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে যে খবর প্রচারিত হচ্ছিল তার মধ্যে ন্যূনতম বিশ্বাসযোগ্যতাও ছিল না। রিপোর্টাররা মাইক্রোফোন হাতে বলছিলেন বিরোধী দল হরতাল ডাকলেও জনগণ তাতে সাড়া দেয়নি। যান চলাচল ছিল স্বাভাবিক। আমি যেখানে থাকি সেখান থেকে মিরপুর রোডের প্রায় এক কিলোমিটার পর্যন্ত দেখা যায়। জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে দেখি বাস, ট্রাক নেই হঠাৎ দু-একটি রিকশা, ১০-১৫ মিনিট পর একটি গাড়ি, কিছু সিএনজি, অটোরিকশা। এই হলো যান চলাচল স্বাভাবিকের নমুনা। যে রিপোর্টার বিভিন্ন জেলা রিপোর্ট করছিলেন এবং বলছিলেন যে, হরতালে সাড়া মেলেনি। তার সাথে যখন ফুটেজ দেখাচ্ছিলেন তাতে দেখা যাচ্ছিল- ধু ধু সড়ক, কোনো যানবাহন নেই। এই নিয়ে প্রায় প্রতিযোগিতা করে টিভি চ্যানেলগুলো বলছিল, হরতাল হয়নি।
অন্যান্য সময় এ ধরনের নিউজের ক্ষেত্রে টিভি চ্যানেল বা সংবাদপত্র বলে যে, বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীরা পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছিল। তাদের হাতে ছিল লাঠিসোটা। কিন্তু ফুটেজ যখন দেখাচ্ছিল তখন আমরা দেখেছি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হাতে বাঁশ কিংবা গজারির লাঠি। এসব লাঠির মিছিল যাতে শুরুতে দেখা না যায় সেজন্য এবার নেয়া হয়েছিল ভিন্ন কৌশল, বাস ভর্তি করে এসব লাঠি আনা হয়েছিল আওয়ামী শান্তি সমাবেশকারীদের জন্য। বাসগুলো এসে নীরবে নামিয়ে দিচ্ছিল লাঠিগুলো। সেগুলো দিয়ে বিএনপির মিছিলে হামলা করা হয়েছিল। সে কারণে আক্রমণের সময় আওয়ামী কর্মী প্রায় প্রত্যেকের হাতে কাঁচা বাঁশের লাঠি দেখা গেছে।
আওয়ামী নেতারা আগে থেকে ২০০৬ সালের লগি-বৈঠার আন্দোলনের মতো মোটা মোটা লাঠি নিয়ে দলীয় কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশে ১০-১৫ লাখ লোক সমবেত হয়েছিল। আওয়ামী লীগ সভা ডেকেছিল বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে। কিন্তু গোলযোগের শুরু হয় শান্তিনগর এলাকায়। আওয়ামী লীগের হেলমেট বাহিনী আকস্মিকভাবে ওই এলাকায় বিএনপির সমাবেশের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায়। বিএনপি চাইলে এখানে ব্যাপক রক্তারক্তি করতে পারত। কিন্তু বিএনপি নেতারা শান্তিপূর্ণ সমাবেশের যে আহ্বান জানিয়েছিলন, কর্মীরা তা মেনে নিয়েছিলেন। সরকার মির্জা ফখরুল, আমীর খসরু ও মির্জা আব্বাসসহ বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেফতার করে। ভেবেছিল এতে পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। কিন্তু বিরোধী দলগুলো যখন দেশব্যাপী ৩১, ১ ও ২ তারিখে তিন দিনের অবরোধ ডাকল তখন দেখা গেল আরো ব্যাপক হারে নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ অবরোধে শরিক হচ্ছেন।
ডিবির জ্যাকেট পরে যারা পুলিশের সামনে গাড়িতে আগুন দিয়েছিল, পুলিশ তাদের ধরেনি। অপকর্ম শেষে তারা ফিরে এসে পুলিশের সাথে মিশে গিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বৃহস্পতিবার সাংবাদিক নির্যাতন ও পুলিশ হত্যার ঘটনা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তুলে ধরতে সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আমি সাংবাদিকদের বলব, এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও দায়িত্ব পালনকালে আপনাদের ওপর যারা আক্রমণ করেছে, তাদের আসল চরিত্র আন্তর্জাতিকভাবে আপনাদের তুলে ধরা উচিত। সাংবাদিকদের মাটিতে ফেলে পেটানো, আমার মনে হয়, বাংলাদেশের এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা আর দেখা যায়নি। এর জবাব বিএনপিকে দিতে হবে। তিনি বলেন, কোনো কোনো পত্রিকা এটিকে আবার কভার দেয়ারও চেষ্টা করেছে। তাদের ধিক্কার জানাই। সেদিন গায়ের জ্যাকেট ‘প্রেস’ স্টিকার লাগিয়ে দলীয় কর্মীরা সন্ত্রাস ও অগ্নিসংযোগ করেছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। অপর দিকে, সরকারের পক্ষ থেকে কেউ রফিক ভুইয়ার মৃত্যুর কথা উল্লেখ করেননি। কেউ তদন্ত চাননি। দায়ী পুলিশের বিচার চাননি।
এদিকে অগ্নিসন্ত্রাসের যে অভিযোগ বিএনপির বিরুদ্ধে তার কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি; বরং সময়ে সময়ে উদ্ঘাটিত তথ্য সাংবাদিক সম্মেলন ও ভিডিওফুটেজ থেকে প্রমাণিত হয়েছে, এর জন্য আওয়ামী লীগ-সমর্থিত লোকেরা ও পুলিশ প্রধানত দায়ী। এখন তরুণদের হাতে হাতে হাতে অ্যান্ড্র্রয়েড ফোন রয়েছে। যারা মিছিল করছেন, স্লোগান দিচ্ছে রাজপথ প্রকম্পিত করছে তারা একই সাথে ঘটনার ছবিও তুলছে। যানবাহনে যারা আগুন দিচ্ছে, তারা আসছে পুলিশের ব্যারিকেডের ভেতর দিয়ে। দু’পাশে সারিবদ্ধ পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যে কয়েকজন তরুণ পেট্রলবোমা নিয়ে, যানবাহনে আগুন দিয়ে পুলিশের সামনে দিয়ে বীরদর্পে চলে যাচ্ছে। পুলিশের সহজ হিসাব, বিএনপির লোকরা আগুন দিয়েছে। আর এরকম আগুনের ঘটনায় বিএনপির লোকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করছে। ওই মামলায় বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদেরও আসামি করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিএনপির কর্মসূচি থাকুক বা না থাকুক গায়েবি মামলা দায়ের করা হচ্ছে।
গায়েবি মামলা মানে সে রকম ঘটনা ঘটেনি কিন্তু পুলিশ বা কোনো আওয়ামী নেতা বা কর্মী বিএনপির দুই-তিন শ’ নেতাকর্মীর নামে মামলা দায়ের করছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৪৫ লাখ বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। কারো কারো নামে তিন শতাধিক মামলা করা হয়েছে। তাদের দিন কাটে আদালতের বারান্দায় বারান্দায়। দেশে এখন এমনি গণতন্ত্র ও মানবাধিকার চর্চা হচ্ছে। সরকার অন্ধ ও কানা হয়ে গেছে। তারা চোখেও দেখে না, কানেও শোনে না। কেবল রশি টাইট দেয়। তারা বুঝতে চায় না, বেশি টাইট দিলে শেষ পর্যন্ত যে দড়ি ছিঁড়ে যায়। এখন সে দড়ি ছিঁড়ে যেতে আর বেশি সময় লাগবে বলে মনে হয় না।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com