ডেঙ্গুর ভয়াবহতা এখন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। একদিনে ১৯ জনের রেকর্ড মৃত্যু সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। মৃতদের মধ্যে ১৭ জনই ঢাকার বাসিন্দা। এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিনই আগের দিনের সব অঙ্ককে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ১৯ জনের মৃত্যু ছাড়াও ১ হাজার ৭৯২ জন আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির খবর দিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। একদিনে এই রেকর্ড মৃত্যু ও আক্রান্তের এই খবরে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন সংশ্লিষ্ট সবাই। একদিনে মৃত্যুর সংখ্যাও গত ৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় ১৯ জনের মৃত্যুসহ এ বছর মশাবাহিত এ রোগে মৃতের সংখ্যা পৌঁছাল ১৪৬ জনে। যাদের মধ্যে ৯৯ জনের মৃত্যু হয়েছে চলতি জুলাই মাসের ১৮ দিনেই। সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, এ বছর হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা পৌঁছেছে ২৫ হাজার ৭৯২ জনে। শুধু জুলাই মাসের ১৮ দিনেই ভর্তি হয়েছেন ১৭ হাজার ৮১৪ জন।
ডেঙ্গুর এই ভয়াবহতা প্রসঙ্গে ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, যেভাবে আক্রান্ত ও মৃত্যু লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে তাতেই মনে হচ্ছে সত্যিই আমরা নিশ্চিত জনস্বাস্থ্য বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। আক্রান্ত যত বাড়বে মৃত্যু তত বেশি হবে। এভাবে চলতে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। এখন আমাদের প্রধান শত্রু এডিস মশা। এই মশাকে যতক্ষণ নিয়ন্ত্রণ করা না যাবে ততক্ষণ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এখনই সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে কার্যকরভাবে সেটি বাস্তবায়ন করতে হবে।
তিনি বলেন, এ কাজে সরকারের সব মন্ত্রণালয় ও দপ্তরকে বাধ্যতামূলকভাবে কাজে লাগাতে হবে। পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও সরকারের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। ডেঙ্গু নির্মূলের নামে সিটি করপোরেশন যে অভিযান করে জরিমানা করছে, তাতে কোনো ফল আসছে বলে মনে হচ্ছে না। এতে জনগণ তাদের সহায়তা করছে না। দেশের সব সিটি করপোরেশনের উচিত হবে এডিস মশার প্রজননস্থল চিহ্নিত করে জনগণকে নিয়ে মশার আবাসস্থল ধ্বংস করা। জনপ্রতিনিধিদের এ কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে। না হলে কোনোভাবেই ডেঙ্গু নির্মূল করা সম্ভব নয়।
বুধবারের রেকর্ড মৃত্যুর দুঃসংবাদের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. বেনজীর আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, জনস্বাস্থ্যের জন্য ডেঙ্গু এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা। এটিকে প্রথমে স্বীকার করে নিতে হবে। সমাধানের জন্য ব্যাপকভাবে কাজ করতে হবে। যেভাবে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম চলছে তাতে তেমন ফলাফল আসবে না। এখন সাধ্যের বাইরে গিয়ে কাজ করতে হবে। যেমন দেশে যত সংখ্যক কীটতত্ত্ববিদ আছে তাদের সারা দেশেই কাজে লাগাতে হবে। কীটতত্ত্ববিদদের নেতৃত্বে বিভাগ, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, গ্রাম সবখানে এডিস মশ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এর সঙ্গে হাসপাতালগুলোর চিকিৎসার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে আরও বেশি অর্থ বরাদ্দ দিয়ে জনবল নিয়োগ ও লজিস্টিক সাপোর্ট বাড়াতে হবে। চিকিৎসক, নার্সদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। টেস্ট সুবিধা বাড়াতে হবে। না হলে আমাদের অনেক বড় মূল্য দিতে হবে।
এদিকে জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, আলোক দূষণ এবং মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত বিভিন্ন পদ্ধতির নানামুখী ব্যবহারের ফলে এডিস মশা রূপ বদল করতে শুরু করেছে। এমনকি প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকার সক্ষমতাও অর্জন করছে। এতে করে ক্ষুদ্র অথচ ভয়ংকর এই প্রাণীটি দীর্ঘ প্রজননকাল পেয়ে সহজেই বংশ বিস্তার করছে। মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে অনেকগুণ বেশি।
প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতিবছরই ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। এবার বেড়েছে ভয়াবহভাবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত বর্ষাকালে এডিসের প্রাদুর্ভাব বাড়ে। কিন্তু আচরণগত পরিবর্তনের ফলে এটি আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে। রূপ বা চরিত্র বদলে ফেলায় চলতি বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। এডিস মশার চরিত্র বদলকেই ডেঙ্গু রোগী বৃদ্ধির বড় কারণ হিসাবে চিহ্নিত করছেন তারা।
আগের মৌসুমগুলোতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এডিস মশার বিষয়ে সচেতনতামূলক যে প্রচারণা চালানো হতো, তাতে দিনের বেলায় এই মশার কামড়ে আক্রান্তের বিষয়ে সজাগ থাকার কথা বলা হতো। কিন্তু এখন রাতেও এই মশার কামড়ে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। আগে শহরকেন্দ্রিক ছিল এই মশা। এখন শহর কিংবা উপশহর ছাপিয়ে গ্রামেও পৌঁছে গেছে। এডিস মশার এই বিবর্তনে শঙ্কিত সবাই। দিনরাত এখন একাকার। ডেঙ্গুর আক্রমণভাগে আছে শিশুরাও। এ ছাড়া সব বয়সী নারী এবং পুরুষ ভয়ানক ডেঙ্গুর কবলে পড়েছেন। চলতি মাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণ করলেই এর ভয়াবহতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
এদিকে এডিস মশার ভয়ানক বিবর্তন নিয়ে আশঙ্কা ব্যক্ত করে সরকারের রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, অন্য যে কোনো ভাইরাস যদি চরিত্র বদল করতে পারে, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হয়ে উঠতে পারে; সেখানে এডিস মশা আরও উঁচুস্তরের। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এডিস মশার এডাপটেশন ও অভিযোজন ক্ষমতা বেড়েছে। ইনসেক্টিসাইড অর্থাৎ কীটপতঙ্গের বিরুদ্ধে এটির রেজিস্ট্যান্স ডেভেলপ করছে। এভাবে আচরণ বদল করছে এডিস মশা। এতে ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ বাড়ছে। এজন্য মশা নিধনের সমন্বিত পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আবু জামিল ফয়সাল যুগান্তরকে বলেন, এডিস মশা বেশি থাকে ট্রপিক্যাল কান্ট্রিতে। ট্রপিক্যাল বা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশও পড়ে। যে কারণে এখানে বেশিরভাগ সময় গরমকাল থাকছে। সঙ্গে অনিয়ন্ত্রিত বৃষ্টিপাত ও নগরায়ণে সব ধরনের মশার বসবাসের উপযোগী পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। এডিস মশার বংশবিস্তারে বেশি সহায়ক হচ্ছে। এখন শীতকালেও ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হচ্ছে। বলা হতো এডিস ইজিপ্ট মশা, বাড়ি-ঘরের আঙিনায় বেশি থাকে, যেটি ডেঙ্গু ছড়ায়। ২০১৯ সালের পর থেকে অন্য ধরনের এডিস মশাও ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে। এডিসের আরেকটি প্রজাতি ঝোপঝাড়ে, গাছের বড় পাতায় জমা পানিতে থাকে। ফলে আবাসিক ধরনের মশা ছাড়াও বন্য ধরনের মশাও এখন ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে। বিবর্তনের মাধ্যমে মশা সুপার পতঙ্গে পরিণত হচ্ছে। তাই মশার আচরণ এবং মশা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিস্তর গবেষণা হওয়া দরকার। এডিস মশা যেখানে বংশবিস্তার করে, সেগুলো ধ্বংস করতে হবে। প্রাপ্তবয়স্ক মশার লার্ভা বা শুক্রকীটগুলোকে মেরে ফেলা ও ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের দ্রুত চিকিৎসা করতে হবে।
দেশে মশার জীবনচক্র বদল নিয়ে (২০২১ থেকে ২০২৩) ‘অ্যাডাপশন অব এডিস ইজিপ্টি মসকিউটো লার্ভা ইন স্যুয়ারেজ, সি, ব্র্যাকি অ্যান্ড ড্রেইন ওয়াটার : আ নিউ চ্যালেঞ্জ ফর ডেঙ্গু কন্ট্রোল’ শীর্ষক একটি গবেষণা চলছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার এটি করছেন। ওই গবেষণায় দেখা গেছে, এডিস মশা সব ধরনের পানিতেই বংশবিস্তার করতে পারে। যদিও এতদিন বলা এডিস মশা পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে। কিন্তু গবেষণায় পাওয়া তথ্য বলছে স্যুয়ারেজ, ড্রেন এমনকি সমুদ্রের নোনা পানিতেও ডিম পাড়ে এবং জীবনচক্র সম্পন্ন করতে পারে এডিস মশা। জমে থাকা এক সেন্টিমিটার পানিতেও এই মশার বংশবৃদ্ধির প্রমাণ মিলেছে। শুষ্ক অবস্থায় এডিস মশার ডিম ৬ থেকে ৯ মাস পর্যন্ত জীবিত থাকে। সামান্য পানির সংস্পর্শে এলেই সেটি ফুটে লার্ভা তৈরি হয়। আগে এই মশা সকাল ও সন্ধ্যায় কামড়াত, এখন সব সময়ই কামড়াচ্ছে। তবে রাতে কামড়ানোর পরিমাণ কম। কবিরুল বাশার বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকার ১ লাখ ৩৪ হাজার ৯০৪টি মশার ওপর গবেষণা পরিচালনা করা হয়। বিকাল ৪টা থেকে রাত ৯টার মধ্যে দেখা যায়, এগুলো বিকাল ৪টায় যেমন সক্রিয়, রাত ৯টায়ও একইভাবে সক্রিয় ছিল। গবেষণাকালে ৫২ ধরনের প্রজননক্ষেত্র চিহ্নিত করে দেখা যায় এমন কিছু জায়গা আছে, যেখানে মশা নিধন কষ্টকর।
বুধবার শহীদ সোহরাওয়ার্দী তিনতলার ৩১৩নং শিশু ওয়ার্ডের ডেঙ্গুর জন্য নির্ধারিত আটটা বিছানার সবগুলোতেই দুজন করে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু ভর্তি আছে। কিন্তু একজন ছাড়া বাকিদের মশারি টানানো ছিল না। এই ওয়ার্ডের ২৬ নম্বর বিছানায় ভর্তি ৮ বছরের আনিশা তাসমিম। শিশুটি এসেছে তেজগাঁও বিজি প্রেস স্টাফ কোয়ার্টার এলাকা থেকে। সঙ্গে থাকা তার দাদা-দাদি বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে নাতনির হঠাৎ জ্বর আসে, এক পর্যায়ে ১০৪ ডিগ্রি উঠে যায়। প্যারাসিটামল ওষুধ খাওয়ানোর ফলে জ্বর কমা ও বাড়তে থাকে। কিন্তু তিন দিনেও পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হচ্ছিল না। বাধ্য হয়ে শনিবার সকালে সরকারি কর্মচারী হাসপাতালে নিয়ে যাই। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নির্ধারিত হাসপাতালটি কোনোভাবেই তাদের ভর্তি নেয়নি।