জাতীয় নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসছে। শোনা যাচ্ছে শিগগির তফসিল ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন। গোটা জাতি চায় অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হোক। এ ধরনের একটি নির্বাচন করার পরিবেশ এখন পর্যন্ত তৈরি করা গেছে বলে কেউ মনে করেন না। নির্বাচনের সবচেয়ে বড় অংশভাগী হলো রাজনৈতিক দল। একমাত্র ক্ষমতাসীন দল ও তার শরিক ও সুবিধাভোগী হাতেগোনা কয়েকটি নামসর্বস্ব দল ছাড়া কেউ বলছে না নির্বাচনের ন্যূনতম পরিবেশ আছে।
কিন্তু নির্বাচন কমিশন নিয়ে কিছু বলা অনর্থক। তারা সরকারের সুরে সুর মিলিয়ে বলছেন, যথাসময়ে নির্বাচন হবে। পরিবেশ অনুকূল হোক বা প্রতিকূল। সিইসি বলে দিয়েছেন, তাদের হাতে কোনো অপশন নেই। পরিবেশ ঠিক করতে হবে অংশগ্রহণকারী দল ও প্রার্থীদের। তাদের সব কেন্দ্রে শক্ত এজেন্ট দিতে হবে, যারা সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করবেন। এর অর্থ হলো, ক্ষমতাসীন দলের লোকজন এবং পুলিশ মিলে প্রতিটি কেন্দ্রে যা ইচ্ছা করবে, অন্য প্রার্থীর এজেন্টরা পারলে সেটি ঠেকাবে, না হলে যা হওয়ার তাই হবে। সেই মহড়াই কি দেখা গেল না গত রোববার ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ ও লক্ষ্মীপুর-৩ আসনের উপনির্বাচনে?
লক্ষ্মীপুর সদরের দিঘলী ইউনিয়নের দক্ষিণ খাগুড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ছাত্রলীগের এক নেতা ব্যালট বইয়ের প্রায় অর্ধশত পাতায় নৌকা প্রতীকে সিল মারছেন এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ওই নেতা কে, কী তার পরিচয়, কোথায় তার বাড়ি সব কিছু জানা গেছে। ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ জানিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের দু’জন নির্বাচন বর্জন করেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন ব্যালটে সিল মারার বা কারচুপির কোনো অভিযোগ আমলে নেয়নি। একই অবস্থা ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনেও।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উপনির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ করেছেন একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী এ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা। তার ভোটারদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া এবং কয়েকটি কেন্দ্রে নৌকার সমর্থকদের প্রকাশ্যে ব্যালট বাক্সে ভোট ফেলার অভিযোগ করেন। এমনকি ভোটার লিস্টে গরমিল ছিল বলেও অভিযোগ করেন তিনি। কোনো অভিযোগে কর্ণপাত করেননি নির্বাচনী কর্মকর্তারা। নৌকার জয় নিশ্চিত করাই সম্ভবত তাদের লক্ষ ছিল। নির্বাচন কমিশন সেটি করেছে, নৌকার প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ ও লক্ষ্মীপুর-৩ আসনের উপনির্বাচন ছিল নিছক নিয়মরক্ষার আয়োজন। ১১শ সংসদের শেষ অধিবেশনও সমাপ্ত হয়েছে ক’দিন আগে। নতুন নির্বাচিতরা এক দিনও সংসদীয় কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারবেন না। এমন একটি নির্বাচনেও নির্বাচন কমিশন ক্ষমতাসীনদের প্রকাশ্য কারচুপি রোধ করতে পারেনি। তাই প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, এই কমিশনের পরিচালনায় জাতীয় নির্বাচন আদৌ সুষ্ঠু হওয়া কীভাবে সম্ভব? অবশ্য এ দু’টি উপনির্বাচন শুধু নয়, এই কমিশনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত কোনো একটি নির্বাচনও সুষ্ঠু হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত নেই। তাই তাদের নিয়ে কথা বলা বাতুলতামাত্র।
গত কয়েক দিনের ঘটনাবলি যদি লক্ষ করি তাহলে দেখা যাবে, শুধু আমরা নই, বরং নির্বাচনসংশ্লিষ্ট প্রায় কেউ-ই কমিশনের ওপর আস্থা রাখেন না। গত শনিবার ইসি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ করেছে। তফসিল ঘোষণার বিষয়ে পরামর্শের জন্য ডাকা ওই সংলাপ কার্যত ফলপ্রসূ হয়নি। আমন্ত্রিত ৪৪টি দলের মধ্যে সংলাপ বর্জন করেছে ১৮টি। যে ২৬টি দল অংশ নেয় তার মধ্যে ১২টি বলেছে, দেশে নির্বাচন করার মতো পরিবেশ আছে বলে তারা মনে করেন না। তারা ভোটের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা জানিয়েছেন; অর্থাৎ নিবন্ধিত দুই-তৃতীয়াংশ রাজনৈতিক দলের বর্তমান পরিবেশে ভোটের প্রতি আস্থা নেই। এর মধ্যে সরকারের সহযোগী জাতীয় পার্টিও আছে। আর নিবন্ধিত অন্যতম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাসদ রীতিমতো সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে, এ সংলাপ কাক্সিক্ষত সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ সৃষ্টিতে কোনোরকম ভূমিকা রাখতে পারবে বলে তারা মনে করেন না। তাই তারা ইসির সংলাপ বর্জন করছেন।
এর আগে সিইসি বলেছেন, রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের সামর্থ্য ইসির নেই। তাদের সামনে অন্য কোনো অপশনও নেই। স্পষ্টত এসব বক্তব্য সরকারি সুরের প্রতিধ্বনি। সরকারি দলও বলছে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। ধারণা করা অযৌক্তিক হবে না যে, ইসির পক্ষে সরকারের নির্দেশনা উপেক্ষা করা অসম্ভব। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের নমুনা আমাদের সবার জানা। এমনকি সরকার সমর্থক বলে চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীরাও মুখ ফুটে একই কথা বলতে শুরু করেছেন। অর্থনীতিবিদ শিক্ষাবিদ আনু মুহাম্মদ লিখেছেন, ‘১৯৭৩ সাল থেকে শুরু করে দলীয় সরকারের অধীনে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হয়নি।… ২০০৮ সালে নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগ একক ক্ষমতাবলে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারাটিই বাদ দিয়ে দেয়। তার পর দলীয় সরকারের অধীনে দুটি নির্বাচন হয়েছে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে। প্রথমটিতে একতরফা হয়েছে, সংসদের অধিকাংশ পদে কোনো নির্বাচনই হয়নি, আর দ্বিতীয়টিতে অবিশ্বাস্য দক্ষতা ও সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে আগের রাতে অধিকাংশ ব্যালট পূর্ণ করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে এত বছর পরও প্রমাণিত হয় যে দলীয় সরকারের অধীনে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য দেশে এখনো সক্ষমতা তৈরি হয়নি। সেই কারণে এখন যে তত্ত্বাবধায়ক বা তদারকি বা অস্থায়ী বা নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি উঠেছে, তা খুবই যৌক্তিক।’ (প্রথম আলো, ০৬ নভেম্বর ২০২৩)
এ দিকে নির্বাচন বিষয়ে বিশেষজ্ঞরাও মনে করেন, বর্তমানে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মতো পরিবেশ নেই। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন একটি দৈনিকে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে নির্বাচন হওয়া নিয়ে বড় সমস্যা আছে। এখানে যে কয়েকটি নির্বাচন হয়েছে, সেগুলো গ্রহণযোগ্য হয়নি। সবসময় রাজনীতিকীকরণ হয়ে থাকে, লম্বা সময় ধরে রাজনীতিকীকরণের কারণে কমিশনের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না ভোটাররা। তারাও এমন কাজ করছেন যার ফলে সেই আস্থার জায়গায় সঙ্কট তৈরি হয়েছে। ফলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে নিরপেক্ষ নির্বাচন করা খুবই কষ্টকর, খুবই কঠিন। রাজনৈতিক পরিবেশ আমাদের এখানে সবসময় নিচের দিকে গেছে। মারামারি, হানাহানি, কাটাকাটি, চাটুকারিতা এসবের ওপর নির্ভর করে চলছে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ঠিকভাবে কাজ করছে না। ফলে এ কাঠামোর মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়।’ (বণিক বার্তা, ০৬.১১.২৩)
জাতীয় নির্বাচনের সময় কিভাবে কথিত কিংস পার্টি দাঁড় করানো হয় সেটি সবার জানা। দল ভেঙে নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়া এরশাদের সময়ে যেমন, ১/১১-এর সরকারের সময়ও দেখা গেছে। বর্তমান সরকারের সময়ও চেষ্টা হয়েছে প্রবলভাবে। এখন শোনা যাচ্ছে, বিএনপিতে অভ্যন্তরীণ অভ্যুত্থান ঘটানোর জোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু অতীতের সব চেষ্টা যেমন ভণ্ডুল হয়েছে এবারো একই ঘটনা ঘটবে তা সহজে বলা যায়। কারণ সরকার নিজে এবার নাজুক অবস্থায়। বিরোধী দলগুলোর ক্রমেই তীব্র হয়ে ওঠা আন্দোলনের অভ্যন্তরীণ চাপের সাথে অতিরিক্ত ভার যোগ করেছে বহির্বিশে^র চাপ।
রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা দলগুলো বর্তমান কমিশনের পদত্যাগ দাবি করছে। পাশাপাশি সংসদ ভেঙে দেয়াসহ সরকারের পদত্যাগের দাবি জানিয়েছে। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সত্যিকারের একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের দাবিতে তারা আন্দোলন করছে। সে আন্দোলন এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে; অর্থাৎ লাগাতার কর্মসূচি দিয়ে একটা এসপার ওসপার করা তাদের লক্ষ্য। এতে তারা বহির্বিশে^র গণতান্ত্রিক দেশগুলোরও সমর্থন পাচ্ছে। কিন্তু এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে সহিংস রূপ দিয়েছে সরকার, এমন অভিযোগ উঠেছে। গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ভণ্ডুল করতে তারা পুলিশ ও পেটোয়া বাহিনী দিয়ে হামলা করেছে।
এর আগে গত প্রায় ১৫ বছরে সব সময় ক্ষমতাসীন দল সন্ত্রাস, অগ্নিসংযোগ, মানুষ হত্যার মতো নানা নাশকতার ঘটনায় বিরোধী দলকে দোষী সাব্যস্ত করে তাদের মামলায় জড়িয়েছে, সাজা দিয়েছে। কিন্তু এবার প্রথমবারের মতো খেলাটা ভিন্ন রঙ ও রূপ নিয়েছে। ২৮ অক্টোবরের সহিংসতায় ক্ষমতাসীন দলের লোকজন জড়িত ছিল এমন অভিযোগ করেছে খোদ জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কমিশন। এর কয়েক মাস আগে ঢাকার প্রবেশমুখে বিরোধী দলের কর্মসূচির সময় রূপগঞ্জে সরকারি দলের লোকেরা বাসে আগুন দিয়েছে এমন তথ্য পরিবেশন করে বিদেশী মানবাধিকার সংস্থা।
এ ছাড়াও ক্ষমতাসীনদের ব্যাপক দুর্নীতি, বিদেশে অর্থ পাচার ইত্যাদি বিষয়ের সাথে কারা কিভাবে জড়িত সেসব তথ্যও বিদেশীদের কাছে অনেকটা স্পষ্ট হয়ে এসেছে বলে ধারণা করা যায়। গত কয়েক মাসে বিদেশের সেরা কয়েকটি গণমাধ্যমে এসব বিষয় নিয়ে সবিস্তার রিপোর্ট প্রকাশ পায়। সব মিলিয়ে এটি নিশ্চিত, ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো একটা নির্বাচন করে ক্ষমতা ধরে রাখা এবার সহজ হবে না।
সংবিধান অনুযায়ী আগামী ২৯ জানুয়ারি বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে হবে। কিন্তু সব রাজনৈতিক দল বিশেষত বিরোধী দলগুলো যদি নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থা না পায়, তাহলে সেটি নির্বাচনের নামে প্রহসন হতে বাধ্য। আবারো একটি ভোটারবিহীন অথবা নৈশভোটের নির্বাচন জাতি কোনোভাবে মেনে নেবে না। সেই ঝুঁকি নেয়া থেকে নির্বাচন কমিশন বিরত থাকলে বরং জাতির খেদমত হবে।
mujta42@gmail.com