দেশের ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা চলে গেছে। এগুলো তো ব্যাগে করে নিয়ে যায়নি। একটি মাধ্যমে গেছে। কোথায় গেছে তারও রেকর্ড আছে সংস্থাগুলোর কাছে। চাইলেই এটি বের করা সম্ভব বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ। তিনি আরো বলেছেন, দেশে তিন বছরে বিদেশী ঋণ ৫০ বিলিয়ন থেকে বেড়ে ১০০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। ২০২৫ সাল থেকে আমাদের ৫ বিলিয়ন ডলার করে বিদেশী ঋণ ফেরত দিতে হবে। যেভাবে ঋণ গ্রহণ বাড়ছে এভাবে বাড়তে থাকলে আগামীতে প্রতি বছর আরো বেশি করে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। চীনা কোনো ব্লকে বাংলাদেশের যোগদান সমীচীন হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
গতকাল ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় সভায় তিনি এ মন্তব্য করেন। সভায় ইআরএফ সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধা ও সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম উপস্থিত ছিলেন।
ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘আমরা যেসব বড় বড় প্রকল্প নিচ্ছি, এগুলোর ব্যয়ের সাশ্রয় হচ্ছে কি না, প্রকৌশল দিক থেকে কোনো ত্রুটি আছে কি না? বাস্তবায়নের দক্ষতা আছে কি না? আমি প্রকল্প পাস করলাম ৫ বছরের জন্য বাস্তবায়ন করতে। দেখা গেল ১৫ বছরেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। খরচ ও সময় তিন গুণ বেড়ে যাচ্ছে। প্রত্যেকটি প্রজেক্টেই যদি এই রকম হয় তাহলে তো বাচ্চা ছেলেরা বলে দিতে সব প্রজেক্টের খরচ ও সময় তিনগুণ বাড়বে। তাহলে কেন আমরা এসব অব্যাহত রাখছি। আমাদের ঋণের সক্ষমতা কতটুকু, ভবিষ্যতে দেনার দায় কতটুকু হবে? আমাদের সক্ষমতা কতটুকু বাড়বে। এই হিসাবটা কে করছে। বর্তমানে আমরা যেখানেই ঋণ পাচ্ছি সেখান থেকেই নিচ্ছি। শুরুর দিকে এটা ভালো কিন্তু এটা একটা জায়গায় এসে চিন্তা করতে হবে আমরা কোথায় আছি, কতদূর যেতে পারব।’ তিনি বলেন, ‘আমরা যেসব বড় অবকাঠামো করছি তার প্রায় সবই ঋণের টাকা। আমরা যদি এভাবে সব অবকাঠামো ঋণের টাকায় করতেই থাকি, একটার পর একটা প্রকল্প হাতে নিতেই থাকব? কিন্তু প্রশ্ন হলো একসময় আমাদের এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এসব অবকাঠামো ব্যবহারে সমন্বয় না থাকলে এর সুফল ভোগ করা যাবে না।’
বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘বড় বড় অবকাঠামোগুলো প্রথমত মানুষের যান চলাচলে সুবিধা হয়। একটা ন্যাশনাল প্রেস্টিজেরও বিষয় আছে, সেজন্য এগুলোকে প্রেস্টিজ প্রজেক্ট বলা হয়। আমরা পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় উচ্ছ্বসিত হয়। এই প্রজেক্টগুলো যদি এমন হয় মানুষ একটু আরামদায়ক ও সময় কম লাগবে তাহলে তো এর সুফল নিয়ে প্রশ্ন থাকবে। কিন্তু এই প্রকল্পের ফলে যদি দেশী বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ে তাহলে এর সুফল পাওয়া যাবে।’
ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘একসময় আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছিল। তখন আমরা যত ইচ্ছা প্রকল্প নিচ্ছিলাম। কারণ আমাদের তো যথেষ্ট রিজার্ভ আছে। কিন্তু ভবিষ্যতে হঠাৎ করে যে কোনো চাপ আসতে পারে সেটা চিন্তায় ছিল না। আমরা কখনো সমন্বিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা অনুযায়ী চলিনি। আমাদের আত্মতুষ্টি এসে গিয়েছিল।’ তিনি বলেন, ‘রিজার্ভ রাখা হয় এ কারণে যাতে বিদেশীদের আস্থা ও বিনিয়োগ বাড়ে। এটা কখনোই নিজেদের ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয় না। এটা যেন আপদের সময়ে কাজে লাগে। রিজার্ভের মাধ্যমে সারা দুনিয়াকে জানানো হয় যে আমাদের অর্থনীতি স্থিতিশীল আছে। যাতে এর ফলে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ে। আমরা ভালো করছি বলে আমরা বিনিময় হারগুলো সময়মতো সমন্বয় করিনি।’
ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, দেশের ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা চলে গেছে। এগুলো তো ব্যাগে করে নিয়ে যায়নি। কোনো ব্যাংকের মাধ্যমে নিয়ে গেছে। কোনো অ্যাকাউন্টে ঢুকেছে। বেনামে গেলেও অ্যাকাউন্টের তথ্য ব্যাংকগুলোর কাছে আছে। ১০ লাখ টাকার ওপরে লেনদেন হলে রেকর্ড থাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভারে। তারা চাইলেই টাকা কোথায় গেছে এটা জানা সম্ভব। কারণ ব্যাংকিং সিস্টেমে সব তথ্যই রেকর্ড থাকে। টাকা কোথায় গেছে, কার কাছে সবই জানা যায়।
হলমার্কের কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত ব্যক্তিকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের সমালোচনা করে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, হলমার্কের কেলেঙ্কারি হয়েছে, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় জেলগেটে গিয়ে। এটা তো অনেক পুরনো একটি সিস্টেম। সে কোথায় টাকা নিয়ে গেছে এটা জেলগেটে গিয়ে কেন জিজ্ঞাসা করতে হবে। তাহলে ডিজিটাল সিস্টেম করে লাভ কী? ব্যাংক চাইলে তার লেনদেনের সব তথ্যই বের করতে পারবে সে কোন কোন জায়গায় টাকা পাঠিয়েছে। তিনি বলেন, কানাডার বেগমপাড়া, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থপাচারের তথ্য আমরা শুনি। যেখানে আমরা শুনি-জানি সেখানে ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিগুলো অবশ্যই জানে কিন্তু বলে না।
অর্থপাচার অর্থনীতির জন্য ক্ষতি জানিয়ে অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন বলেন, যেকোনোভাবে অর্থপাচার হোক না কেন তা দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতি অর্থাৎ অর্থপাচার হলে ক্ষতি হবে। তিনি বলেন, আগে শুধু আমদানি-রফতানিতে দাম কমবেশি দেখিয়ে অর্থপাচার হতো। এখন অর্থপাচারের অনেকগুলো মাধ্যম সৃষ্টি হয়েছে। যে যেভাবে সুযোগ-সুবিধা পায় সে সেভাবেই পাচার করে। অর্থপাচার বাড়লে রেমিট্যান্স কমে যাবে। দুর্নীতি অর্থপাচারের বড় কারণ জানিয়ে ড. ওয়াহিদউদ্দিন বলেন, যারা দুর্নীতি করে অর্থ উপার্জন করছে তারা যদি মনে করে দেশে এ অর্থ রাখা নিরাপদ নয়, তারা যেকোনো কৌশলে অর্থপাচার করবে। এখন অনেকে দ্বৈত নাগরিক হওয়ার জন্য বিদেশে অর্থ নিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, অর্থপাচারের আরেকটি সহজ মাধ্যম অফশোর ব্যাংকিং। এখন অনেক ব্যাংক বিদেশে অফশোর ব্যাংকিং চালু করেছে, যার মাধ্যমে চাইলে অর্থপাচার করা যায়। কারণ অফশোর ব্যাংকিংয়ের শাখায় কত অর্থ সংগ্রহ করছে তার কোনো হিসাব নেই। নিজেদের মতো অর্থ সংগ্রহ করে ইচ্ছেমতো রেখে দিচ্ছে। আর ব্যাংকের মালিকরা চাইলে তার কোনো হিসাবই থাকে না।
প্রণোদনা দিয়ে রেমিট্যান্স বাড়ানো সম্ভব নয় জানিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, রেমিট্যান্স বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু আশানুরূপ রেমিট্যান্স আসছে না। আর আসবেও না। রেট বাড়িয়ে রেমিট্যান্স আনা যাবে না। কারণ বিদেশে অর্থের চাহিদা যদি না কমে তাহলে কোনোভাবেই পাচার রোধ করা যাবে না। যাদের অর্থ নেয়ার প্রয়োজন হবে তারা যেকোনো উপায়ে অর্থপাচার করে নিয়ে যাবেই।
অর্থনীতি অনেক ভালো ছিল বলেই এখন বেশি খারাপ মন্তব্য করে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছিল। আমরা যত ইচ্ছা প্রকল্প নিচ্ছিলাম। আমাদের তো যথেষ্ট রিজার্ভ আছে, কোনো অসুবিধা নেই। ভবিষ্যতে যে হঠাৎ করে কোনো চাপ আসতে পারে, সেটা চিন্তায় ছিল না। যার কারণে আমরা সময়মতো সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারিনি। মূল্যস্ফীতি বেড়েছে প্রতি বছর কিন্তু দীর্ঘদিন ডলার রেট ধরে রেখেছে, বাড়তে দেয়নি। যার কারণে এখন বেশি সমস্যায় পড়েছে। কারণ হঠাৎ করে দাম বেড়ে যাওয়ায় চাপে পড়েছে অর্থনীতি। আগে থেকে যদি আস্তে আস্তে দাম বাড়ত তাহলে এখন দাম বেড়ে এমন সমস্যায় পড়তে হতো না। তিনি বলেন, রিজার্ভ অনেকে আছে বলে আমরা একের পর এক বড় বড় অবকাঠামোগত প্রকল্প করছি। এগুলো ঋণের মাধ্যমে করা হচ্ছে। এর মধ্যে অনেকগুলো আছে প্রয়োজনীয়। অনেকগুলো আবার এ সময়ে প্রয়োজন ছিল না।