॥ পাঁচ ॥
জামায়াত নেতাদের একের পর এক গ্রেফতারের ফলে জামায়াত অভূতপূর্ব নেতৃত্ব সংকটে নিপতিত হয়। তাদের বিরুদ্ধে মামলার পর মামলা রুজু করা হয়। এই মামলা থেকে জামায়াতের কোনো কেন্দ্রীয় নেতা বাদ পড়েননি। জামায়াতের আমীরসহ দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সংখ্যা ছিল ১৬ জন, পক্ষান্তরে ৫৪ জন সদস্য নিয়ে গঠিত ছিল তার কর্মপরিষদ বা কার্যকরী কমিটি যার মধ্যে নির্বাহী সদস্যরাও তার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। নির্বাহী কমিটির ১৬ জন সদস্যের মধ্যে ছিলেন জামায়াতের আমীর, ৫ জন নায়েবে আমীর একজন সেক্রেটারি জেনারেল, ৭ জন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং দু’জন সদস্য। দল পরিচালনায় নির্বাহী কমিটি মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। ইসলাম বিদ্বেষী সরকার প্রথমেই এই কমিটির শক্তিশালী ফোরামের ৬ জন সদস্যকে ১৯৭১ সালে মানবতা বিরোধী অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত থাকার মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগে গ্রেফতার করে দলটিকে দুর্বল করে দেয় দলের আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী এবং সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে গ্রেফতার করার পর জনাব মকবুল আহমদ এবং জনাব এটিএম, আজহারুল ইসলামকে যথাক্রমে ভারপ্রাপ্ত আমীর এবং ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। সরকার এটা সহ্য করতে পারেননি। ২০১১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর আরো কিছু কেন্দ্রীয় নেতা যেমন মাওলানা রফিউদ্দিন আহমদ (কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য) রফিকুল ইসলাম খান (কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য ও মহানগরী আমীর), অধ্যক্ষ মোহাম্মদ ইজ্জত উল্লাহ, অধ্যাপক মোহাম্মদ তাসনীম আলম, আবুল আসাদ (সম্পাদক) ও জনাব আজহারুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়। এই অবস্থায় জামায়াত ডা. শফিকুর রহমানকে সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব প্রদান করে। সরকার এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে যে তারা ড. শফিকুর রহমান এবং ভারপ্রাপ্ত আমীর জনাব মকবুল আহমদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারীর জন্য প্রানান্ত চেষ্টায় নেমে পড়েন দলকে সচল রাখার স্বার্থে এই দুইজন নেতা আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন। তাদের বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ ছিল মিথ্যা, বানোয়াট এবং প্রতারণাপূর্ণ। ভারপ্রাপ্ত আমীর জনাব মকবুল আহমদ এবং ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানের সমস্ত অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং কোর্টের নির্দেশে কিছু সরিয়ে নেয়া হয় আর কিছু তালা বন্ধ করে সীলগালা করে রাখা হয়।
জামায়াতের শীর্ষ, মধ্যমসারী ও তৃণমূল নেতাকর্মীদের গ্রেফতার রিমা- নির্যাতন করেই জালেম সরকার সন্তুষ্ট থাকেনি তারা তাদের আত্মীয়-স্বজন, ছেলে-মেয়েদেরও অন্যায়ভাবে গ্রেফতার নির্যাতন করে, যাতে করে কেউ তাদের জামিন এবং মামলার খোঁজখবর ও তদবীরের জন্য আইনজীবী বা আদালত পর্যন্ত যেতে না পারে। জামায়াত তার ফ্রন্ট সংগঠন, পার্শ্ব সংগঠন প্রভৃতি নেতাকর্মী ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে গত ৯ বছর ধরে এই অত্যাচার অবিচার চলে আসছে। তার পুত্র কন্যা, জামাতা ও অন্যান্য আত্মীয় স্বজনরাও এ থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে তাদের কাছ থেকে এক দিকে বিপুল পরিমাণে অর্থ আদায় করা হচ্ছে অন্য দিকে চালানো হচ্ছে সীমাহীন নির্যাতন। জামিনযোগ্য মামলায়ও এমনকি তানের জামিন দেয়া হচ্ছে না, আদালত থেকে জামিন পেলেও মুক্তির পথে জেল গেটে আবার তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। মিথ্যা ও তথাকথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার করে দেড়/দু’বছর জেলে আটক রেখে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রসিকিউটার পাঠিয়ে দাগী অপরাধী ধরনের লোকদের ভয়ভীতি প্রলোভন দেখিয়ে ঢাকার সেফহোমে প্রশিক্ষণ দিয়ে সাক্ষী হিসেবে খাড়া করে জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তৈরি করে। অপরাধ সংঘটনের ৩৯/৪০ বছর পর অভিযোগ গঠনের এই ধরনের ঘটনা নজিরবিহীন।
মেধাবী চরিত্রবান এবং সক্রিয় ছাত্র নেতা যারা ভবিষ্যতে, ইসলামী আন্দোলনের ঝান্ডা হাতে তুলে নেয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে তাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তুলে নিয়ে হত্যা করেছে। অথবা নির্যাতন করে এমন অবস্থায় ফেলে যাচ্ছে যার ফলে সুস্থ জীবনে ফিরে আসা তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ছে। জামাতের প্রতি সরকারের নির্মমতা সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। জামায়াতের কেন্দ্রীয়, মহানগর ও জেলা ও উপজেলা অফিসগুলো নিয়মিত পুলিশ ও র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তল্লাসী করছে এবং নথিপত্র, অফিস সরঞ্জাম এবং মূল্যবান বইপত্র নষ্ট করে দিচ্ছে, কম্পিউটার, ফটো কপি মেশিন, স্ক্যানার, টেলিভিশন, ক্যামেরা সিসিটিভি প্রভৃতি নিয়ে গেছে এবং তার জন্য কোনো প্রকার লিস্ট বা রশিনও দিচ্ছে না। পবিত্র কুরআন হাদিস এবং ধর্মীয় গ্রন্থাবলির অবমাননা করছে। জামায়াতের কেন্দ্রীয় মহানগরী অফিসসহ অধিকাংশ জেলা অফিস পুলিশ তালা দিয়ে রেখেছে।
জামায়াতের ড্রাইভার এবং অফিস সহকারীদের অধিকাংশকেই বিনা অপরাধে গ্রেফতার করে জেলে দিয়েছে বিভিন্ন জেলার বিশেষ বাহিনী দিয়ে জামায়াত নেতাকর্মীদের বাড়িঘর তল্লাশী করে তাদের আসবাবপত্র, তৈজসপত্র ও ধান চাল লুট করেছে এবং তীব্র শীতের মধ্যে তাদের লেপ তোষক ও বালিশ ইত্যাদি হয় গুড়িয়ে দিয়েছে না হয় পুকুরের পানিতে ফেল দিয়েছে। বুল ডোজার দিয়ে তাদের বাড়ি ঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দিয়েছে। পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী সাতক্ষীরাসহ কয়েকটি জেলায় জামায়াত ও ইসলামপন্থীদের দমনে যৌথ বাহিনীর সাথে প্রতিবেশী একটি দেশের সেনাবাহিনীর দুর্র্ধর্ষ ব্ল্যাক ক্যাট বাহিনীকেও কাজে লাগানো হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। সেখানে তারা নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছে, বাড়িঘর নষ্ট করেছে এবং তাদের সহায় সম্পত্তি ধ্বংস করেছে ছাত্র-ছাত্রী মহিলাসহ ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীদের উপর আওয়ামী লীগ সরকারের নির্যাতনের সংক্ষিপ্ত একটি বিবরণী নীচে তুলে ধরা হলো।
ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীদের উপর আওয়ামী নির্যাতনের বিবরণ (জানু. ২০০৯ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০১৭ পর্যন্ত)
১। অন্যায়ভাবে এবং বিচারের নামে প্রহসন করে ফাঁসিতে হত্যা-৫ জন।
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, আমীর, জামায়াতে ইসলামী
আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সে. জেনারেল, জামায়াতে ইসলামী
আবদুল কাদের মোল্লা, সহ সেক্রে. জেনারেল, জামায়াতে ইসলামী
মুহাম্মদ কামরুজ্জামান সহ সেক্রে. জেনারেল, জামায়াতে ইসলামী
মীর কাসেম আলী, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য, জামায়াতে ইসলামী।
২। গুলি করে হত্যা জামায়াত ১২১ জন, শিবির ৩৭৭ জন ৪৯৮ জন
৩। ক্রস ফায়ারে হত্যা: গণতান্ত্রিক শক্তিসহ ৪৯৮ জন ১২৮৩ জন
৪। পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার
(ক) পুরুষ-৯০,২০০ জন
(খ) মহিলা -৯৫৩
৫। শিক্ষার্থী গ্রেফতার ছাত্র ৬০৭২০ জন, ছাত্রী ৯৬২ জন
৬। রুজুকৃত মোট মামলা ২০৩,৯৬০টি
৭। আহতের সংখ্যা ৭৮৩১৩ জন
৮। পঙ্গুর সংখ্যা ৫২০০
৯। চাকরিচ্যুত ইমাম ও মাদরাসা শিক্ষকের সংখ্যা ৭,৮০০
১০। চাকরিচ্যুত স্কুল শিক্ষকের সংখ্যা ৪,৯০০
১১। পুলিশ রিমান্ডে নির্যাতিতদের সংখ্যা ৯৫,৯১০
১২। গুম ও অপহরণকৃতদের সংখ্যা ৫,৪১১
১৩। লুটপাট ও ভাঙচুরকৃত বাড়ি-ঘরের সংখ্যা ৫০০০
(৫ লক্ষ মার্কিন ডলার সমমূল্যের)
১৪। ধ্বংসকৃত ব্যবসায়িক স্থাপনা ২৫,০০০
১৫। বাস্তচ্যুত ব্যক্তির সংখ্যা (যারা বাড়ি-ঘরে থাকতে পারে না) ৩,০০০
১৬। বন্ধকৃত দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা (আমার দেশ) ১
১৭। দৈনিক পত্রিকা জবর দখলকৃত (বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের প্রকাশনা সংস্থা বাংলাদেশ পাবলিকেশনস এর জবর দখলকৃত ভবন ১. ৯ তলা একটি ভবন, ২. ৪ তলা দু’টি ভবন)।
১৮। বন্ধকৃত টেলিভিশন চ্যানেল ২টি (দিগন্ত টেলিভিশন ও ইসলামিক টেলিভিশন। এ দু’টি চ্যানেলের রেকর্ডিং ও ট্রান্সমিশন যন্ত্রপাতি হয় ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে নয় বলবপূর্বক নিয়ে যাওয়া হয়েছে)।
এই পরিসংখ্যানে ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে যৌথ বাহিনীর হামলায় নিহত ১০,০০০ আলেম ও মাদরাসা ছাত্রদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
পত্র পত্রিকার প্রধান আয় হচ্ছে বিজ্ঞাপন বাবদ প্রাপ্ত রাজস্ব, ইসলামপন্থী এবং গণতন্ত্রমনা সকল পত্রিকাই এখন সরকারি বিজ্ঞাপন থেকে বঞ্চিত। সরকার তাদের বিজ্ঞাপন দেন না। আবার বেসরকারি বিজ্ঞাপন দাতাদের উপর নানা চাপ সৃষ্টি করেন যাতে তারা ঐ পত্রিকাগুলোকে বিজ্ঞাপন না দেন। এতে করে সংশ্লিষ্ট পত্রিকাগুলো দৈনন্দিন বায় নির্বাহে মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। (সমাপ্ত)