চলমান সরকারের আমলে ভয়ভীতিহীন নির্বাচন সম্ভব নয়; সন্দেহাতীতভাবে এই কথাটি প্রমাণ হলো। তারা ছাড়ল না, সমাজের একেবারে নিম্নবর্গের হিরো আলমকেও। তিনি কান্নায় ভেঙে পড়ে বলছিলেন, সরকারি দলের লোকদের মারের হাত থেকে বাঁচতে দৌড়ে আনসার বাহিনীর কাছে যাই। গাড়ি ভর্র্তি আনসারের সদস্য থাকলেও কেউ দুর্বৃত্তদের হাত থেকে আমাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি।’ অপর দিকে পুলিশ একই ঘটনা নিরাপদ দূরত্বে থেকে উপভোগ করছিল।
আওয়ামী লীগের সাথে নির্বাচনী প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে মাঠে মার খায়নি এমন প্রতিপক্ষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিএনপি ও জামায়াতের মতো বড় দলহীন নির্বাচনের মাঠ শূন্য হয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ এটি। প্রথমে তারা এই সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, সরকারি দলের বিপরীতে এরা এমন এক প্রতিপক্ষ ছিল যাদের অভিযোগ কোথাও পাত্তা পায়নি। তারা যত নিষ্ঠুর নির্দয়তার শিকার হয়েছেন তার বিচার চাইতেও তারা পারেননি। তারই ফল হিসেবে হিরো আলমের মতো লোকদের উত্থান ঘটেছে। একেবারে শক্তিহীন অবহেলিত এই নাগরিকরাও এখন ক্ষমতাসীনদের রোষানলে পড়ছে।
হিরো আলম সমাজের বঞ্চিত অংশের প্রতিনিধি। তিনি ছোট ছোট ভিডিও তৈরি করে ইউটিউবে ছাড়েন। নিম্নবিত্ত বস্তিবাসী ছিন্নমূল মানুষের জীবনের ছাপ রয়েছে তার নির্মিত ভিডিওতে। হিরো আলমের অভিনয় ও তার কাজকর্মে বাংলাদেশের শক্তিহীন দরিদ্র বিপুল জনগোষ্ঠী তাদের নিজেদের যেন খুঁজে পান। এ জন্য তার ভিডিও ভাইরাল হয়। দেশের জনপ্রিয় হাতেগোনা ইউটিউবারের মধ্যে তিনি একজন। তার কনটেন্টের বিপুল দর্শকই তার একমাত্র শক্তি। পুলিশ প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থার সমর্থন নিয়ে সমাজের অভিজাত শ্রেণী যে শক্তির চর্চা করে সেটা তার নেই। এর ওপরই ভর করে বগুড়ায় দু’টি সংসদীয় এলাকায় তিনি নির্বাচন করেছেন। একটিতে তিনি সামান্য ব্যবধানে হেরে যান। তিনি অভিযোগ করছেন, তাকে হারিয়ে দেয়া হয়েছে।
আজ হিরো আলম যে বেদম মার খেয়েছেন তার কারণ তার এই জনপ্রিয়তা। ক্ষমতাসীনরা জনপ্রিয়তার এই যায়গাটিকে শূন্য করেছিল। শূন্য মাঠে তারা একাই গোল দিয়ে যাচ্ছিল। নিম্নবর্গের হিরো আলমকে তাই নির্দয় মারধরের শিকার হতে হয়েছে। কিভাবে এ ভারসাম্যহীন রাজনৈতিক শূন্য মাঠ তৈরি হলো তার একটি গ্রাউন্ড রয়েছে। বর্তমান সরকারি দলই নিজেদের সুবিধার জন্য এটি তৈরি করেছে। রাজধানীর অভিজাত এলাকায় সচেতন মানুষের বসবাস। এখানে ভোট পড়েছে ১২ শতাংশের কম। নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষের আস্থা নেই। সরকারের আজ্ঞাবহ হওয়ায় তাদের প্রচারিত পরিসংখ্যান নিয়ে মানুষের সন্দেহ থেকে যায়। প্রকৃতপক্ষে ভোটের হার এর চেয়ে আরো অনেক কম হবে। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন ভোটের হার ৫ থেকে ৬ শতাংশের বেশি হবে না। সারা দিন মিডিয়া খবর পাঠাচ্ছিল ভোটারশূন্য কেন্দ্রের। বর্তমান সরকার ভোট নিয়ে মানুষের আগ্রহ সফলভাবে শেষ করে দিতে পেরেছে।
রাজনীতির মাঠে জামায়াতকে সরাতে তারা দলটির বিরুদ্ধে হেন কোনো প্রচারণা নেই যা চালায়নি। তাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধী, মানবতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী এ ধরনের ট্যাগ লাগিয়ে দিয়েছে। আমেরিকার সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইয়ের সুযোগে তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে জঙ্গিবাদের বাড়তি তকমা। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ আনা না গেলেও তাদের বিরুদ্ধে নাশকতার কল্পিত কাহিনী জুড়ে দেয়া হয়েছে। বিএনপির বিরুদ্ধেও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা, সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ আনা হয়েছে। তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচিকে নাশকতার চেষ্টা বলে ভণ্ডুল করে দেয়া হয়েছে। নির্বাচনের মাঠ থেকে বিপুল জনসমর্থন থাকা দলগুলোকে এভাবে কালিমালিপ্ত করে বিদায় করে দিয়েছে বর্তমান সরকার। ফাইনাল ডোজ হিসেবে মারপিট থেরাপির প্রয়োগ আমরা দেখছি সারা দেশে।
নির্বাচনী মাঠ শূন্য করার খেলায় তারা চরমোনাই পীরের দলকে সামনে এনেছে। বিগত এক যুগ ধরে সরকারের এই ধূর্তামি সহজে লক্ষ করা গেছে। বিএনপির মতো বড় দল সাম্প্রদায়িকতার জন্য রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে পারেনি, সেখানে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন মিছিল-সমাবেশসহ প্রকাশ্যে বড় বড় রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করেছে। বেশ কয়েক বছর ধরে তারা আওয়ামী লীগের স্থানীয় নির্বাচনগুলো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছে এমন দেখানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু সেখানেও গোল বাঁধল যখন দেখা গেল তারাও আওয়ামী লীগকে হারিয়ে দেয়ার সক্ষমতা অর্জন করছে। সর্বশেষ সিটি নির্বাচনগুলোতে তারা আওয়ামী লীগের জন্য কিছু কিছু জায়গায় প্রতিযোগিতা গড়ে তুলছে। এ ধরনের প্রতিযোগিতা গড়ে তোলার কারণ চরমোনাইয়ের পীরের দলটির জনপ্রিয়তা বেড়ে গেছে, তা নয়। বরং সরকারের প্রতি মানুষের অনাস্থা তার বহিঃপ্রকাশ। এ অবস্থায় পালিত দলটিকেও আওয়ামী লীগ আর সহ্য করতে পারল না।
সরকারি দল এতটাই অনিয়ম, দুর্নীতি ও সন্ত্রাস করেছে সাধারণ মানুষ সুযোগ পেলেই তাদের বিরুদ্ধে ভোট দেবে। গাজীপুর খুলনা রংপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় সেই লক্ষণ পাওয়া গেছে। বরিশালে চরমোনাই পীরের জনপ্রিয়তা রয়েছে। ক্ষমতাসীনরা আশঙ্কা করছিল চরমোনাইয়ের কাছে তাদের মেয়র প্রার্থী পরাজিত হতে পারে। দেখা গেল, এবার তারা চরমোনাই পীরকেও আর সহ্য করতে পারল না। তাকেও বেদম মারধর করল। আওয়ামী লীগের লোকদের কিল-ঘুষিতে তিনি রক্তাক্ত হলেন। হিরো আলমের মতোই তাকেও কান্নাকাটি করে বরিশালে সংবাদ সম্মেলন করত হলো। আজকের মতো সেখানেও নির্বাচন কমিশন ও পুলিশের কাছ থেকে উপযুক্ত পদক্ষেপ পাওয়া গেল না।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আওয়াল বললেন, এখনো পীর সাহেব মারা যাননি। পুলিশ সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে শক্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। দুঃখ শোকে পীর সাহেব আওয়ামী লীগের অধীনে আর কোনো নির্বাচন না করার ঘোষণা দিলেন। নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা ঠুকলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি বুঝতে পেরেছেন, আওয়ামী লীগ তাদের বন্ধু নয়। তিনি পক্ষ ত্যাগ করে বিএনপির এক দফায় সমর্থন ব্যক্ত করেছেন।
ঢাকার অভিজাত এলাকায় নির্বাচনের আগে পুলিশ কমিশনার বলেছিলেন, নির্বাচনে পুলিশ সঠিক দায়িত্ব পালন করতে না পারলে নাকে খত দিয়ে চলে যাবেন। ভোটের প্রচারণার সময় হিরো আলম দলীয় লোকদের দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়েছেন। তিনি আশঙ্কা করছিলেন, যেকোনো সময় তার ওপর হামলা হতে পারে। কথা অনুযায়ী পুলিশ কমিশনারের কোনো প্রস্তুতি দেখা গেল না। হিরো আলম ছাড়াও আরো একজন প্রার্থী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিরপেক্ষ না থাকার অভিযোগে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। নাকে খত বিষয়ে কমিশনার এখন কী বলবেন সবাই অপেক্ষা করছে। আমাদের আইনশৃঙ্খলায় নিযুক্ত পুলিশ বাহিনীর কিছু কর্তাব্যক্তি সঠিক দায়িত্ব পালনের বদলে ক্ষমতাসীন দলকে সার্ভিস দেয়ার প্রতিযোগিতা করেছে। এতে তাদের সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জাতি। সারা বিশ্বে তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে বদনাম ছড়িয়ে পড়েছে।
ক্ষমতাসীনরা একটি চক্র গড়ে তুলেছে। প্রশাসন, পুলিশ, নির্বাচন কমিশন যেন সেই চক্রের সদস্য। সবাই মিলে ক্ষমতাসীনদের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। সরকারি দলের লোকেরা বেদম মেরে তাদের প্রতিপক্ষকে খেদিয়ে দিচ্ছে। পুলিশ সেটা ‘চোখে দেখছে না’। নির্বাচন কমিশন অপেক্ষা করছে প্রার্থী মারা যায়নি, সে জন্য। বিএনপি-জামায়াত মাঠ থেকে সরে যাওয়ার পর যারাই এই শূন্য মাঠে আসবে, তাদেরই জন্য একই পরিণাম নেমে আসবে। তাই বাদ যায়নি ক্ষমতাহীন নিম্নবর্গের হিরো আলমও।
jjshim146@yahoo.com