টানা বর্ষণ এবং উজান থেকে নেমে আসা ঢলে তিস্তা ও কুমারনদের পানি বেড়ে যাওয়ায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত ও ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙন আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছের তিস্তা পাড়ের মানুষ। লালমনিরহাটে ১৭ সে.মি. ও নীলফামারিতে বিপদসীমার ১৪ সে.মি. ওপর দিয়ে এবং কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীতে দুধকুমার নদের পানি ৭৯ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে তিস্তার পানি বৃদ্ধিতে গাইবান্ধার নিম্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে বলে আমাদের সংবাদদাতারা জানান-
লালমনিরহাট থেকে মো. লাভলু শেখ : উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারী বর্ষণে তিস্তা নদীতে পানি প্রবাহ আবারও বেড়ে গেছে। এজন্য দেশের বৃহত্তর সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজের সব কটি জলকপাট খুলে দেওয়া হয়েছে। এ ভাবে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় আতংকিত হয়ে পড়েছে তিস্তা পাড়ের মানুষেরা। ফলে ৫ উপজেলার তিস্তার তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে বন্যা দেখা দিয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৬ টা থেকে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজে বিপদ সীমার ১৭ সে.মি. ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এতে করে নদীপাড়ের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে পানি কিছুটা কমলেও দেখা দিয়েছে জনগনের দুর্ভোগ। নতুন করে বন্যায় তলিয়ে গেছে বিভিন্ন ফসল পানিবন্দী হয়েছে কয়েকশত পরিবার।
বিকেল ৩ টায় তিস্তা নদীর ডালিয়া পয়েন্ট পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ডালিয়া পয়েন্ট-পানির সমতল ৫২.৩২ মিটার (বিপদসীমা=৫২.১৫ মিটার) যা বিপদসীমার ১৭ সে.মি. উপরে। কাউনিয়া পয়েন্ট-পানির সমতল ২৮.২২ মিটার, (বিপদসীমা=২৮.৭৫ মিটার) যা বিপদসীমার ৫৩ সে.মি. নিচে। ধরলা নদীর পানির পরিমাণ রেকর্ড করা হয় শিমুলবাড়ি পয়েন্ট-পানি সমতল ৩০.৮০ মিটার (বিপদসীমা=৩১.০৯ মিটার) যা বিপদসীমার ২৯ সে.মি. নিচে। পাটগ্রাম পয়েন্ট-পানি সমতল ৫৯.০০ মিটার, (বিপদসীমা=৬০.৩৫ মিটার) যা বিপদসীমার ১৩৫ সে.মি. নিচে। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আসফাউদ্দৌলা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
মঙ্গলবার শেষ রাত থেকে আবারও বাড়তে শুরু করে পানি। এতে হাতীবান্ধাস্থ তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে বিপৎসীমার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। ফলে জেলার ৫ উপজেলার তিস্তার চরাঞ্চলে ও তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে ধীরে ধীরে পানি প্রবেশ করতে শুরু করে। পানি বাড়ায় তিস্তা নদীর বুক জুড়ে থাকা ফসলি জমি পানিতে ডুবে যাওয়ার কারণে মরিচ, পেঁয়াজ, বাদাম, বীজতলাও ধানসহ বিভিন্ন ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে।
লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম, হাতীবান্ধার সানিয়াজান, গড্ডিমারী, সিন্দুর্না, পাটিকা পাড়া, সিংগিমারী, কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, কাকিনা, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা, পলাশী, সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, রাজপুর, গোকুন্ডা ইউনিয়নে বেশ কিছু এলাকায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন কয়েকশত পরিবার।
এদিকে ধরলা নদীর পানিও বাড়া-কমার মধ্যে আছে বলে জানিয়েছেন লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শুনীল কুমার। বর্ষা মৌসুমে জুন মাসের শুরু থেকে তিস্তার পানি বাড়া-কমার মধ্যে আছে। প্রথম দফা স্বল্পমাত্রার বন্যার পর পানির গতি অনেকটা স্বাভাবিক থাকলেও গত মঙ্গলবার ভোর থেকে বাড়তে শুরু করে পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ উল্যাহ এবিষয়ে বলেন, তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জরুরি প্রয়োজনসহ যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নেয়া রয়েছে। আমরা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও ইউএনওদের মাধ্যমে সব সময় পরিস্থিতির খোঁজখবর রাখছি।
নীলফামারী থেকে কামরুজ্জামান : পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি সূত্র জানায় ভারতের দোমহনি ও মেখলিগঞ্জে তিস্তায় পানি বিপদসীমা অতিক্রম করায় সেখানে হলুদ সংকেত জারী করা হয়েছে। সেই পানি হু হু করে ধেয়ে আসছে বাংলাদেশের দিকে। তাই সন্ধ্যায় তিস্তার পানি আরো বাড়বে বলে পাউবো সূত্র জানায়। এদিকে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ডিমলা উপজেলার পূর্বছাতনাই, টেপাখড়িবাড়ী, খগাখড়িবাড়ী, খালিশা চাপানি, ঝুনাগাছ চাপানি ও গয়াবাড়ী ইউনিয়নের প্রায় ১৫টি চরের মানুষজনের বসত বাড়িতে পানি উঠেছে বলে জানিয়েছেন ওইসব ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিরা।
গাইবান্ধা থেকে জোবায়ের আলী : টানা বর্ষণ এবং উজান থেকে নেমে আসা ঢলে তিস্তার পানি বেড়ে যাওয়ায় ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙন আতংকে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছের তিস্তা পাড়ের মানুষ। গত ১৫ দিনের ব্যবধানে হরিপুর ও কাপাসিয়া ইউনিয়নের দেড়শত পরিবারের বসতবাড়ি, শতাধিক একর ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের মুখে পড়েছে হাজারও পরিবার এবং ফসলি জমি। নদী পাড়ের মানুষজন রাত জেগে বসতবাড়ি পাহারা দিচ্ছে এবং অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছে। ভাঙন ঠেকাতে জিও টিউব ও জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের উপর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তার পানি বর্তমানে বিপদ সীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে উপজেলার হরিপুর ও কাপাসিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের তথ্য মতে, গত ১৫ দিনের ব্যবধানে ১৫০টি পরিবার এবং ২০০ হেক্টর ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলিন হয়ে গেছে। উজানের ঢলে নিচু এলাকা প্লাবিত হওয়ায় কমপক্ষে ৫০০পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। হরিপুরের কাশিমবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল ওয়াহেদ জানান, পানি বাড়ার সাথে সাথে ভাঙনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতিমধ্যে কাশিমবাজার এলাকায় শতাধিক পরিবারের বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের মুখে পড়েছে হাজারও পরিবার। অনেক পরিবার তাদের বসতবাড়ি সরিয়ে নিতে দিন রাত কাজ করছে। কাপাসিয়া ইউপি চেয়ারম্যান মনজু মিয়া জানান, তার ইউনিয়নের কমপক্ষে পাঁচ শতাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি ৭৫টি পরিবার নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ভাঙনের মুখে পড়েছে হাজারও পরিবার। যোগাযোগ ব্যবস্থা বিছিন্ন হয়ে পড়েছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ওয়ালিফ মন্ডল জানান, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের নিকট হতে পানিবন্দী ও নদী ভাঙনের শিকার পরিবারদের তালিকা সংগ্রহ করা হচ্ছে। গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিবার্হী প্রকৌশলী হাফিজুল হক জানান, ভাঙন ঠেকাতে হরিপুর ইউনিয়নের কাশিমবাজার এলাাকায় জিও টিউব ও জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। উপজেলা নিবার্হী মোহাম্মদ নূর-এ আলম জানান, উপজেলার হরিপুর ও কাপাসিয়া ইউনিয়নে তিস্তার ভাঙন দেখা দিয়েছে। চেয়ারম্যানদের তথ্য মোতাবেক দুই ইউনিয়নে দেড়শত পরিবার নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ভাঙনের মুখে পড়েছে অনেক পরিবার। ভাঙন কবলিত পরিবাগুলোকে শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে।
ভূরুঙ্গামারী ( কুড়িগ্রাম ) থেকে মো. মনিরুজ্জামান : গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীর সব কটি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ২ দিনে দুধকুমার নদের পানি ৭৯ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধির ফলে বন্যা আর ভাঙন আতঙ্কে দিন পার করছে নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষজন।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার দুধকুমার, ফুলকুমার, কালজানি ও সংকোষসহ সব কটি নদ নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃষ্টিতে খাল-বিল পানিতে টইটুম্বর হয়ে গেছে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে দুধকুমার নদের দুকুল উপচিয়ে নদী তীরবর্তী চর ও ডুবো চর পানিতে তলিয়ে গেছে।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, বৃহস্পতিবার দুপুর ১২ টা পর্যন্ত দুধকুমার নদীর পানি ভূরুঙ্গামারীর পাটেশ্বরী পয়েন্টে বিপদ সীমার ১৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
পাওবো জানায়, বাংলাদেশ ও উজানের অববাহিকায় ভারতের অরুণাচল, আসাম, মেঘালয় ও হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে বর্তমানে মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। ফলে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি পেয়ে জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে বিপদসীমায় পৌঁছাতে পারে। একই কারণে তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদের পানিও বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে।
সোনাহাট সেতু পাড়ের ব্যবসায়ী ফরিদুল ইসলাম বলেন, গত কয়েক দিন থেকে দুধকুমার নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। নদী পানি দিয়ে ভরে গেছে। পানি বাড়ার ফলে খুব ধীর গতিতে প্রবাহিত হচ্ছে।
দুধকুমার নদী পাড়ের বাসিন্দা আমজাদ, জুলহাস উদ্দিন ও আইনাল হক জানান, নদীর পানি বাড়লে ভয়ে থাকি। কখন যেনি জমি, গাছপালা ভেঙ্গে নিয়ে যায়।
পাইকেরছড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক বলেন, দুইদিন থেকে দুধকুমার নদের পানি খুবই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে নদ-নদীর পানি বেড়ে তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে প্রবেশ করায় ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এভাবে পানি বৃদ্ধি পেতে থাকলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। নদী ভাঙন দেখা দিতে পারে।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে নদ নদীর পানি আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। আজ দুপুরে দুধকুমার নদের পানি বিপদসীমার ১৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী ১৭ জুলাই পর্যন্ত নদ নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে।