বাংলাদেশে উপনির্বাচনের অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ। পাকিস্তান আমলের শুরুতে এক উপনির্বাচনে মুসলিম লীগের জাঁদরেল প্রার্থীকে তরুণ শামসুল হক হারিয়ে দিলে মুসলিম লীগ সরকার আর ওমুখী হয়নি। ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত ৩৪টি আসন খালি হলেও আর কোনো উপনির্বাচন করতে তারা সাহস পায়নি। এর ফল হলো চুয়ান্নর নির্বাচনে মুসলিম লীগ বাংলা থেকে চিরতরে উচ্ছেদ হয়ে গেল।
বাংলাদেশ আমলেও উপনির্বাচন নিয়ে কাণ্ড কম হয়নি। আজ যে নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির যুযুধান অবস্থা, তার সূচনা ১৯৯৪ সালের মাগুরা উপনির্বাচন দিয়ে। এ নির্বাচনে কারচুপি ও জবরদখল না হলে বিরোধী প্রার্থী জিতে যেতেন। তাতে বিএনপি হয়তো একটি আসন হারাত। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে দলটি বিপর্যস্ত হতো না। বিরোধী দলের তত্ত্বাবধায়ক দাবিও পালে বাতাস পেত না। এরপর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আমলে উপনির্বাচনে ধরেই নেওয়া হতো সরকারি দলের প্রার্থী জিতে যাবেন, বিরোধী দলের প্রার্থী দিয়ে কোনো লাভ নেই। একাধিকবার ক্ষমতার পালাবদল হলেও সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি ক্ষমতাসীন দল ও সরকার বহন করে চলেছে।
এখন পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে উপনির্বাচনে প্রার্থী ও ভোটার—কারও দেখা পাওয়া দুর্লভ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সোমবার ঢাকা-১৭ আসনে যে উপনির্বাচন হয়ে গেল, তাতে ভোটকেন্দ্রের খবরের চেয়ে বাইরের খবরই প্রাধান্য পেয়েছে। আর খবরটি হলো নির্বাচনে অন্যতম প্রার্থী আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলমকে মেরে সড়কে শুইয়ে দিয়েছেন নৌকার ব্যাজধারীরা। নৌকার ব্যাজ নিশ্চয়ই বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরা বহন করেননি। তাঁদের ক্রোধের কারণ, হিরো আলম নামের একজন টিকটকার কেন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হবেন? তাঁর মতো লোক জাতীয় সংসদে গেলে নৌকা ব্যাজধারীদের মান-ইজ্জত থাকে না! এ কারণে তাঁরা হিরো আলমকে ধোলাই দিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
হিরো আলম এর আগেও উপনির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন। সেই সময় নৌকা সমর্থকদের হাত থেকে রক্ষা পেলেও এবারে পারেননি। দুই স্থানেই তিনি নিকটতম প্রার্থী। এত সব নিবন্ধিত দল, যারা তাঁর ধারেকাছেও আসেনি। ঢাকা-১৭ আসনে নিবন্ধিত একটি দল পেয়েছে ৭৫ ভোট। হিরো আলমের ঘটনাটি যে দেশের ভেতরেই আলোচনা হয়েছে, তা-ই নয়; দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও এর প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
২০২০ সালে ঢাকা-১০ উপনির্বাচনে ৫ দশমিক ২৮ শতাংশ ভোট পড়েছিল। ঢাকা-১৭ আসনে পড়েছে ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ। এই ধারা চলতে থাকলে ইসিকে প্রার্থী ও ভোটার—কারও নিরাপত্তা দিতে হবে না। ভোটার ও প্রার্থীরা ঘরে থেকে নিজেদের নিরাপত্তা নিজেরাই নিশ্চিত করে নেবেন। আর দিন শেষে নির্বাচন কমিশন ফলাফল ঘোষণা করে নিজেদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করবে।
ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী তাঁর ওপর হামলার বিষয়টি এবার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রেস ব্রিফিংয়ে উঠেছে। সোমবার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রেস ব্রিফিংয়ে হিরো আলমের ওপর হামলার বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। প্রশ্নকারী বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া তাঁর বাংলাদেশ সফর শেষে ফেরার পরই দেশটির সরকারবিরোধীদের ওপর হামলার পুরোনো ধারায় ফিরেছে।
সোমবার বাংলাদেশে একটি উপনির্বাচন হয়েছে। প্রধান বিরোধী দল এই উপনির্বাচন বর্জন করেছে। এই উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র এক প্রার্থী (হিরো আলম) হামলার শিকার হয়েছেন। তিনি এখন হাসপাতালে। উপনির্বাচনে আনুষ্ঠানিক হিসেবে ১১ দশমিক ৫১ শতাংশ ভোট পড়েছে আর অনেক পর্যবেক্ষকের মতে তা আরও কম। এ অবস্থায় কীভাবে বিশ্বাস করবেন যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করবেন? কারণ, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। এমনকি এই উপনির্বাচনও অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। এই উপনির্বাচনেও প্রার্থীরা হামলার শিকার হয়েছেন। এ ব্যাপারে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মন্তব্য জানতে চাওয়া হয়।
প্রশ্নের জবাবে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বলেন, ‘আমি বলব, গণতান্ত্রিক নির্বাচনে এ ধরনের রাজনৈতিক সহিংসতার কোনো স্থান নেই। আমরা বাংলাদেশ সরকারকে সহিংসতার যেকোনো ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে, স্বচ্ছভাবে ও নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করতে উৎসাহিত করি। যারা এ হামলার সঙ্গে জড়িত, তাদের বিচারের আওতায় আনতে বলি।’
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বলেন, ‘আমি যেটা বলব, যেমনটা আগেও আমরা বলেছি, বাংলাদেশ সরকার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করবে বলে আমরা আশা করব। আমরা বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে যাব।’ হিরো আলমের ওপর হামলায় জাতিসংঘও উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচনী রাজনীতিকে এই অবস্থায় নিয়ে এসেছে।
মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া কয়েক দিন আগে ঢাকা সফর করে গেছেন। তিনি ও তাঁর সফরসঙ্গীরা প্রধানমন্ত্রীসহ একাধিক মন্ত্রী-উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করলেও বিএএনপির প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেননি বলে আওয়ামী লীগের নেতারা বেশ আহ্লাদিত। কিন্তু তাঁরা যে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন, জনগণকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দিতে বলেছেন, সেটা তো সরকারের নীতিনির্ধারকদেরই বলবেন; বিএনপি বা অন্য কোনো দলকে নয়।
উজরা জেয়া যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাওয়ায় ঢাকা-১৭-এর উপনির্বাচনটি দেখে স্বচক্ষে দেখে যেতে পারলেন না। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রাক্-পর্যবেক্ষক দল এখনো চাকায় আছে। তারা নিশ্চয়ই টিভি ও পত্রিকার মাধ্যমে নির্বাচনের পুরো খবরই দেখেছেন, পড়েছেন। এক দিন আগেই ইইউর প্রতিনিধিদল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে তাঁদের মনোভাব জানতে চেষ্টা করেছিলেন। আওয়ামী লীগ নেতারা জোর দিয়ে বলেছেন, সংবিধানের আওতায় তাঁরা সুষ্ঠু নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। কোনো ব্যত্যয় হবে না।
এক দিন পরই দেশবাসী সেই সুষ্ঠু নির্বাচনের যে চিত্র দেখল, সেটি কেবল হতাশাজনক নয়, দুঃখজনকও। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব প্রার্থী ও ভোটারদের সুরক্ষা দেওয়া। কিন্তু তারা সেটি দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলে আসছেন, নির্বাচন করার দায়িত্ব ইসির। নিরাপত্তার জন্য কী কী প্রয়োজন, সেটাও তারা ঠিক করেছে। ফলে, প্রার্থী লাঞ্ছিত ও প্রহৃত হওয়ার দায়িত্বও ইসির। এখানে আওয়ামী লীগ বা সরকারের কিছু করণীয় নেই।
কিন্তু তারা কি দেখেছে, ঢাকা-১৭ আসনের ৮৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ ভোটার তাঁদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিজেরাই নিয়েছেন ভোট কেন্দ্রে না গিয়ে। মাত্র ১১ দশমিক ৫১ শতাংশ ভোটার কেন্দ্রে গিয়েছেন। এই স্বল্পসংখ্যক ভোটার ও প্রার্থীর নিরাপত্তাও ইসি দিতে পারেননি। নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা পুলিশের সামনেই নৌকার ব্যাজধারীরা প্রার্থী হিরো আলমকে মারধর করে রাস্তায় শুইয়ে দিয়ে প্রার্থী হওয়ার ‘শাস্তি’ দিয়েছেন।
ঢাকা-১৭ আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ২৫ হাজার ২০৫ জন্য। আওয়ামী লীগের প্রার্থী পেয়েছেন ২৮ হাজার ৮১৬। হিরো আলম পেয়েছেন ৫ হাজার ৬০৯। আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ এনে ভোট চলাকালেই বর্জনের ডাক দিয়েছেন। তাঁকে বুদ্ধিমানই বলতে হবে। তিনি আগেভাগে সরে গিয়ে মার খাওয়া থেকে রেহাই পেয়েছেন। এর আগে বরিশাল সিটি নির্বাচনেও ইসলামী আন্দোলনের মেয়র প্রার্থী নৌকার সমর্থকদের হাতে মার খেয়েছিলেন। আগে নির্বাচনে দুই দলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে মারামারি হতো। এখন সরাসরি প্রার্থীরা আক্রান্ত হচ্ছেন। এটা আমাদের সুষ্ঠু নির্বাচনব্যবস্থার উন্নতিই বটে!
২০২০ সালে ঢাকা-১০ উপনির্বাচনে ৫ দশমিক ২৮ শতাংশ ভোট পড়েছিল। ঢাকা-১৭ আসনে পড়েছে ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ। এই ধারা চলতে থাকলে ইসিকে প্রার্থী ও ভোটার—কারও নিরাপত্তা দিতে হবে না। ভোটার ও প্রার্থীরা ঘরে থেকে নিজেদের নিরাপত্তা নিজেরাই নিশ্চিত করে নেবেন। আর দিন শেষে নির্বাচন কমিশন ফলাফল ঘোষণা করে নিজেদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করবে।
• সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com