দীর্ঘ দেড় বছরেও ডলার সংকটে সুরাহা হলো না। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ নিয়ে ডলার সংকট নিরসনের চেষ্টা কার্যত ব্যর্থ হয়ে গেছে। ব্যাংকগুলোতে ডলার সংকট কমেনি। তবে হঠাৎ করে খোলা বাজারে (কার্ব মার্কেট) বাড়ছে নগদ ডলারের দাম। কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে ডলার প্রতি দাম বেড়েছে ৫ থেকে ৬ টাকা। এখন এক ডলার কিনতে গ্রাহকদের গুনতে হচ্ছে ১১৭ থেকে ১১৮ টাকা। বিষয়টি নজরে আসার পর মাঠে নামে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। যেখানে খোলাবাজারে ডলার বেচাকেনা হয় সেখানে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে ডলারের জন্য হাহাকার চলছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ডলার কেনাবেচা হচ্ছে। তবে সবাই যে বিক্রি করবে এমন নাও হতে পারে। কারণ অনেকের কাছে ডলার নাও থাকতে পারে। যাদের কাছে ডলার আছে তারা কেনাবেচা করছে। যার কাছে নেই সে কেনাবেচা করবে না, এটাই স্বাভাবিক।
ডলার সংকট নিরসনে সি-িকেট ভাংতে বেশি দামে ডলার বিক্রির অপরাধে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত ও সিলগালা করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ভয়-আতঙ্কে ডলার বেচাকেনা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে খোলা বাজারে ডলারের হাহাকার দেখা দিয়েছে। গতকাল রোববার রাজধানীর মতিঝিল, পল্টন, বায়তুল মোকাররম এলাকা ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। একই দিন গুলশান বনানীসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়েও এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এসব এলাকায় মানি চেঞ্জারগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, মানি চেঞ্জারের কর্মীরা অলস বসে আছেন। বেচাকেনার কোনো কার্যক্রম নেই। যারা ডলার কেনার জন্য আসছেন তাদের সরাসরি বলে দিচ্ছেন ডলার নেই।
মানি চেঞ্জারগুলো একজনের কাছ থেকে কিনে আরেকজনের কাছে বিক্রি করে। এখন যে রেট দেওয়া আছে মানি চেঞ্জারগুলোকে ডলার বিক্রি করতে হলে ১১০ টাকায় ডলার কিনতে হবে। যদি কেউ ১১২ টাকার নিচে ডলার বিক্রি না করে তাহলে মানি চেঞ্জারগুলো ডলার পাবে কীভাবে? ডলার না পেলে সে বিক্রি করতে পারবে না।
মতিঝিল পাইওনিয়ার এক্সচেঞ্জ হাউজে ডলারের দাম জানতে চাইলে দায়িত্বরত কর্মকর্তা বলেন, রোববার ডলার রেট ১১২ টাকা ৫০ পয়সা। ‘৩০০ ডলার কিনব’ বলতেই বলেন, ডলার নেই ভাই। আজকে সকাল থেকে এখন পর্যন্ত ৩০০ ডলার কিনেছিলাম, বিক্রি করে দিয়েছি। এখন কোনো ডলার নেই।
অনুসন্ধান করতেই ক্রেতা সেজে আরেক মানি চেঞ্জারে ফোন দিলে সরাসরি বলে দেন, ‘ভাই ডলার নেই। কেউ এখন ডলার বিক্রি করছে না। আমরা না কিনতে পারলে বিক্রি করব কীভাবে? গত কয়েকদিন বিভিন্ন সংস্থার অভিযানে সবাই বেচাকেনা বন্ধ করে দিয়েছে। আজ এখন পর্যন্ত কোনো ডলার বেচাকেনা করতে পারিনি।’
মতিঝিলে ডলার কিনতে আসা মো. সোহানুর রহমান বলেন, থাইল্যান্ড যাব ৫ সেপ্টেম্বরের ফ্লাইটে। খরচের জন্য নগদ ডলার কিনতে কয়েকটি ব্যাংক ঘুরেছি কিন্তু ডলার পাইনি। এখন মানি চেঞ্জারে এসেছি, সেখানেও ডলার নেই। গুলশানের এক পরিচিত ব্যক্তিকে ফোন দিলাম ৪০০ ডলার ম্যানেজ করে দিতে। তিনি জানালেন ১১৮ টাকা পড়বে। নিতে বলেছি। কারণ, দাম যাই হোক ডলার ছাড়া যাব কীভাবে?
মতিঝিল, পল্টন, বায়তুল মোকাররম এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মানি চেঞ্জারগুলোতে ডলার বেচাকেনা হচ্ছে না। অনেকে বলছেন, অভিযানের কারণে ডলার বিক্রি করছে না প্রতিষ্ঠানগুলো।
ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে বিদেশে ডলার খরচ করা যায়। এখন কার্ডে প্রতি ডলারের মূল্য ১১১ টাকা ৫০ পয়সা। যেখানে ব্যাংকে প্রতি ডলার ১১২ টাকা আর খোলা বাজারে ১১৭ থেকে ১১৮ টাকা।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, মানি চেঞ্জারগুলো একজনের কাছ থেকে কিনে আরেকজনের কাছে বিক্রি করে। এখন যে রেট দেওয়া আছে তাতে মানি চেঞ্জারগুলোকে ডলার বিক্রি করতে হলে ১১০ টাকায় ডলার কিনতে হবে। যদি কেউ ১১২ টাকার নিচে ডলার বিক্রি না করে তাহলে মানি চেঞ্জারগুলো ডলার পাবে কীভাবে? ডলার না পেলে সে বিক্রি করতে পারবে না। তিনি আরো বলেন, এর আগেও খোলা বাজারে ১১৭ থেকে ১১৮ টাকায় ডলার কেনাবেচা হয়েছে। যখন বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের রেট ১১২ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করে দেয় তখন থেকে মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলো ডলার ধরে রাখছে। অপেক্ষা করছে দাম আরও বাড়ার। তাই সরবরাহ কম। তবে বাজারে যখন ডলার সরবরাহ বাড়বে তখন কেনাবেচাও বাড়বে। আর সরবারহ বাড়বেই, কারণ কেউ ডলার নিয়ে ঘরে বসে থাকবে না। যাদের নগদ ডলার প্রয়োজন তারা কী করবে? এমন প্রশ্নের জবাবে মুখপাত্র বলেন, শুধু কার্ব মার্কেটে না ঘুরে কার্ডের মাধ্যমে ডলার নেবে।
ব্যাংকাররা জানান, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে বিদেশে ডলার খরচ করা যায়। এখন কার্ডে প্রতি ডলারের মূল্য ১১১ টাকা ৫০ পয়সা। যেখানে ব্যাংকে প্রতি ডলার ১১২ টাকা আর খোলা বাজারে ১১৭ থেকে ১১৮ টাকা।
এদিকে বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে বেশি মূল্যে ডলার বিক্রি করায় গত সপ্তাহে ৭টি মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স স্থগিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে বেশি দামে ডলার লেনদেন করায় আরও ১০ মানি চেঞ্জারের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।
লাইসেন্স স্থগিত করা মানিচেঞ্জারগুলো হলো ইয়র্ক মানি এক্সচেঞ্জ, জামান মানি চেঞ্জিং হাউস, জেনি মানি এক্সচেঞ্জ লিমিটেড, স্ট্যান্ডার্ড মানি এক্সচেঞ্জ, মার্সি মানি এক্সচেঞ্জ, জেবি মানি এক্সচেঞ্জ ও বেঙ্গল মানি এক্সচেঞ্জ।
অপরদিক ব্যাখ্যা তলব করা ১০ মানি চেঞ্জার হলো—নিউ প্রাইম মানি চেঞ্জার, উত্তরা মানি চেঞ্জার, মিসা মানি এক্সচেঞ্জ, যমুনা মানি এক্সচেঞ্জ, পাইওনিয়ার মানি এক্সচেঞ্জ, বুড়িগঙ্গা মানি এক্সচেঞ্জ, স্কাফ মানি চেঞ্জার, হযরত খাজা বাবা মুদ্রা বিনিময় কেন্দ্র, গ্লোরি মানি এক্সচেঞ্জ ও মাতৃক মানি চেঞ্জার। এছাড়া মতিঝিলের নিয়ন মানি চেঞ্জার এবং পল্টনের জনী ট্রেডার্সের বিষয়ে যাচাই বাছাই করা হচ্ছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত বছরের মার্চ থেকে দেশে ডলার-সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এ সংকট মোকাবিলায় শুরুতে ডলারের দাম বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এতে সংকট আরও বেড়ে যায়। পরে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায়। এ দায়িত্ব দেওয়া হয় ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) ওপর। এ দুই সংগঠন মিলে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় এবং আমদানি দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে ডলারের দাম নির্ধারণ করে আসছে।
এদিকে রেমিট্যান্স-রপ্তানি আয়ে ডলারের দাম এখন এক রেট করা হয়েছে। গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে রপ্তানিকারকরা প্রতি ডলারের দাম ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা পাচ্ছেন। আগে যা ছিল ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা। রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের দাম ৫০ পয়সা বাড়িয়ে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা করা হয়েছে। এছাড়া আমদানিতে ডলারের দর হবে ১১০ টাকা। আগে যা ছিল ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। ##