নিত্যপণ্যের বাজারে বেড়েই চলেছে একের পর এক পণ্যের দাম। এতে যেন ক্রেতাদের ‘দম বন্ধ’ হওয়ার অবস্থা। কয়েক মাস স্থির থাকার পর এবার দাম বাড়ার তালিকায় উঠে এসেছে প্রধান খাদ্যশস্য চাল। এক সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারি বাজারে বস্তায় (৫০ কেজি) বেড়েছে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। তাতে খুচরায় কেজিতে ৪ থেকে ৭ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। অন্য পণ্যের পর চালের দাম বাড়ায় বড় চাপে পড়েছেন ক্রেতারা।
দাম বাড়ার পেছনে নানা যুক্তি দাঁড় করাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, মিল মালিক তথা বড় মজুতদাররা ভারতের চাল রপ্তানিতে শুল্ক আরোপের সুযোগ নিচ্ছেন। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়াচ্ছেন তারা। এ ছাড়া অবরোধের কারণে পরিবহন ভাড়া বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে দামে। অন্যদিকে মিলাররা বলছেন, মাঠ পর্যায়ে মজুত ফুরিয়ে আসছে। সে জন্য বাজার কিছুটা বাড়তি। সপ্তাহ দুয়েক পর নতুন ধান উঠবে। তখন চালের বাজার স্বাভাবিক হবে।
তবে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় দাম বাড়ার চিত্র দেখা গেলেও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এত দাম বাড়ার তথ্য পুরোপুরি ঠিক নয়। চালের দাম সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আছে।
কেজিতে বাড়ল কত
গত ২৬ আগস্ট ভারত চাল রপ্তানিতে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। এতে বিশ্ববাজারে চালের বাজার তেতে ওঠে। ওই সময় সরকারের সংশ্লিষ্টরা এবং চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীদের আশ্বাস ছিল, ফলন ভালো হওয়ায় সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ধান-চালের মজুত পর্যাপ্ত। এ চাল শেষ হওয়ার আগেই উঠবে আমন। তাই আমদানি করতে হবে না, দামও বাড়বে না।
তবে সেই আশ্বাস এখন ‘চোরাবালি’। বাজারে সব ধরনের চালের দাম তরতর করে বেড়েছে। গত সোম ও মঙ্গলবার রাজধানীর মগবাজার, মহাখালী, তেজকুনীপাড়া ও কারওয়ান বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে বিআর-২৮ চালের। বাজারে এ চালের ক্রেতা বেশি। খুচরা পর্যায়ে এ জাতের চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫৬ থেকে ৫৮ টাকা দরে। ৮ থেকে ১০ দিন আগে এ চালের দর ছিল ৫০ থেকে ৫২ টাকা। অর্থাৎ কেজিতে দাম বেড়েছে ৬ টাকা। খুচরা পর্যায়ে গত সপ্তাহে মোটা চালের (স্বর্ণা ও চায়না ইরি) কেজি ছিল ৪৮ থেকে ৫০ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ৫২ থেকে ৫৫ টাকা দরে। এ মানের চাল কেজিতে বেড়েছে ৪ থেকে ৫ টাকা।
পাঁচ থেকে ছয় দিন আগে মিনিকেট বা সরু চালের দামও বেড়েছে। মানভেদে এ জাতের চালের কেজি এখন ৬৮ থেকে ৭২ টাকা।
এত দিন এ ধরনের চাল বিক্রি হয়েছে ৬২ থেকে ৬৫ টাকায়। এ জাতের চালে কেজিতে বেড়েছে ৬ থেকে ৭ টাকা। এ ছাড়া নাজিরশাইল চাল কেজিতে ৫ টাকার মতো বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকায়।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, এক মাসের ব্যবধানে সরু চালের দাম ২ দশমিক ২৭, মাঝারি চালের দাম প্রায় ১ এবং মোটা চালের দাম ২ শতাংশ বেড়েছে।
খুচরা ব্যবসায়ীরা দুষছেন মিলারদের
মহাখালী কাঁচাবাজারের ইয়াসিন ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মো. মুস্তাকিম সমকালকে বলেন, সপ্তাহখানেক ধরে চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। সংকট না থাকলেও পাইকাররা ইচ্ছামতো দাম বাড়াচ্ছেন। কারওয়ান বাজারের পাইকারি ও খুচরা চাল ব্যবসায়ী জালাল আহমেদ বলেন, সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় বিআর-২৮ চাল। মিল পর্যায়ে এক সপ্তাহে এ মানের চালের বস্তায় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেড়েছে। অবরোধের কারণে পরিবহন ভাড়াও বেড়েছে। মগবাজারের সাভার রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী মো. রাজিব বলেন, চার থেকে পাঁচ মাস চালের বাজার স্থির ছিল। মাস দুয়েক আগে ভারত চাল রপ্তানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্ক আরোপ করে। তখন বড় মজুতদাররা সুযোগ না নিলেও এখন নিচ্ছেন।
আমনে দাম কমার আশা
কয়েক দিনের মধ্যেই আমন ধান কাটা শুরু হবে। তখন দাম কমে আসবে বলে মনে করেন মিল মালিকরা। বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুর রশিদ সমকালকে বলেন, অনেকের মজুত ফুরিয়ে এসেছে। কিছু ব্যবসায়ীর কাছে পুরোনো চাল আছে। তারা হয়তো বস্তায় ৫০ বা ১০০ টাকা বেশি নিচ্ছেন। কেন বেশি দর নিচ্ছে, সেটা তারা বলতে পারবেন। তবে কয়েক দিন পরই নতুন ধান উঠবে। তখন চালের দাম কমে আসতে পারে।
খাদ্য সচিবের দাবি, চালের বাজার পুরো নিয়ন্ত্রণে
চালের দাম বাড়ার তথ্য মানতে নারাজ খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ইসমাইল হোসেন। তিনি বলেন, কেজিতে ৫ থেকে ৭ টাকা দাম বাড়ার তথ্য পুরোপুরি ঠিক নয়। বাজার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আছে।
আট থেকে ১০ দিন আগে দাম বাড়ার কারণ খতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছিলেন খাদ্য সচিব। সেই বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া গেছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমন ওঠার আগমূহূর্তে সাধারণত চালের দাম কিছুটা বাড়ে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, মজুত পরিস্থিতি মোটামুটি সন্তোষজনক। সরকারের গুদামে চালের মজুত রয়েছে ১৪ লাখ ৫৫ হাজার ২২১ টন। এদিকে গত অর্থবছরে সরকারি-বেসরকারিভাবে ১০ লাখ ৫৫ হাজার টন আমদানি হয়েছে। তবে এই অর্থবছরের চার মাসে এখন পর্যন্ত কোনো চাল আমদানি হয়নি।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, গত অর্থবছরে মোট চাল উৎপাদন হয়েছে ৩ কোটি ৯১ লাখ টন। এ অর্থবছরে আউশ উৎপাদন হয়েছে ৩০ লাখ টন।
নওগাঁয় কৃত্রিম সংকটে বাজার অস্থির
চাল সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয় দেশের উত্তরাঞ্চলে। এখন সেখানও দাম বাড়তি। নওগাঁয় আট থেকে ১০ দিনের ব্যবধানে খুচরা বাজারে চালের দাম প্রকারভেদে কেজিতে বেড়েছে ৫ থেকে ৭ টাকা। মিল মালিকরা বলছেন, মৌসুমের শেষ সময়ে বাজারে পুরোনো ধান কমে যাওয়ায় চালের মজুত প্রায় শেষ পর্যায়ে। এ জন্য ধানের মণে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেড়েছে। তাতে পাইকারি বাজারে চালের দাম মণপ্রতি ১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ফলে পাইকারিতে কাটারিভোগ চালের বস্তা ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ১০০, জিরাশাইল ২ হাজার ৯০০ থেকে ৩ হাজার, বিআর-২৮ ও ২৯ জাতের চাল ২ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ৭০০, স্বর্ণা ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বলেন, খুচরা ব্যবসায়ীরা ধানের মণে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বাড়িয়েছেন। অনেকে চাল গুদামজাত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়াচ্ছেন।
মজুতদারি বন্ধ হলে বাজার নিয়ন্ত্রণে থাকবে
দিনাজপুরে এক সপ্তাহে সব জাতের চাল বস্তায় ৭০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। বাংলাদেশ মেজর ও হাসকিং মিল মালিক সমিতি সূত্র বলছে, দিনাজপুরে মোট ২ হাজার ১৮৫টি অটো চালকলের মধ্যে সচল রয়েছে ৩৫০টি। এর মধ্যে চালু আছে ১৫০টি। এ ছাড়া হাসকিং মিল আছে ৪০০টি। তবে ধানের সংকটে হাসকিং মিলগুলো সম্পূর্ণ বন্ধ। সংগঠনটির সহসভাপতি সহিদুর রহমান পাটোয়ারী মোহন বলেন, ধান না থাকায় মিল বন্ধ রয়েছে। এখন যেসব ধান রয়েছে বাজারে, সেগুলো মজুতদার ব্যবসায়ীদের। এসব ব্যবসায়ীর কোনো লাইসেন্স নেই। লাইসেন্সহীন মজুতদারি বন্ধ হলে বাজার নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
অবরোধের ছুতা রংপুর চালের বাজারে
রংপুরে কিছুটা নাগালে থাকা মোটা চালের দাম এখন পাইকারিতে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ফলে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ৫৫ টাকা ছাড়িয়েছে। ১০ দিন আগেও এ দর ছিল ৫০ টাকা। রংপুরের নগরীর মাহিগঞ্জ এলাকার চালের আড়তদার মিলন শিকদার, আবু পাটোয়ারীসহ বেশ কয়েকজন আড়তদারের অভিযোগ, মুষ্টিমেয় কয়েকটি রাইস মিল মালিক ও মজুতদারের ইচ্ছামতো দাম নির্ধারণের কারণে দাম বেড়েছে। এ জন্য উত্তরবঙ্গের রাইস মিল মালিক ও চালের করপোরেট কোম্পানিগুলো দায়ী। এ ছাড়া এ অঞ্চলের ছোট ছোট হাসকিং মিলগুলো এখন আর চলে না। বড় অটো রাইস মিল মালিকরা কম দামে ধান কিনে মজুত করে নানা অজুহাতে দাম বাড়ান। তার ওপর টানা অবরোধের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বাজারে।
কুষ্টিয়ায়ও দাম বাড়তি
গত ২৭ অক্টোবর কুষ্টিয়া খাজানগরে চালের মোকামে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি কেজি বাসমতী ৬৬ টাকা, মিনিকেট ৫৮ এবং বিআর-২৮ ও কাজললতা সাড়ে ৪৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর মোটা স্বর্ণা জাতের চাল ৪২ থেকে ৪৩ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ১০ দিনের ব্যবধানে কেজিতে ২ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গতকাল বাসমতী চালের কেজি বিক্রি হয়েছে সাড়ে ৬৭ থেকে ৬৮ টাকা, মিনিকেট সাড়ে ৫৯ থেকে ৬০ টাকা, বিআর-২৮ ও কাজললতা ৪৯ টাকা ২০ পয়সা থেকে ৫০ টাকা এবং মোটা চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪৪ থেকে ৪৫ টাকায়। পাইকারিতে বেড়ে যাওয়া কারণে কুষ্টিয়ায় খুচরা পর্যায়ে চালের কেজিতে ৩ থেকে ৪ টাকা বেড়েছে।