বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে যেসব সমস্যার মুখে পড়েছে, এর মূলে রয়েছে মার্কিন ডলারের সংকট। নীতিনির্ধারকরা মনে করেছিলেন, ডলারের সংকট এবং এর দাম বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা সাময়িক। তারা দীর্ঘদিন ধরে বলছেন, অচিরেই এর সমাধান হবে। কিন্তু সেই ‘অচিরেই’ আর আসছে না। ডলার সংকট ও দর বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন, বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এর ফলে উচ্চ মূল্যস্ফীতি হচ্ছে। জিনিসপত্রের বাড়তি ব্যয় মেটাতে মানুষের কষ্ট হচ্ছে। সব মিলিয়ে এই পরিস্থিতি অর্থনীতিকে বিপদে ফেলছে।
এর মধ্যে গতকাল রোববার আরও উদ্বেগজনক তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, গেল আগস্টে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স কমেছে ২১ শতাংশ। আগস্টের রেমিট্যান্স গত ছয় মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন, যা বৈদেশিক মুদ্রার কমতে থাকা রিজার্ভের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মাঝে কয়েক বছর বিশ্ববাজারে ঋণের সুদহার অনেক কমেছিল। ওই সময়ে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ অনেক বাড়িয়েছে বাংলাদেশ। এর সঙ্গে প্রতিবছরই রপ্তানি ও রেমিট্যান্সেও ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অনেক বেড়ে ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঘর ছাড়ায়। রিজার্ভ বাড়তে থাকায় তখন এতটাই আত্মতুষ্টি দেখা দেয়, রিজার্ভ থেকে শ্রীলঙ্কাকে ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়া হয়। মালদ্বীপকে ২০০ মিলিয়ন ঋণের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এমনকি রিজার্ভ থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠানে ঋণ ও উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হয়। ২০২১ সালের শেষ দিকে অর্থনীতিতে করোনা-পরবর্তী বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়। তখন আমদানির চাহিদা বাড়ে। অন্যদিকে, রেমিট্যান্স কমে যায়। এর প্রভাবে কমতে থাকে রিজার্ভ। এর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অর্থনীতিতে নতুন সংকট তৈরি করে। সংকট কাটাতে এখন কঠিন শর্তে আইএমএফের ঋণ নিতে হচ্ছে সরকারকে।
ডলারের দর কৃত্রিমভাবে অনেক দিন ৮৪ থেকে ৮৬ টাকার মধ্যে ধরে রেখেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে দুই বছর আগে সংকট শুরুর পর দর বেড়ে যাওয়ার চাপ তৈরি হয়। এর পরও বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে হস্তক্ষেপ করে দর কমিয়ে রাখার চেষ্টা অব্যাহত রাখে। এতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। আবার বাজারে প্রচুর ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত দুই বছরে ২ হাজার ৩৫০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর পরও সংকট থামানো যাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন ব্যাংকগুলোর কাছে ১১০ টাকা দরে ডলার বিক্রি করছে। গত বছরের এ সময়ে বিক্রি করছিল ৯৫ টাকা দরে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, ডলার সংকটের কারণে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছে। এতে করে শিল্প-বাণিজ্যে সমস্যা হচ্ছে এবং কর্মসংস্থান কমছে। ডলার বাজারে অস্থিরতার কারণে পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলছে। বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়ার খরচ বেড়েছে। এখান থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় ডলারের সরবরাহ বাড়াতে হবে। আর এজন্য বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তিনি বলেন, বর্তমানে রেমিট্যান্স কমছে হুন্ডি চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে। প্রবাসীরা হুন্ডিতে পাঠালে বেশি দর পান। আবার ব্যাংকের চেয়ে দ্রুত সুবিধাভোগীর কাছে টাকা পৌঁছে দেয়। যেখানে কাজ করে সেখান থেকে অনেক দূরে গিয়ে অর্থ পাঠাতে হয়। এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে।
রেমিট্যান্সে বড় পতন
আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে শ্রমিক রপ্তানি বেড়েছে। এ বছরের প্রথম ছয় মাসে বিভিন্ন দেশে গেছেন ৬ লাখ ১৮ হাজার শ্রমিক। গত বছর শ্রমিক গেছেন রেকর্ড ১১ লাখ ৩৬ হাজার। শ্রমিক যাওয়া এভাবে বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই রেমিট্যান্স বাড়ার কথা। তবে আন্ডার ইনভয়েসিং এবং অর্থ পাচারের কারণে হুন্ডি বেড়েছে। আগস্টে রেমিট্যান্স ২১ দশমিক ৪৮ শতাংশ কমে ১৬০ কোটি ডলারে নেমেছে। আর অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ৩৫৭ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে যা ৫৬ কোটি ডলার বা ১৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ কম। অথচ ভরা করোনার মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছিল রেকর্ড ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার।
ব্যাংকাররা জানান, বর্তমানে ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে রেমিট্যান্স ও রপ্তানিতে ডলার কেনার সর্বোচ্চ দর ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা বেঁধে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ওপর আড়াই শতাংশ হারে প্রণোদনা পাচ্ছেন প্রবাসীর সুবিধাভোগীরা। তবে প্রতি সার্ভিস চার্জ বাবদ প্রতি ডলারে ৪ শতাংশ মতো খরচ করতে হয়। তবে অর্থ পাচার এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের অর্থ পরিশোধ করতে গিয়ে হুন্ডির চাহিদা অনেক বেড়েছে। এ কারণে খোলাবাজারে ডলারের দাম ১১৫ থেকে ১১৭ টাকা।
আমদানি কমলেও সংকট কাটেনি
২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৮ হাজার ২৫০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে। ডলারের সংকট থাকা এবং একই সময়ে আমদানি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপের কারণে গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) আমদানি ব্যয় ৬ হাজার ৯৫০ কোটি ডলারে নেমেছে। আমদানি কম হয় ১৩শ কোটি ডলার। অন্যদিকে ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয় হয় ৪ হাজার ৯২৫ কোটি ডলার। পরের অর্থবছর অর্থাৎ গত অর্থবছরে রপ্তানি আয় ৩০৯ কোটি ডলার বেড়ে ৫ হাজার ২৩৪ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সে অল্প প্রবৃদ্ধি হয় এবং আগের অর্থবছরের চেয়ে বাড়ে প্রায় ৬০ কোটি ডলার। ফলে আমদানির জন্য ১৩ বিলিয়ন ডলার কম খরচ হয়েছে। অপরদিকে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বেড়েছে ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। এতে চলতি হিসাবে ঘাটতি ১৮ বিলিয়ন থেকে কমে ৩ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে।
আমদানি ব্যয়ে বড় সাশ্রয় এবং রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় বাড়ার পরও ডলার সংকট থেকে বের হওয়া যায়নি। নতুন বিষফোঁড়া হিসেবে হাজির হয়েছে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি, যেখানে বড় অঙ্কের উদ্বৃত্ত ছিল। সংকটের কারণে ক্রমাগত মূল্য হারিয়েছে টাকা, শক্তিশালী হয়েছে ডলার। গত এক বছরের ব্যবধানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে ১০ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গত বছরের এই সময়ে রিজার্ভ ছিল ৩৯ বিলিয়ন ডলার, যা এখন ২৯ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী, ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ মাত্র ২৩ বিলিয়ন ডলার। চলতি সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নে ১১০ কোটি ডলারের বেশি পরিশোধ করতে হবে। এতে রিজার্ভ ২২ বিলিয়ন ডলারের নিচে নামতে পারে।
বিদেশি বিনিয়োগ ও ঋণ আসছে কম, বেড়েছে পরিশোধ
দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে। আবার রাজনৈতিক অস্থিরতার শঙ্কা, ডলার সংকট এবং একেক সময় একেক নীতির কারণে বিদেশি বিনিয়োগ ও ঋণ আসছে কম। একই সময়ে পরিশোধ অনেক বেড়েছে। আবার বছর দুয়েক আগে ২ থেকে ৩ শতাংশ সুদে বিদেশি ঋণ পাওয়া যেত। এখন সুদ ৯ শতাংশের বেশি। গত দুই বছরে ডলারের দর ৩০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। সব মিলিয়ে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ দ্রুত কমছে। গত এক বছরে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ প্রায় ৪১০ কোটি ডলার বা ৩০ শতাংশ কমে জুন শেষে ১ হাজার ৩৬৬ কোটি ডলারে নেমেছে। গত বছরের জুনে যা ১ হাজার ৭৭৬ কোটি ডলার ছিল। মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ১১ দশমিক ৪৪ শতাংশ কমে ৮৬৯ কোটি ডলারে নেমেছে। গত অর্থবছরে নিট বিদেশি বিনিয়োগ ১২ শতাংশ কমেছে। এসেছে মাত্র ১৬১ কোটি ডলার। সব মিলিয়ে গত জুন শেষে আর্থিক হিসাবে ২১৪ কোটি ডলারের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। গত বছরের জুন শেষে এই হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল ১ হাজার ৫৪৬ কোটি ডলার। মূলত আর্থিক হিসাবের ঘাটতিই দেশের ডলার বাজারে চাপ তৈরি করেছে।
বেড়েছে উৎপাদন খরচ
দেশের শীর্ষস্থানীয় ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ইউনিলিভার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জাভেদ আখতার সমকালকে বলেন, ইউনিলিভার বাংলাদেশ ৯০ শতাংশের বেশি পণ্য দেশে উৎপাদন করে থাকে এবং আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী তৈরি করতে অধিকাংশ কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করে থাকে। যখন গত বছর বৈশ্বিক দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি ঘটে এবং একই সঙ্গে এক বছরে বিনিময় হার ২৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়, তখন খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি ডলার সংকটের কারণে এলসি খোলার খরচও বেড়ে যায়, যা পণ্য তৈরির খরচ বাড়িয়ে দেয়। বাড়তি খরচ আংশিক পুনরুদ্ধারে তারা পণ্যের দাম গত বছর কিছুটা বাড়িয়েছিলেন। এ বছরও টাকার অবমূল্যায়ন চলমান। যেহেতু বৈষয়িক দ্রব্যমূল্য কিছুটা পড়তির দিকে, তখন ভোক্তাদের কথা চিন্তা করে তারা অনেক পণ্যের দাম কমিয়েছেন। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোও পূর্ণ সহযোগিতা করেছে এলসি দিয়ে সরবরাহ অব্যাহত রাখতে, যাতে করে দেশের ভোক্তাদের সব প্রয়োজন তারা মেটাতে পারেন।
দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল সমকালকে বলেন, ডলার সংকট এবং অনেক বেশি হারে এর দাম বেড়ে যাওয়ার প্রভাব তাদের ব্যবসার ওপর পড়েছে। ব্যবসার সম্প্রসারণ এবং নতুন বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি সংকুচিত হয়েছে। শিল্পের কাঁচামাল কিছু কিছু আসছে। কিন্তু উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। যার মূল কারণ ডলারের দর বেড়ে যাওয়া। এর প্রভাবে পণ্যের দামও বাড়াতে হচ্ছে এবং ভোক্তাদের ওপর চাপ বাড়ছে।
ডলারের দর বেড়ে যাওয়ার কারণে রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে সুবিধা হচ্ছে কিনা– জানতে চাইলে কামরুজ্জামান কামাল বলেন, বিনিময় হারের কারণে রপ্তানি আয়ের বিপরীতে আয় বেড়েছে। কিন্তু উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের দাম বাড়াতে গেলেই রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে হচ্ছে। তখন আবার রপ্তানি আদেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে অস্থিরতার কার্যকর সমাধান জরুরি।
উৎপাদন ও বিনিয়োগকেন্দ্রিক আমদানি কম হচ্ছে
ডলার সংকটের এ সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে আমদানি ব্যয় অনেক কমিয়েছে। যদিও সংকট না কমে দিন দিন বাড়ছে। কড়াকড়ির মধ্যে কাঁচামাল আনতে না পারায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। আবার উৎপাদন খাতের বড় অনেক কোম্পানি কাঁচামালের অভাবে সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারছে না। নানা জায়গায় ধরনা দিয়েও এ সমস্যার সমাধান মিলছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে মূলধনি পণ্যের আমদানি ১৭ দশমিক ৪০ শতাংশ কমেছে। তৈরি পোশাকসংশ্লিষ্ট পণ্যের কাঁচামাল আমদানি কমেছে ২২ দশমিক ২০ শতাংশ। মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। এর মানে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান হয় এ রকম পণ্য আমদানি কমছে।