গত ক’বছর ধরে দফায় দফায় দ্রব্য ও সেবার মূল্যবৃদ্ধিতে দিশেহারা সাধারণ ভোক্তা। তার ওপর চলতি বছরে দেশের প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য অনেকগুণ বৃদ্ধিতে ভোক্তাদের দুর্ভোগ আরো বেড়ে গেছে, সীমিত আয়ের মানুষ তাদের আবশ্যকীয় খরচ কমাতে বাধ্য হচ্ছেন।
ডিম, গরুর গোশত, মুরগি, মাছ, পেঁয়াজ ও রসুনের বাজার অনিয়ন্ত্রিত। সবজির দাম গত ক’মাসে ৩০-৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে এখন প্রতিটি সবজির দাম কেজিপ্রতি প্রায় ১০০ থেকে ১২০ টাকায় পৌঁছেছে। আটা এবং আটা-ময়দার তৈরি রুটি ও পরোটা; মসলা যেমন- জিরা, পেঁয়াজ, রসুন, মসুরডাল, আদা; সবজি যেমন- আলু, করলা, বরবটি, শিম, শসা; ফল যেমন আপেল, মাল্টা, নারকেল, ক্ষেত্র বিশেষে ২০-৩৫ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে।
পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা প্রতিবেশী ভারতের সাম্প্রতিক রফতানি-শুল্ক আরোপে এ বৃদ্ধির কারণ হিসেবে উল্লেখ করে দাম প্রতি কেজি ৫০-৭০ টাকা থেকে ৭০-৯০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়েছে। অস্থির পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের তেমন কোনো পদক্ষেপ কমই দেখা গেছে। জিরার দাম সর্বকালের সর্বোচ্চ ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা প্রতি কেজিতে পৌঁছেছে। অন্যদিকে, প্যাকেট জিরা পাউডার কোম্পানিগুলো ৫০ গ্রাম প্যাকে বিক্রি করছে ১০৫ টাকায়, যার মানে সর্বোচ্চ ২ হাজার ১০০ টাকা প্রতি কেজি, যা বিশ্বের সর্বোচ্চ বলছেন বাংলাদেশ কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন। অথচ কোনো পক্ষ থেকে কোনো রকম প্রশ্ন উঠছে না; ভোক্তারা নীরবে ভুগছেন আর সরকার চুপ।
ডিমের দাম ২২ শতাংশ বেড়ে ১৮০ টাকায় পৌঁছে চলতি মাসের মাঝামাঝি; এখন অবশ্য কিছুটা কমে ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকায় পৌঁছেছে যা আগের মাসের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি। ব্রয়লার মুরগি এবং চাষের মাছের দাম এক কেজিতে ২০ থেকে ৫০ টাকা বেড়েছে, যা দরিদ্রদের দুর্ভোগ বাড়িয়েছে। দরিদ্ররা মূলত তাদের প্রোটিন গ্রহণে ডিম ছাড়াও চাষের মাছের ওপর নির্ভর করেন।
ফলের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাওয়ায় এক বা একাধিক ডেঙ্গু রোগীর সীমিত আয়ের পরিবারগুলোর ওপর সরাসরি প্রভাব পড়েছে। একটি ডাব ১৬০ থেকে ১৮০ টাকা এবং মাল্টা ২৭০ থেকে ২৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে। বাজারে অস্থিরতার কারণে সরকার ডিম আমদানির অনুমতি দেয়ার ঘোষণা দিলেও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। গত বছরে ডিরেক্টরেট অব ন্যাশনাল কনজ্যুমার রাইট প্রোটেকশন (ডিএনসিআরপি) ডিম-বাজারের সব অপরাধীকে শনাক্ত করার পরও শাস্তি দেয়া হয়নি, যা এ বছর তাদের এটি করতে উৎসাহিত করে।
প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য বেড়ে যাওয়ার প্রবণতার মধ্যে লাখ লাখ মানুষ ক্ষুদ্র আয়ের সাথে সমন্বয় করতে প্রোটিন, শাকসবজি এবং ফলমূলের ব্যবহার কমিয়ে দিচ্ছেন। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ১৩ আগস্ট খামারের ডিমের যৌক্তিক সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১২ টাকা নির্ধারণ করেছে। নেতৃস্থানীয় সংস্থাগুলো যদি এটি বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয় তবে সরকারকে দেশীয় ডিমের চেয়ে সস্তা হলে আমদানি করতে হবে হয়তো। সরকারকে ভারত ছাড়াও অন্যান্য দেশ থেকেও পেঁয়াজ আমদানি করতে বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করতে হবে। কারণ প্রতিবেশী দেশের যেকোনো সময় রফতানি নিষেধাজ্ঞা আরোপের আশঙ্কা রয়েছে।
যদিও পশু-খাদ্য মিলগুলো ফিডের দাম প্রতি কেজি দুই থেকে তিন টাকা কমিয়েছে, তবে ভুট্টার খরচ হিসাবে এটি যুক্তিসঙ্গত নয়। কারণ এ সময়ের মধ্যে সয়া খাবার প্রতি কেজিতে হ্রাস পেয়েছে ১০-১৫ টাকা। মাছ, খামারের ডিম, মুরগি এবং লাল গোশতের খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো যেতে পারে; যদি খাদ্যের দাম কমিয়ে আনা যায়। সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সমন্বয়ে বাজার নজরদারি কঠোর হওয়া উচিত। তাহলে পণ্যের দাম কমিয়ে আনা সম্ভব।
খুচরা বিক্রেতা এবং গ্রাহকদের যেভাবে প্রভাবিত করছে
খুচরা বিক্রি কমে যাচ্ছে। যেহেতু অনেক ভোক্তা নিত্যপ্রয়োজনীয় মৌলিক পণ্য সংগ্রহের সামর্থ্যে সংগ্রাম করেন; সেহেতু তাদের খরচের অভ্যাস এবং কেনাকাটার স্থানের পরিবর্তন হচ্ছে। কিছু খুচরা বিক্রেতা লাভ করতে সংগ্রাম করছেন, কারণ পণ্য, শক্তি, পরিবহন এবং কর্মীদের খরচ বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে বিক্রয় হ্রাস পাচ্ছে। পণ্য ও পরিষেবার দাম দ্রুত বৃদ্ধিতে জীবনযাত্রার ব্যয়-সঙ্কট হচ্ছে। ফলে শ্রমিকদের মজুরি ঠিক রাখতে সংগ্রাম করছেন। মূল্যবৃদ্ধির হার বর্তমান আয়বৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে, অর্থাৎ মানুষের মজুরি প্রকৃত অর্থে মূল্যের নিচে নেমে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি কয়েক বছর ধরে বেড়ে চলেছে। এখন স্মরণকালের সর্বোচ্চ ছুঁয়েছে। গত কয়েক মাস যাবত মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশে ঠেকেছে। চাহিদা ও সরবরাহে অনিয়ম ও ব্যাঘাত এবং জ্বালানির দাম বাড়ানোয় এটি হয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারীকালে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় চাহিদার ধরনগুলো অসঙ্গতিপূর্ণ হয়েছে, যা উৎপাদন ও বিতরণকে প্রভাবিত করছে। বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই চেইনের প্রাপ্যতা ও খরচ ব্যাহত করছে। মুদ্রাস্ফীতি অন্যতম একটি কারণ দুই বছর ধরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান ৩০ শতাংশেরও বেশি কমে যাওয়া, যার ফলে বিনিময় হারের ওপরও এটি প্রভাব ফেলেছে। তবে এটি মূলত আন্তর্জাতিকভাবে ডলারের মূল্য যা বর্তমান মুদ্রাস্ফীতিকে চালিত করছে। আন্তর্জাতিকভাবে পাইকারি গ্যাস এবং বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি পেয়েছিল যা অভ্যন্তরীণ এবং বাণিজ্যিক জ্বালানির ওপর প্রভাব ফেলেছে। ২০২২ সালের মে থেকে সব ধরনের জ্বালানির দাম অনেক বেড়েছে। এ সমস্যাগুলো ইউক্রেনে রাশিয়া আক্রমণের ফলে আরো বেড়েছে।
সব মিলিয়ে মানুষের জীবনযাত্রার খরচ বহুগুণ বেড়েছে। জনসংখ্যার বেশির ভাগের গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে, ফলে আয় স্থবির হয়ে পড়েছে। অনেকের ব্যয়ের ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। মুদ্রাস্ফীতির উদ্বেগের ফলে বিশ্বের বহু দেশ যেখানে সুদের হার বাড়িয়েছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে; সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার অপরিবর্তিত রেখেছিল, ইদানীং বাধ্য হয়ে সুদের হারে পরিবর্তন এনেছে।
নিম্ন আয়ের ভোক্তারা যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন
সবাই মুদ্রাস্ফীতি দ্বারা আহত, কিন্তু তার প্রভাব সমাজজুড়ে সমানভাবে অনুভূত হয় না। নিম্ন আয়ের ভোক্তারা প্রতিকূলতায় বেশি প্রভাবিত হন। তারা তাদের আয়ের একটি বৃহত্তর অংশ খাদ্যপণ্য এবং জ্বালানিতে ব্যয় করেন। ক্রমবর্ধমান জ্বালানি শক্তি, আবাসন এবং পরিবহন খরচের প্রভাবগুলো খাদ্য এবং অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের দামের মতো নিম্ন আয়ের ভোক্তাদের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। মুদ্রাস্ফীতিতে অনেক নিম্ন-আয়ের পরিবার খরচ কমিয়েছে। অথবা তারা যে পণ্যগুলো কিনতেন তা পরিবর্তন করেছে, সেই সাথে খাদ্য নিয়মিত ব্যয়ে ঋণের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে। ভোক্তাদের ওপর এই ব্যাপক প্রভাবগুলো তাদের আস্থাসূচকের মাধ্যমেও দেখা যায়। এটি দেখায় যে ভোক্তারা তাদের নিজস্ব আর্থিক সমস্যাগুলো অনুভব করছেন। তবে সামনের সাধারণ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং এটি কিভাবে তাদের প্রভাবিত করতে পারে সে সম্পর্কেও উদ্বিগ্ন।
খুচরা ক্রেতা যেভাবে প্রভাবিত হয়
খুচরা খাতে মূল্যস্ফীতির প্রবণতার প্রভাব দেখতে শুরু করেছে। চাল, ডাল, মসলা, সবজি, মাছ, গোশত, ডিমের মতো খাদ্যপণ্যের দাম অনেক বেড়েছে, ভোক্তারা অবশ্য পুরো পণ্যের দাম বেড়েছে বলে জানিয়েছেন। তারা খাদ্য কেনাকাটা হ্রাস, সস্তা ব্র্যান্ডের পণ্যে চলে যাওয়া, মাছ-গোশত কেনা বন্ধ করা, এমনকি তুলনামূলকভাবে অনেক কম প্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয় বন্ধ করার মতো ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে।
অখাদ্য পণ্যের বাজারেও মূল্যস্ফীতির প্রভাব পড়ছে, যেমন গৃহস্থালি এবং পোশাকের মতো আইটেমে ব্যয় স্থগিত করছেন। ফলে খুচরা বিক্রেতাদের বিক্রয়-ব্যবসায় কমে গেছে। সরকারের খুচরা বিক্রয় পরিসংখ্যানে ব্যয়ের এ মন্থরতা দেখা যাচ্ছে। প্রধানত জ্বালানি এবং অখাদ্য পণ্যের দোকানের ব্যয় হ্রাসে খুচরা বিক্রয়ের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। খুচরা বিক্রয়ের ঘাটতি হওয়ায় অনলাইন বিক্রয় ক্রমাগত হ্রাস পেয়েছে। ভোক্তারা কম খাদ্য এবং গৃহস্থালির জিনিসপত্র কিনছেন। তারা যে দোকানগুলো ব্যবহার করতেন, সেগুলোর অবস্থান এবং ধরনও পরিবর্তন হচ্ছে।
জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে উদ্বিগ্ন শ্রমিকরা তাদের মজুরি বৃদ্ধির দাবি তুলছেন। খুচরা বিক্রেতাদের তাদের কর্মীদের বেতন দিতে অসুবিধা হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান পরিচালন ব্যয়ে খুচরা বিক্রেতারাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ব্যবসার জ্বালানির খরচ সীমাহীনভাবে বাড়ছে। একইভাবে, দোকানে বা ভোক্তাদের কাছে পণ্য ক্রয় এবং পরিবহন বা বিতরণ আরো ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে। খুচরা বিক্রেতারা অন্যান্য সরকারি এবং প্রশাসনিক খরচ, দোকান ভাড়া এবং বিভিন্ন শুল্ক পরিশোধ করতে পারছেন না, এমনকি পাশাপাশি বিক্রি কমে যাচ্ছে।
সরকার অবশ্য আশা করছে, জীবনযাত্রার বর্তমান খরচ, বিশেষ করে মুদ্রাস্ফীতি অস্থায়ী যা ২০২৪ সালে চাপ কমবে। মুদ্রাস্ফীতি তার লক্ষ্যে ফিরে আসবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা থেকে ইউক্রেনের যুদ্ধ পর্যন্ত (যা খাদ্য, শক্তি এবং সার সরবরাহকে প্রভাবিত করছে) এর লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না; বরং সহজ করে বলতে গেলে বিভিন্ন পণ্য ও পণ্যের দাম চড়া থাকার পূর্বাভাস রয়েছে। বিশেষ করে জ্বালানির দাম কমার লক্ষণ নেই। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন অব্যাহত রয়েছে। তার মানে ভোক্তাদের ওপর দামের চাপ অব্যাহত থাকবে। সীমিত আয়ের ভোক্তাদের জন্য বাজারের পরিস্থিতি এবং দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক যা তাদের কেনাকাটার আচরণে পরিবর্তন আনছে এবং খুচরা বিক্রেতাদের কর্মক্ষমতা প্রভাবিত করছে। বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে, জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান অংশ প্রভাবিত হবে, যার ফলে খুচরা খাতে আরো ব্যাপক প্রভাব পড়বে।
বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কটে বৈশ্বিক প্রভাব যেমন রয়েছে; তেমনি অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থাও অনেকাংশে দায়ী। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সঙ্কটের প্রভাব অনেক দেশে ইদানীং কেটে যেতে শুরু করছে, সুতরাং বাংলাদেশেও বৈশ্বিক সঙ্কটের প্রভাব ধীরে ধীরে কেটে যাবে। তবে, দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক অব্যবস্থা যেমন- গত ক’বছরের মাত্রাতিরিক্ত দেশী-বিদেশী ঋণ, অর্থনীতির প্রাণ ব্যাংক ও শেয়ারবাজারের অব্যবস্থা, বৈদেশিক মুদ্রা পাচার, ব্যাপক দুর্নীতি ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। তবে সাধারণ ভোক্তাদের রক্ষা করতে হলে বাজারের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
mizan12bd@yahoo.com