সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দায় গতকাল মঙ্গলবার ১১৭ কোটি ৩০ লাখ ডলার পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর এতে বৈদেশিক মুদ্রার প্রকৃত মজুদ আরেক দফা কমে ১৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে গেছে। সংশ্লিষ্ট এক সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, চাহিদা অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বাড়ছে না। প্রতি মাসেই তা ঘাটতি থাকছে। আর এ কারণে প্রতি মাসেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এক বিলিয়ন ডলারের ওপরে কমে যাচ্ছে। ডলারের আন্তঃপ্রবাহ কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাচ্ছে, সেই সাথে কমছে রফতানি আয়। রেকর্ড পরিমাণ বাংলাদেশী শ্রমিক বিদেশে গেলেও কাক্সিক্ষত হারে রেমিট্যান্স আসছে না; বরং রেমিট্যান্স প্রবাহ রেকর্ড পরিমাণ কমে গেছে গত সেপ্টেম্বর মাসে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় গত সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৩৪ কোটি ডলার, যা গত ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। শতকরা হিসাবে আগের বছরের সেপ্টেম্বরের থেকে গত সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স কমেছে পৌনে ১৩ শতাংশ। যেখানে আগের বছরে একই সময়ে এসেছিল ১৫৪ কোটি ডলার। কিন্তু সামগ্রিক আমদানি দায় কমছে না। বিশেষ করে আগের বকেয়া এলসি ও চলতি এলসির দায় মেটাতে হচ্ছে আন্তঃপ্রবাহের চেয়ে বেশি হারে। এর ফলে প্রতি মাসেই কমে যাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার আন্তঃপ্রবাহ বাড়তে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রেমিট্যান্স আহরণের ক্ষেত্রে নীতিমালা শিথিল করেছে। সেই সাথে ব্যাংকগুলোকেও বেশি হারে রেমিট্যান্স আহরণের ক্ষেত্রে ডলারের মূল্যের ক্ষেত্রে ছাড় দেয়া হয়েছে। গত ৩০ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও ব্যাংকারদের শীর্ষ সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) যৌথ বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে ইতোমধ্যে। বলা হয়েছে, যেসব ব্যাংকের ডলার সঙ্কট রয়েছে তারা ইচ্ছা করলে বেশি দামেও রেমিট্যান্স আহরণ করতে পারবে। তবে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্ষেত্রবিশেষ এ সুবিধা থাকবে। এ সময়ে ডলার সঙ্কট কাটানোর জন্যই এ সুবিধার কথা বলা হয়েছে।
জানা গেছে, প্রতি দুই মাস পরপর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের দায় পরিশোধ করতে হয়। গত জুলাই ও আগস্ট মাসের এ আকুর দায় পরিশোধ করতে হয় ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। আর সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে আকুর দায় পরিশোধ করা হয়েছে ১.১৭ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ ডলার আহরণ করছে অনেক ব্যাংকই এলসি খুলেছে তার চেয়েও বেশি পরিমাণ। এর ফলে প্রতি মাসেই তারা আমদানির দায় পরিশোধ করতে গিয়ে ঘাটতির মুখে পড়ছে। কিন্তু বাজার থেকে ডলার কিনতে না পারায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে হাত পাতছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে শুধু সরকারের অতি প্রয়োজনীয় কেনাকাটায় বিশেষ করে বিপিসির জ্বালানি তেল, বিসিআইসির সার, বিএডিসির ভোগ্যপণ্যসহ অতি প্রয়োজনীয় কেনাকাটায় দেখে শুনে ব্যাংকগুলোকে কিছু ডলার সরবরাহ করছে। এর পরও বিদায়ী অর্থবছরে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করতে হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ থেকে; যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। অথচ আগের অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে বিক্রি করতে হয়েছিল প্রায় সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলার।
সূত্র আরো জানায়, যে হারে প্রতি মাসে রিজার্ভ কমে যাচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে সামনে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ আরো চাপে পড়ে যাবে। তখন আপৎকালীন দায় মেটানো কষ্টকর হবে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য বিশ্বে নতুন নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টির বিকল্প নেই। এ দিকে প্রতি মাসেই ডলারের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না থাকায় ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে। একই সাথে কমছে রিজার্ভের পরিমাণ। এমনি পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোকে বাড়তি দামে রেমিট্যান্স আনার সুযোগ দেয়া হয়। বলা হয়, ব্যাংকগুলো নিজেদের তহবিল থেকে রেমিট্যান্সে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দিতে পারবে। যেখানে রাষ্ট্র দিচ্ছে আড়াই শতাংশ। সব মিলে রেমিট্যান্সের বিদ্যমান মূল্যের সাথে ৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রণোদনা দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়। গত মাসে রেমিট্যান্সের ডলারের মূল্য ছিল ১১০ টাকা। এর সাথে ৫ শতাংশ হিসেবে হয় সাড়ে ৫ টাকা। ১১০ টাকার সাথে সাড়ে ৫ টাকা যুক্ত করে হয় ১১৬ টাকা ৫০ পয়সা।
এ দিকে গত সপ্তাহে বাফেদা ও এবিবির যৌথ বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, আন্তঃব্যাংকে ডলারের দাম সর্বোচ্চ ১১৪ টাকা পর্যন্ত লেনদেন করা যাবে; যা ওই দিন ছিল ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। একসাথে বাড়ানো হয়েছে সাড়ে ৩ টাকা। ওই সূত্র জানিয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি নিয়েই এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ কারণে সর্বোচ্চ ১১৪ টাকায় লেনদেন করে বাংলাদেশ ব্যাংকে রিপোর্টও করা যাবে ১১৪ টাকা। এ দিকে গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলো ১১১ টাকা দরে ডলার কিনে ১১১ টাকায়ই বিক্রি করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। এতে তাদের কোনো মুনাফা হয়নি। তবে আন্তঃব্যাংকে ১১৪ টাকায় কিনে ১১৪ টাকা ৪৪ পয়সা পর্যন্ত বিক্রি করতে পারবে তারা। এ ক্ষেত্রে অডিট ঝামেলা এড়াতে গ্রাহকের কাছ থেকে লিখিত নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে; অর্থাৎ অগ্রিম ডলার বুকিংয়ের বিষয়ে বলা হয়েছে। এতে প্রকৃত ডলারের দাম ১২০ টাকার ওপরে চলে যাবে আমদানি পর্যায়ে।