নানাকারণে জট লেগেছে মানবপাচার মামলার। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গঠিত ‘মানবপাচার দমন ট্রাইব্যুনাল’র কার্যক্রমেও ভর করেছে শৈথিল্য। করোনার সময় কিছুদিন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ ছিলো মানবপাচার সংক্রান্ত মামলার বিচার। পরবর্তীতে নিয়মিত আদালত চালু হলেও আসেনি কাক্সিক্ষত গতি। সাক্ষী হাজির না হওয়া, বাদী-বিবাদী আপস-মীমাংসা, সরকারপক্ষীয় আইনজীবীদের গাফলতি নানাবিষয় গতি মন্থরতার কারণ। অথচ মানবপাচারের মতো গুরুতর ঘটনা বাড়ছে দিনকে দিন। আইনজ্ঞরা বলছেন, মানবপাচার অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় অপরাধের প্রবণতা বেড়েই চলছে। বিশ্লেষকগণ মনে করছেন, বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা, দৃৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া, সর্বোপরি আন্তরিকতার অভাবেই মানবপাচার বৃদ্ধি পেলেও সেই অনুপাতে বিচার নেই।
আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মানব পাচারের মতো গুরুতর অপরাধের হার ক্রমেই বাড়ছে। অথচ সে অনুযায়ী এ সংক্রান্ত অপরাধের বিচার হচ্ছে না। শাস্তি পাচ্ছে না পাচারের সঙ্গে জড়িত অপরাধী চক্র। বিশ্লেষকদের মতে, শাস্তি না পাওয়াই হচ্ছে মানব পাচার বেড়ে যাওয়ার বড় কারণ। তবে মানবপাচারের শাস্তি ভয়াবহ হলেও বিচার না হওয়ার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান এখন দ্বিতীয় টায়ারে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিকভাবে এক ধরনের চাপেও রয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে ২০২১ সালে গঠন করা হয় ‘মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল’। দেশে এখন বিভাগওয়ারি ৭টি ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। আইনমন্ত্র্রী আনিসুল হকের মতে, মানবপাচারের ক্ষেত্রে আমরা দ্বিতীয় টায়ারে আছি। এ কারণে ২০২১ সালের মার্চ মাস থেকে ট্রাইব্যুনাল চালু হয়েছে। মানবপাচারের বিচার না হলে মানবপাচার রোধে আমাদের অবস্থান অবনমিত হওয়ার একটা আশঙ্কা রয়েছে।
আদালত সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন আদালতে ৬ হাজারের বেশি মানবপাচারের মামলা রয়েছে। বিভিন্ন আদালত নিজস্ব এখতিয়ার বলে মামলাগুলোর বিচার কার্যক্রম পরিচালিত করতো। কিন্তু পৃথক আদালত না থাকায় এ সংক্রান্ত বিচারগুলো দীর্ঘসূত্রিতায় পর্যবসিত হয়। অপরাধীরা আইনের ফাক দিয়ে বেরিয়ে যায়। চূড়ান্ত পর্যায়ে তাদের শাস্তির আওতায় আনা যায় না। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিলো আইনগত দুর্বলতাও। এ প্রেক্ষাপটে সরকার ২০১২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সংসদে ‘মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন-২০১২’ পাস হয়। আইনটিতে মানবপাচারের সঙ্গে জড়িতের অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- বা যাবজ্জীবন কারাদ-ের বিধান রয়েছে। আইনটি পাস হলেও কার্যকর করতে লেগে যায় ৮ বছর। কারণ আইনের ২১(১) ধারায় এ আইনে বিচারের জন্য পৃৃথক ট্রাইব্যুনাল স্থাপনের কথা বলা হয়। একটি কেন্দ্রীয় ‘মনিটরিং সেল’ গঠনেরও বাধ্যবাধকতা রয়েছে আইনে। তা সত্ত্বেও সরকার ট্রাইব্যুনাল স্থাপনে কালক্ষেপণ করে। সরকারের নিষ্ক্রিয়তা চ্যালেঞ্জ করে একাধিক রিটও হয়। একপর্যায়ে চলতি বছর মার্চে গঠন হয় ট্রাইব্যুনাল। পরে এক আদেশে বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন মানব পাচারের মামলা ‘মানবপাচার দমন ট্র্রাইব্যুনাল’-এ স্থানান্তর করা হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর এবং বরিশালে ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করা হয়।
রাজশাহীতে মানবপাচার দমন ট্রাইব্যুনালে জেলা জজ লিয়াকত আলী মোল্লা, এম.এ.আউয়াল খুলনা ট্রাইব্যুনাল, জেলা জজ মো. নূর ইসলাম রংপুর ট্রাইব্যুনাল, মো.সাইফুর রহমান সিলেট মানবপাচার অপরাধ দমন ট্র্রাইব্যুনাল, জেলা জজ জান্নাতুল ফেরদৌস চট্টগ্রাম মানবপাচার দমন ট্রাইব্যুনাল, কাজী আবদুল হান্নান ঢাকা মানব পাচার দমন ট্রাইব্যুনাল এবং জেলা জজ মো.মঞ্জুরুল হোসেন বরিশাল মানবপাচার দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবে প্রথম নিয়োগ দেয়া হয়। গত ৮ মার্চ তাদের এসব পদে নিয়োগ দেয়া হয়। পরবর্তীতে এসব পদে রদবদল হয়। এছাড়া নিয়োগের পর কিছুদিন দায়িত্ব পালনের পরই আদালত বন্ধ হয়ে যায়। করোনা সংক্রমণের পর ‘সাধারণ ছুটি’ বাড়তে থাকে। ‘আপদকালীন ব্যবস্থা’ স্বরূপ বিশেষ আদালত, মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতগুলোতে ‘ভার্চুয়াল বেঞ্চ’ স্থাপন করা হয়। এসবে জামিন ও জরুরি বিষয় শুনানি হয়। সুপ্রিম কোর্টের স্পেশাল অফিসার ব্যারিস্টার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান এই প্রতিবেদককে বলেন, করোনার সময় সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশিত কয়েকটি আদালতে ভার্চুয়াল বেঞ্চ চালু ছিলো। তখন মানবপাচার ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রম কিছুটা শ্লথ ছিলো। এখন সেই পরিস্থিতি থেকে অনেকটাই উত্তরণ ঘটেছে।
এদিকে আদালত বন্ধ থাকলেও দায়ের হচ্ছে মানবপাচারের নতুন মামলা। ২০২০ সালের ২৮ মে লিবিয়ায় পাচারের শিকার ২৬ বাংলাদেশি অভিবাসী প্রার্থীকে হত্যা করা হয়। আহত হন ১১ বাংলাদেশি। আরও অন্তত ১৯ বাংলাদেশি লিবিয়ায় মাফিয়া চক্রের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। মর্মান্তিক এ ঘটনায় দেশে নতুন করে আলোচনায় মানবপাচারের বিষয়টি। লিবিয়ার ঘটনায় ইতিমধ্যে পৃথক ১০টি মামলা হয়েছে। আসামি করা হয়েছে ৩৮ জনকে। এর মধ্যে বেশকয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এখনও গ্রেফতার প্রক্রিয়া চলমান।
মানবপাচার প্রতিরোধ আইনের মামলাগুলো মনিটরিং করে পুলিশ সদর দপ্তরের স্পেশাল ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট শাখা। এ শাখা থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, মানবপাচার প্রতিরোধ আইনের ১৪৫টি মামলা এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বিচারাধীন রয়েছে। ৭ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন রয়েছে ৪৭৮টি মামলা। এসব মামলার অধিকাংশই সময়মতো সাক্ষী হাজির করতে না পারায় বিচার নিষ্পত্তি হয়নি। এছাড়া মামলার তদন্তে ধীরগতির কারণেও অনেক মামলা কাঠগড়া পর্যন্ত ওঠেনি। আর এই ফাক গলে বাড়ছে পাচারের ঘটনা। পাচাররোধেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নেই তেমন সাফল্য।
সূত্র মতে, গত বছর জুলাইয়ের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মানবপাচার সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, মানবপাচার নির্মূলে ন্যূনতম যা যা করা প্রয়োজন বাংলাদেশ সরকার সেটি নিশ্চিত করতে পারেনি। বাংলাদেশ সরকারের পাচারবিরোধী তৎপরতার জন্য কোভিড-১৯ এর মহামারির প্রভাব রয়েছে। ২০২১ সালের আগস্ট মাস থেকে পাচারবিরোধী ৭টি ট্রাইব্যুনাল পুনরায় কার্যক্রম শুরু করেছে। রংপুর ও রাজশাহী ট্রাইব্যুনাল তৃতীয় ও চতুর্থ আদালত হিসেবে পাচারকারীদের দোষী সাব্যস্ত করেছে। এছাড়া সরকার জবরদস্তিমূলক বলপ্রয়োগ ও দাসত্বমূলক শ্রমে বাধ্য করার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বাধ্যতামূলক শ্রম সনদের প্রটোকল অনুসমর্থন করেছে। তবে সরকার বেশকয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ন্যূনতম মান পূরণ করতে পারেনি। সরকার আগের বছরের প্রতিবেদনের তুলনায় পাচারের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের শনাক্ত করার ক্ষেত্রে কম চিহ্নিত করতে পেরেছে। পাচারের শিকার হওয়া ভুক্তভোগীদের পরিচর্যার ক্ষেত্রে সরকারের দিক থেকে ঘাটতি রয়ে গেছে। সরকার জনশক্তি দালালদের বিরুদ্ধে নিয়মিতভাবে ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে এটি তাদের পাচারকারীদের কবলে ফেলার ঝুঁকিতে ফেলেছে।
চলতিবছর ২৬ বিবিসি প্রকাশিত ‘ট্রাফিকিং ইন পার্সন্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে জানায়, যারা মানবপাচারে যুক্ত থাকে, তারা আসলে অন্য কাজের তুলনায় এ কাজে বেশি অর্থ আয় সম্ভব হয় বলে এই অপরাধের সাথে জড়ায়। তাদের হিসাবে, প্রতিটি মানবপাচারের জন্য একজন পাচারকারী ৫০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করে। এটি প্রচলিত পেশার তুলনায় অনেক বেশি। বাংলাদেশের সাথে প্রত্যাবাসনের চুক্তি রয়েছে সেসব দেশ থেকে যাদের ফেরত আনা ব্যক্তিদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়।
কিন্তু যেসব দেশের সাথে প্রত্যাবাসন চুক্তি নেই সেসব দেশে বাংলাদেশ থেকে কত মানুষ পাচার হয়েছে সে সংক্রান্ত কোন তথ্য প্রতিবেদনটিতে নেই। তবে এটি উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের ভেতরেই অনেকে পাচারের শিকার হয়। এক হিসাব মতে, ২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে চলতি বছর জানুয়ারি পর্যন্ত ৭৩০টি মানবপাচারের ঘটনার তথ্য সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ২০১৭ সালে ৭৭৮টি এবং ২০১৮ সালে ৫৬১ টি মানবপাচারের ঘটনা প্রচার পায়। তবে এটি বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া সংখ্যার চেয়ে প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি। মানবপাচার, মামলার তদন্ত এবং বিচারে ধীরগতি সম্পর্কে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পীস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি)র প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, মানবপাচারকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় পাচারের ঘটনা বেড়েই চলেছে। সরকার প্রকৃত অর্থেই যদি মানবপাচার রোধ করতে চায় তাহলে অন্তত বিচারাধীন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়া উচিত। আন্তরিকতার একটি ঘাটতি এখানে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।