দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার আগে বর্তমান সরকারের শেষ একনেক বৈঠক বসছে বৃহস্পতিবার। সেখানে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের ৪২ প্রকল্প অনুমোদনের প্রস্তাব উঠছে। এগুলোর মধ্যে নিয়মিত প্রকল্প আছে ৩৬টি, ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া শুধু মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য রয়েছে একটি এবং ৫০ কোটি টাকার নিচে ব্যয় হওয়ায় পরিকল্পনামন্ত্রীর অনুমোদিত প্রকল্প ৫টি। এছাড়া আর্থিক সংকটের মধ্যেও তড়িঘড়ি করে শেরেবাংলা নগরে পার্ক নির্মাণ প্রকল্প উপস্থাপন করা হচ্ছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, চলমান সংকটের সময়ে উচ্চ অগ্রাধিকারের প্রকল্প ছাড়া অনুমোদনের সুপারিশ না করার নীতিগত সিদ্ধান্ত আছে সরকারের। বিভিন্ন সময় এমন কথা জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানও। কিন্তু এর মধ্যেই ‘ঢাকার শেরেবাংলা নগর এলাকায় পার্ক নির্মাণ’ নামের একটি প্রকল্প উপস্থাপন করা হচ্ছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে। ৬ নভেম্বর প্রকল্পটি নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় পিইসি (প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি) সভা। এর একদিনের মাথায় ত্বরিতগতিতে ৭ নভেম্বর একনেকের তালিকায় প্রকল্পটি যুক্ত করা হয়েছে। এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা। কেননা একে তো পার্ক নির্মাণ, যেটি পরেও করা যায়; তার ওপর এত তড়িঘড়ি করে প্রক্রিয়াকরণ করার পেছনের কারণ কী? প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, এর আওতায় রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের পুরোনো বাণিজ্য মেলার মাঠে নির্মাণ করা হবে পার্ক। এজন্য ১০৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত অধিদপ্তর। এর মধ্য দিয়ে ঢাকাবাসী পাবে একটি নতুন পার্ক। শিশুরা মন খুলে বেড়াতে পারবে। সেই সঙ্গে প্রাকৃতিক পরিবেশের মানোন্নয়ন ঘটবে। পাশাপাশি স্থপতি লুই আই কানের নকশা অনুযায়ী ফাঁকা স্থানে লেক, সবুজ স্থান এবং শিশুদের জন্য রাইড, বিশ্রামের জন্য বসার স্থানসহ নান্দনিকভাবে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কথা হয় পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ানের সঙ্গে। মঙ্গলবার তিনি যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্পটির প্রস্তাব বেশ আগেই এসেছিল। এর মাঝে বিভিন্ন পর্যায়ে যাচাই-বাছাই করা হয়। কয়েকবার প্রি-একনেক সভাও হয়েছে। তাই ৬ নভেম্বরের পিইসি সভাটি ছিল আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রকল্পের ব্যয় খুব বেশি নয়। এছাড়া জায়গাটি খোলা পড়ে আছে। এখনো যে কোনো সময় অন্য স্থাপনা হয়ে যেতে পারে। সেখানে যদি একটি পার্ক হয়, তাহলে রাজধানীবাসীর জন্য অনেক ভালো হবে। সেই চিন্তা থেকেই অনুমোদনের সুপারিশ করা হয়েছে। তাড়াহুড়া হলেও ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে প্রকল্প প্রস্তাব।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, এখানে টাকা তো বিষয় নয়, সিগন্যালটাই বড়। অর্থনীতির চাপ সামলানোর জন্য সরকার যে ব্যয় সাশ্রয়ের (কৃচ্ছ সাধন) কথা বলছে, সেটির সঙ্গে এমন প্রকল্প যায় না। গতকালও তো (সোমবার) অর্থসচিব বলেছেন, যেসব ব্যয় না করলেও হয়, সেগুলো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরও বলেছেন টাকা ছাপিয়ে সরকারকে আর ঋণ দেওয়া হবে না। এ পরিপ্রেক্ষিতে অর্থসচিবও বলেছেন এটা আমাদের জন্য কঠিন হলেও বর্তমান অবস্থায় এমন উদ্যোগ প্রয়োজন। এতে দেখা যায়, সরকারের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটা সমঝোতা হয়েছে। তাহলে এক্ষেত্রে পার্ক নির্মাণ সরকারের অবস্থানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এতে অন্য মন্ত্রণালয়গুলোও বলবে পার্ক হলে আমাদেরটা কেন নয়। এভাবে বিন্দু বিন্দু করে সিন্ধু হবে। তাই এক টাকা হোক আর এক হাজার কোটি টাকা হোক, অবস্থানের ক্ষেত্রে সরকারের কঠোর হওয়া উচিত।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠেয় একনেক বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপারসন শেখ হাসিনা। এতে উপস্থাপনের জন্য যেসব প্রকল্প চূড়ান্ত করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৬টি প্রকল্প হচ্ছে ভৌত অবকাঠামো বিভাগের। এছাড়া বাকি প্রকল্পের মধ্যে ৯টি হলো আর্থিসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের। কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের ৯টি প্রকল্প। শিল্প ও শক্তি বিভাগের প্রকল্প রয়েছে দুটি। এছাড়া শুধু মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য যেটির প্রস্তাব করা হয়েছে, সেটিও ভৌত অবকাঠামো বিভাগের।
একনেকে উঠতে যাওয়া প্রকল্পগুলোর কয়েকটি হচ্ছে ঢাকার শেরেবাংলা নগর প্রশাসনিক এলাকায় বহুতল সরকারি অফিস ভবন নির্মাণ প্রকল্প। এছাড়া ঢাকাস্থ তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য ১২৩টি ফ্ল্যাট নির্মাণ। চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন (প্রথম সংশোধিত) প্রকল্প। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর অর্থনৈতিক অঞ্চলের সঙ্গে লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী ও ফেনী জেলার সংযোগকারী সড়ক যথাযথমানে উন্নতীকরণ প্রকল্প। ইলিয়টগঞ্জ-মুরাদনগর-রামচন্দ্রপুর-বাঞ্ছারামপুর জেলা মহাসড়কটি যথাযথ মানে ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ। রাজউক পূর্বাচল ৩০০ ফুট মহাসড়ক থেকে মাদানী অ্যাভিনিউ সিলেট মহাসড়ক পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণ (দ্বিতীয় সংশোধিত)। সাতক্ষীরা-সখীপুর-কালীগঞ্জ মহাসড়ক এবং কালীগঞ্জ-শ্যামনগর-ভেটখালী মহাসড়ক যথাযথ মানে উন্নীতকরণ। চার লেনে উন্নীত ঢাকা-চট্টগ্রাম জাতীয় মহাসড়কের (এন-১) (দাউদকান্দি-চট্টগ্রাম অংশ) চার বছরের জন্য পারফরম্যান্স বেইজড অপারেশন ও দৃঢ়করণ (প্রথম সংশোধিত)। ভাঙ্গা-যশোর-বেনাপোল মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীতকরণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ ও ইউটিলিটি স্থানান্তর। গাবতলী সিটি পল্লিতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ক্লিনারবাসীদের জন্য বহুতলবিশিষ্ট আবাসিক ভবন নির্মাণ (তৃতীয় সংশোধিত)। ঢাকা পানি সরবরাহ নেটওয়ার্ক উন্নয়ন (দ্বিতীয় সংশোধিত)। বর্ধিত ঢাকা পানি সরবরাহ রেজিলিয়েন্স প্রকল্প। ঢাকা স্যানিটেশন উন্নয়ন (প্রথম সংশোধিত)। বরিশাল সিটি করপোরেশন এলাকায় বিভিন্ন রাস্তা উন্নয়ন, জলাবদ্ধতা নিরসন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন এবং বাংলাদেশ ই-পাসপোর্ট ও স্বয়ংক্রিয় বর্ডার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন (প্রথম সংশোধিত) প্রকল্প।