নির্বাচন যখনই ঘনিয়ে আসে, তখনই সরকারের তরফ থেকে একেবারে প্রকাশ্যে নানা কারসাজি শুরু হয়ে যায়। কোনো সরকারের আমলেই এর তেমন কোনো ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায় না। নির্বাচনের দিন যত এগিয়ে আসে, ততই প্রশাসনে ব্যাপক রদ-বদল শুরু হয়ে যায়। সচিব থেকে শুরু করে ইউএনও পর্যন্ত সকল পর্যায়ে ঝাঁকে ঝাঁকে সরকারি কর্মচারিদের ব্যাপকভিত্তিক রদ-বদল শুরু হয়ে যায়। প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে নিজেদের লোক বিবেচনা করে অনেককেই এখান থেকে সেখানে, সেখান থেকে ওখানে বদলী করা হয়।
গত পাঁচ দিনে ২৮ জেলার ডেপুটি কমিশনারদের সরকার নির্বাচনে সুবিধা হতে পারে এমন জায়গায় বদলী করেছে। ডিসিরা সাধারণত নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। ফলে এসব জায়গায় এমন রিটার্নিং অফিসার দরকার, যিনি রেজাল্ট যাই হোক সরকারি নির্দেশ মোতাবেক যে কাউকে নির্বাচিত ঘোষণা করে দিতে পারেন। আর একবার নির্বাচিত ঘোষণা করে দিলে সেটা উল্টানো এক বিরাট যুদ্ধ। আমরা অনেক নির্বাচনেই দেখেছি, এই নির্বাচনের ফলাফল সঠিক করতে বছরের পর বছর কেটে যায়। শেষ হয়ে যায় জাতীয় সংসদের মেয়াদ, এ নিয়ে হাইকোর্ট, সুপ্রীম কোর্ট করেও কোনো ফায়দা হয় না।
শুধু যে জেলা প্রশাসকদের বদলি করা হচ্ছে, তাই নয় ঐ পাঁচ দিনে পুলিশের তেরজন সুপারিনটেন্ডেন্টকেও বদলি করা হয়েছে। আর পঁয়তাল্লিশজন নতুন ইউএনওকেও নতুন করে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এরা সবাই নির্বাচন ও ভোট গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এই পরিবর্তন। তাই বিশেষ প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যে ২৮ জন কর্মকর্তাকে ডিসি পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তাদের সাতজন কোনো না কোনো মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব হিসাবে কাজ করেছেন। আর এগারজন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে কর্মরত ছিলেন। যেসব ডিসিকে নতুন পদায়ন করা হয়েছে তারা বি.সি.এস ক্যাডারে কর্মরত ছিলেন। শিগগিরই যুগ্ম সচিব পদে নিয়োগ দেয়া হবে। বিভিন্ন সূত্র থেকে পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়েছে নতুন যাদের ডিসি নিয়োগ করা হয়েছে তারা সবাই নিয়োগ পেয়েছেন গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে রাজনৈতিক বিবেচনায়। আর যারা মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন তাদের সংখ্যা অতি সামান্য।
পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী এনামুল হক শামিমের ব্যক্তিগত সচিব আরিফুজ্জামানসহ ১০জন ডিসি হিসাবে নিয়োগ পেয়েছে ৬ জুলাই। তিনি ডিসি হয়েছেন শরিয়তপুর জেলার। ঐটা মন্ত্রীর নিজস্ব নির্বাচনী এলাকা। এ সম্পর্কে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেছেন, আরিফুজ্জামানকে অন্য কোনো জেলায় প্রশাসক নিয়োগ করা যেতো। তাকে একই জেলায় ডিসি করাটা চরম নৈতিকতা বিরোধী হয়েছে। যে ব্যক্তি ক’দিন আগেই মন্ত্রীর পিএস ছিলেন। তার পক্ষে মন্ত্রীর নির্দেশের বাইরে যাওয়া অসম্ভব।
মন্ত্রী কিংবা সচিবের যারা পিএস-এর কাজ করে নিঃসন্দেহে তাদের মন্ত্রী-সচিব ও দলীয় আনুগত্য থাকে। এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব এম আসাদুজ্জামানকে পাবনার ডিসি নিয়োগ করা হয়েছে। আইনমন্ত্রীর পিএস নূর কুতুবুল আলমকে পটুয়াখালীর ডিসি করা হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রীর পিএস মুশফিকুর রহিমকে কুমিল্লার জেলা প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের পিএস শাহ মোজাহিদ উদ্দিনকে বান্দরবানের জেলা প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারিকে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক এবং জাহাজ চলাচলমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিবকে যশোরের ডিসি করা হয়েছে। সাধারণত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে যারা কাজ করেন তাদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা অনেক বেশি থাকে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি সেক্রেটারি রেহানা আক্তারকে মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কর্মকা-ে জড়িত ছিলেন।
নির্বাচন হয় কি না হয় তা নিয়ে সংশয় এখনো দূর হয়নি। কিন্তু যদি হয়, তাহলে সে নির্বাচনে যে কোনো কৌশলে জয়লাভ করার সকল আয়োজন সরকার করে রাখছে।
এদিকে আবার জাতীয় নির্বাচনের আগে সরকার আইন করে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করেছে। নির্বাচনে অনিয়ম বল প্রয়োগের মতো ঘটনায় ভোট বন্ধে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা কমানো হয়েছে। গত ৪ জুলাই সংসদে জাতীয় নির্বাচন সংক্রান্ত আইন বা জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনী পাস হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের মাস ছয়েক আগে ইসির ক্ষমতা খর্ব করা নিয়ে বিরোধী দলের একাধিক সদস্য অভিযোগ করেন, যেভাবে আইন সংশোধন করা হচ্ছে, তাতে দেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। ক্ষমতা খর্ব হওয়ায় বর্তমান নির্বাচন কমিশন দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন করা যাবে না।
সংশোধিত আরপিও অনুযায়ী ভোট গ্রহণের আগে ইসি চাইলেও এখন আর ভোট বন্ধ করতে পারবে না। এছাড়া রিটার্নিং কর্মকর্তা ফলাফল ঘোষণা করার পর কোনো অনিয়মের অভিযোগ উঠলে পুরো আসনের ফলাফল স্থগিত বা ভোট বাতিল করা যাবে না। শুধু যেসব কেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ থাকবে, সেসব ভোট কেন্দ্রের ফলাফল চাইলে স্থগিত করতে পারবে ইসি। এ থেকে প্রমাণিত হয় সরকার কিছুতেই নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে দেবে না। ছলে বলে কলে কৌশলে তারা নির্বাচনে বিজয় ছিনিয়ে নেবে।
কিন্তু আগামী নির্বাচনের দিকে পশ্চিমা বিশ্বসহ সারা গণতান্ত্রিক দুনিয়া কঠোর দৃষ্টি রাখছে। সেখানে এই অপকৌশল কতটা সফল হবে,