যুদ্ধসহ নানা করণে বিশ্বজুড়ে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা প্রকট আকার ধারণ করতে পারে বলে আভাস দিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (আইএফপিআরআই)। সম্প্রতি বিশ্বের ১৯ দেশ তাদের ২৫টি কৃষি ও খাদ্যপণ্য, তিন প্রকারের সার রপ্তানিতে অতিরিক্ত করারোপ, কোটা নির্ধারণ এবং নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। কড়াকড়ির মাধ্যমে দেশগুলো নিজেদের খাদ্যশস্যের মজুত ঠিক রাখতে চায়। ফলে আগামীতে ওই সব দেশ থেকে ২৫টি পণ্য কেনা অন্যদের জন্য দুরূহ হয়ে পড়বে। এতে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও খাদ্য উৎপাদন ও পণ্য আমদানি নিয়ে বিপাকে পড়ার শঙ্কা আছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
তারা বলছেন, সারের অভাবে কমতে পারে ধানসহ অন্যান্য ফসলের উৎপাদন। বাড়তে পারে মূল্যস্ফীতি এবং সংকট হতে পারে নিত্যপণ্যের। সব মিলিয়ে বিশ্বে এক ধরনের খাদ্য নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে বলে আইএফপিআরআই’র গবেষণায় বলা হয়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এই নিষেধাজ্ঞার তালিকা ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে বলে জানিয়েছে আইএফপিআরআই। ৮ আগস্ট ‘ফুড এক্সপোর্ট রেস্ট্রিকশনস ডিউরিং দ্য ইউক্রেন-রাশিয়া ক্রাইসিস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব দাবি করে আইএফপিআরআই।
সংস্থাটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিষেধাজ্ঞা আরোপকারী দেশ ও নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়া পণ্যগুলো হলো- আফগানিস্তানের গম, আলজেরিয়ার পেস্তা, আটা ও ভেজিটেবল অয়েল, আর্জেন্টিনার গরুর মাংস, আজারবাইজানের পেঁয়াজ, বেলারুশের আপেল, বাঁধাকপি ও পেঁয়াজ, বুরকিনা ফাসোর ময়দা, ভুট্টার আটা, যবের আটা, ক্যামেরুনের ভেজিটেবল অয়েল, চীনের ভুট্টার মাড়, ভারতের ভাঙা চাল, সব ধরনের সিদ্ধ চাল, চিনি, গম, গমের আটা, সুজি ও ময়দা, কসোভোর গম, ভুট্টা, ময়দা, ভেজিটেবল অয়েল ও লবণ, লেবাননের প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, শাক-সবজি ও ময়দা, মরক্কোর টমেটো, পেঁয়াজ ও আলু, পাকিস্তানের চিনি, রাশিয়ার চাল, চালের কুড়া, সার্বিয়ার ভুট্টা ও সূর্যমুখী তেল, তিউনিসিয়ার ফল ও শাকসবজি, তুরস্কের গরু, ভেড়া ও ছাগলের মাংস এবং ভোজ্যতেল, মসুর ডাল ও মটরশুঁটি।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা প্রতিবেদন ২০২৩-এ বলা হয়েছে-দেশে সব ধরনের খাদ্যশস্য উৎপাদন হয় ৪ কোটি ৮৪ লাখ ৯৮ হাজার টন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে চালের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৪ কোটি টন। চালের উৎপাদন প্রায় ৪ কোটি ৩০ লাখ টন। পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৩৬ লাখ টন। উৎপাদন প্রায় ৩৪ লাখ টন। আলুর বার্ষিক চাহিদা ৭০ থেকে ৭৫ টন। আলুর বার্ষিক উৎপাদন ১ কোটি ২০ লাখ টন। সব ধরনের মাছে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। বাংলাদেশ আলু ও মাছ রপ্তানি করে।
টিসিবির হিসাবে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা ১৪ লাখ টন। উৎপাদন হয় ৩ লাখ টন। বাকি ১১ লাখ টন তেল আমদানি করতে হয়। চিনির বার্ষিক চাহিদা ১৮ থেকে ২০ লাখ টন। মাত্র ২০ হাজার টন চিনি উৎপাদন হয়। বাকি প্রায় ১৯ লাখ ৮০ হাজার টন আমদানি করতে হয়। সব ধরনের ডাল জাতীয় পণ্যের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২৬ লাখ টন। উৎপাদন হয় মাত্র ১০ লাখ টন। আমদানি করতে হয় প্রায় ১৬ লাখ টন। কৃষি বিভাগের হিসাব মতে গমের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৭২ লাখ টন। দেশে উৎপাদন হয় মাত্র ১০ থেকে ১২ লাখ টন। আমদানি করতে হয় প্রায় ৬০ লাখ টন। এসব পণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে সারের বার্ষিক চাহিদা ৬৮ লাখ ৬২ হাজার টন। চাহিদার ৯০ ভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এছাড়া বিপিসি’র হিসাবে জ্বালানি তেলের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৬৫ লাখ টন। আমদানি করতে হয় ৫৪ লাখ ৬৩ হাজার টন। চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। উল্লিখিত বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক যুগান্তরকে বলেন, বিশ্বের প্রতিটি দেশ খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে সজাগ। তিনি সতর্ক করে বলেন, গমের দাম বেড়েছে, আরও বাড়বে। ১৬ কোটি মানুষকে আমদানি করে খাওয়ানো যাবে না। সেই ক্ষেত্রে জরুরি ভিত্তিতে উৎপাদন বাড়াতে হবে। সয়াবিন আমদানি বাদ দিয়ে ডলার সেভ করতে হবে। সরিষা ও রাইস ব্র্যান তেল উৎপাদন বাড়াতে হবে। সার আমদানির পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে উৎপাদন বাড়াতে হবে। সব ধরনের খাবারের বিকল্প সোর্স তৈরি করতে হবে। কৃষকদের সার, বীজ এবং সেচ সহায়তা দিয়ে উৎপাদন বাড়াতে হবে। অন্যথায় পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না।
খাদ্য সচিব মো. ইসমাইল হোসেন এনডিসি যুগান্তরকে বলেন, আমাদের প্রধান খাদ্য হচ্ছে চাল। আমরা চালে স্বয়ংসম্পূর্ণ। গম আমদানি করতে হয়। তবে গম আমদানি না করলেও চাল দিয়ে আমরা গমের অভাব পূরণ করতে পারি। প্রাকৃতিক ভাবেই দেশের আবহাওয়া গম উৎপাদনের অনুকূল নয়। সুতরাং প্রধান খাদ্যে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ এটা বলাই যায়। কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার যুগান্তরকে বলেন, প্রতিটি দেশ খাদ্য মজুতে তৎপর হয়ে উঠেছে। সচেতনভাবে পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছি। সার আমদানি নিয়ে তেমন কোনো সমস্যা হবে না। আন্তর্জাতিক দরপত্রে আমরা চুক্তি করেছি। আমাদের উৎপাদনও ভালো হচ্ছে। তবে বাজার আমাদের মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে না। বাজার আমরা কন্ট্রোল করি না। তিনি আরও বলেন, দেশে সব জিনিসপত্রের সরবরাহ স্বাভাবিক। কিন্তু বাজারে গেলে দেখা যায় চড়ামূল্য। কেন তা বুঝতে পারছি না। ভোজ্যতেল আমদানিসংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, রাইস ব্র্যান তেল উৎপাদনে যেতে হবে। এটা দেশের জন্য ভালো, ডলার সেভ হবে। কৃষি সচিব বলেন, এত ফসল উৎপাদন হয় কোথায় যে যায় ভেবেই কূল পাচ্ছি না।
এদিকে ৪টি দেশ সার রপ্তানিতে করারোপ, রপ্তানি কোটা ও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বলেও আইএফপিআরআই’র প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। চীন ফসফেট শিলা ও ইউক্রেন নাইট্রোজেন সারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। আবার চীন সব ধরনের সার ও রাশিয়া নাইট্রোজেন সারে রপ্তানি কোটা নির্ধারণ করে দিয়েছে। অন্যদিকে ভিয়েতনাম মিনারেল ফার্টিলাইজারে রপ্তানির ওপর করারোপ করেছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশে ইউরিয়া সারের উৎপাদন প্রায় ১০ লাখ টন। বাকিটা রাশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও কাতার থেকে আমদানি করা হয়। দেশে টিএসপি সার উৎপাদন হয় ১ লাখ টন। বাকি সাড়ে ৬ লাখ টন আমদানি করতে হয় মরক্কো ও তিউনিসিয়া থেকে। ডিএপি সার দেশে দেড় লাখ টন উৎপাদন হয়। বাকিটা চীন ও জর্ডান থেকে আমদানি করা হয়। এমওপি সারের ৮ লাখ টনের চাহিদার পুরোটাই বেলারুশ, রাশিয়া ও কানাডা থেকে আমদানি করা হয়।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ সাজ্জাদ যুগান্তরকে বলেন, সার আমদানিতে কোনো সমস্যা হবে না। কারণ আমরা আন্তর্জাতিক দরপত্রে ফরমুলা প্রাইসে চুক্তি করি। রাশিয়া ও কানাডা থেকে এমওপি আমদানি করা হয়। ডিএপি সার আসে সৌদি আরব এবং মরক্কো থেকে। টিএসপি আসে মরক্কো এবং তিউনিসিয়া থেকে। তাদের সঙ্গে আমাদের ৬ মাস কিংবা এক বছর করে চুক্তি হয়। ফরমুলা প্রাইসে আমদানিতে চুক্তিবদ্ধ দুই দেশ ছাড়া অন্য কারও ওপর নির্ভর করে না। সুতরাং সার আমদানি নিয়ে তেমন কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।