দুই যুগ ধরে রাজধানীর মিরপুরের মধ্য পাইকপাড়ায় বসবাস করেন রেন্ট-এ-কারের ব্যবসায়ী মো. ইব্রাহিম। এলাকার অলিগলি তাঁর চেনা। তাই বিয়ের পর সেখানেই নতুন বাসা নিয়ে সংসার সাজান। পরিবারে আসে দুই সন্তান– আরাফাত হোসেন রাউফ ও ইসনাত জাহান রাইদা। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুখী পরিবার। কিন্তু ডেঙ্গুতে এক সপ্তাহের ব্যবধানে দুই সন্তানকে হারিয়ে এলোমেলো তাঁর জীবন।
ইব্রাহিম থাকতেন মধ্য পাইকপাড়ার ৮০/১০ বাসার দ্বিতীয় তলায়। বাসার কোনায় কোনায় এখন ৯ বছরের রাউফ ও ৭ বছরের রাইদার স্মৃতিচিহ্ন। সন্তানদের এসব স্মৃতিচিহ্ন ঘিরে এখন ইব্রাহিম ও স্ত্রী রাবেয়া আক্তারের হাহাকার। যন্ত্রণা সইতে না পেরে তারা ছেড়ে দিয়েছেন সেই বাসা।
ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গত ১৮ আগস্ট মারা যায় রাউফ। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ২৫ আগস্ট না-ফেরার দেশে চলে যায় ছোট্ট রাইদা। তারও ডেঙ্গু হয়েছিল। দিনভর পরিশ্রম করে বাসায় ফিরে সন্তানদের মুখ দেখলেই হারিয়ে যেত ইব্রাহিমের সব কষ্ট। আজ সেই বাসায় শুধু হাহাকার, যেন সবকিছু মুখ থুবড়ে পড়েছে! দেয়ালের দিকে তাকালেই ইব্রাহিম-রাবেয়ার চোখ জলে ভরে ওঠে, সেখানেও যে লেগে আছে সন্তানদের হাতের চিহ্ন! এ এক অন্য রকম লড়াই। দুই সন্তান হারিয়ে একাকী সে লড়াই করছেন ইব্রাহিম-রাবেয়া দম্পতি। এই বাসায় কষ্ট সইতে না পেরে গেছেন নতুন ঠিকানায়, আপাতত মিরপুর ১ নম্বরের ধানক্ষেত মোড়ে। এটি রাউফ-রাইদার মামার বাড়ি। অক্টোবরে উঠবেন নতুন বাসায়।
একেবারে কাছের স্বজন ছাড়া এই দম্পতির পাশে কেউ নেই!
অথচ করোনার সময় বহু সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও ব্যক্তিকে আমরা ভুক্তভোগীদের পাশে দাঁড়াতে দেখেছি। ডেঙ্গুতে স্বজনহারা পরিবারগুলো যেন বড়ই অসহায়। মন্ত্রী, এমপি, সিটি করপোরেশন, ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও রাজনৈতিক নেতা– কেউই পাশে নেই। ধারকর্জ করে চিকিৎসা ব্যয় মেটানোর পর স্বজন হারানো অনেক পরিবার পড়ছে নতুন সংকটে। সংসারের হিসাবে টান পড়েছে তাদের।
সন্তানদের স্মৃতিঘেরা বাসাটি ছাড়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে মো. ইব্রাহিম বলেন, ‘যে বাড়িতে সন্তানের এত স্মৃতি, সেখানে থাকি কীভাবে বলেন! বুক ফেটে যায়! তাই বাচ্চারা চলে যাওয়ার পরপরই বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিয়েছি। ওই বাড়িতে আর থাকছি না। আপাতত শ্বশুরবাড়িতে উঠেছি।’ ইব্রাহিম জানান, বাড়ি ছাড়তে দুই মাস আগে মালিককে জানাতে হয়। বাসায় কিছু জিনিসপত্র আছে। সন্তানদের খেলনা, বইপত্র, ছবি দেখলেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারছেন না। তাঁর স্ত্রী পুরোপুরি ভেঙে পড়েছেন। তাঁকে সুস্থ করাই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি বরেন, ‘কেউ কিছু করবে না, এটা জানি। কারও সহযোগিতার দরকারও নেই। আমাদের ওপরওয়ালা আছেন। কাউন্সিলর, রাজনৈতিক নেতা, সিটি করপোরেশনের কেউ সান্ত্বনা জানাবে– এমন কামনাও করি না।’
রাউফ-রাইদাদের বাসাটি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাধীন। এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর দেওয়ান আবদুল মান্নান বলেন, ‘যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে, তার দায়দায়িত্ব আমাদেরও রয়েছে। মশার ওষুধ ছিটালেও কাজ হচ্ছে না। মধ্য পাইকপাড়ার ঘটনাটি জানার পর আশপাশে খোঁজ নিয়েছি, কোথাও লার্ভা রয়েছে কিনা।’ ডেঙ্গুতে স্বজনহারা পরিবারকে অর্থ দিয়ে সহযোগিতার ব্যবস্থা সিটি করপোরেশনের নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ঢাকা-১৪ আসনের সংসদ সদস্য আগা খান মিন্টু বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের মূল দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। মেয়র ও কাউন্সিলররা মুখ্য ভূমিকায় থাকেন। জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমরা লোকজনকে সচেতন করছি। তবে সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে।’
দুই মাস হলো ডেঙ্গুতে একমাত্র মেয়ে ইলমা জাহানকে হারিয়েছেন ব্যাংক কর্মকর্তা মো. ইকবাল কবির। রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়ত ইলমা। গত ৩ জুন তার মৃত্যু হয়। ইকবাল কবির বলেন, ‘মেয়েকে হারানোর পর আমাদের জীবন এলোমেলো। ছেলে ইশতিয়াক কবির বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শেষ করেই বাসায় ফেরে। মাকে দেখাশোনা করে। চারজনের সংসারে আমরা এখন তিনজন! জোড়া ভেঙে গেছে।’
ইকবাল কবির প্রতি সপ্তাহে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের কৌড্ডাপাড়ায় মেয়ের কবরে ছুটে যান। টেবিলে সাজানো বইয়ের ঘ্রাণ নেন মা মাকসুদা আক্তার জাহান। মেয়ের জামাকাপড়ে মুখ গুঁজে কাঁদেন। রাতে ঘুমান না। দরজার দিকে চেয়ে থাকেন। ‘মেয়েকে হারিয়ে যে কতটা অসহায় হয়ে পড়েছি, এটা কেউ অনুধাবন করতে পারবে না’– বলেন বাবা ইকবাল।
ইলমার মারা যাওয়ার পর ভিকারুননিসার এক শিক্ষক এসেছিলেন খোঁজ নিতে। এ ছাড়া আর কেউ যোগাযোগ করেননি। বাবা ইকবাল বলেন, ‘যোগাযোগ না করলেও আমার মেয়ের মৃত্যুর দায় কেউ এড়াতে পারবে না।’ জীবনে এক ধরনের লড়াইয়ে রয়েছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ইকবাল কবিরের বাসা রাজধানীর শাহজাহানপুরের গুলবাগে। স্থানীয় কাউন্সিল খ ম মামুন রশিদ শুভ্র বলেন, ‘রাস্তায় ইলমার বাবার সঙ্গে দেখা হলে কথা বলেছি। ডেঙ্গুতে যেন আর কেউ আক্রান্ত না হয়, সে জন্য শুক্রবার বাদে প্রতিদিন মশক নিধন ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। মাইকিং করা হচ্ছে।’
ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গত ৭ আগস্ট ডা. আলমিনা দেওয়ান মিশুর মৃত্যু হয়। তাঁর স্বামী চক্ষু বিশেষজ্ঞ সোয়েব আহমেদ। আক্ষেপ করে সোয়েব বলেন, ‘এক মাস হতে চলল, সরকারি কোনো সংস্থা বা জনপ্রতিনিধি আমাদের খোঁজখবর নিলেন না! কোনো রাজনৈতিক নেতাও জানতে চাইলেন না– কী অবস্থায় আমরা রয়েছি। সন্তানরা তাদের মা ছাড়া কীভাবে দিন পার করছে।’
সোয়েব-আলমিনা দম্পতির দুই মেয়ে। বড় মেয়ের বয়স চার আর ছোট মেয়ের দুই বছর। মায়ের জন্য তারা ছটফট করে। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। মাঝেমধ্যে প্রশ্ন করে, ‘বাসায় সবাই আসছে, মা কেন আসছে না!’
অকস্মাৎ স্ত্রীকে হারিয়ে অনেকটাই নির্বাক ডা. সোয়েব। রাজধানীর একটি বেসরকারি চক্ষু হাসপাতালে চাকরি করেন তিনি। সমকালকে তিনি বলেন, ‘সারাদিন মানুষের সেবায় সময় কাটে। দুই মেয়েকে ভালোভাবে সময়ও দিতে পারি না। তাই তাদের নানুর বাসায় রেখে এসেছি।’
৩৯তম বিসিএসে নিয়োগ পাওয়া মিশু রাজধানীর মাতুয়াইলে শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের স্ত্রী ও প্রসূতি রোগ বিভাগে কর্মরত ছিলেন। তাঁর বাড়ি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কাঞ্চন বাজারে। সোয়েব আহমেদ জানান, স্ত্রীর বেতন-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে গিয়েছিলেন। সেখাকার কর্মকর্তারা কিছু কাগজপত্র তৈরি করতে বলেছেন। তা ছাড়া আর কেউ তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। রূপগঞ্জে স্ত্রীর মৃত্যুর সনদপত্র নিতে গিয়েছিলেন। কয়েক দিন পর পৌর মেয়র এসে সনদটি দিয়ে গেছেন।
গত ২৫ জুলাই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব (ডব্লিউটিও উইং) এস এম নাজিয়া সুলতানা মারা যান। তিনি আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। সবকিছু ঠিক থাকলে এস এম নাজিয়া সুলতানার সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার তারিখ ছিল আগামী ১৬ সেপ্টেম্বর। নাজিয়া চেয়েছিলেন, তিনি যেন সুস্থ সন্তান জন্ম দিতে পারেন। এর আগে ২০১৬ সালে নাজিয়ার গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে। পরে অনেক চিকিৎসার পর তিনি অন্তঃসত্ত্বা হন। সেই সন্তান পৃথিবী দেখার আগেই চলে গেছেন নাজিয়া।
গতকাল বিকেলে মোবাইল ফোনে নাজিয়ার স্বামী শাহরিয়ার জামিল জানান, স্ত্রীর মৃত্যুর পর সরকারি কোনো সংস্থা বা জনপ্রতিনিধি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেননি।
ডেঙ্গুতে প্রাণ হারানো আফিয়া জাহিনের বাবা আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আমাদের দুই সন্তান। বড় মেয়েকে ডেঙ্গু কেড়ে নিল। ইচ্ছা ছিল, ওকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলব। কীভাবে বেঁচে আছি, কেউ খোঁজ নেয়নি। রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী আফিয়া মারা গেছে গত ১৪ আগস্ট।’