খেলাপি ঋণ ব্যাংকগুলোর জন্য গলার কাটা হয়ে দাড়িয়েছে। দেশের ব্যাংকিং খাত তথা সামগ্রিক অর্থনীতির জন্যও এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এমনকি এই ঋণকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের নীরব ঘাতকও বলা হয়ে থাকে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের তৃতীয় মেয়াদে নতুন অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই অর্থনীতিতে গতি ফেরাতে এই নীরব ঘাতক দুরীকরণে নজর দেন আ হ ম মুস্তফা কামাল। খেলাপি ঋণের লাগাম টানতে বিশেষ সুবিধা প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
ইচ্ছাকৃত নয়; নানাবিধ কারণে মন্দ ও ক্ষতি জনিত মানে শ্রেনীকৃত খেলাপি হয়ে যাওয়া এবং ব্যবসা থমকে যাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে আবার সচল করার উদ্যোগ নেন। চিন্তা ছিল নগদ অর্থ ব্যাংকে আসবে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে, বন্ধ কলকারখানার চাকা সচল হবে এবং বাড়বে কর্মসংস্থান। এ জন্য ২০১৯ সালের মে মাসে জারি করা এক সার্কুলারে বলা হয়, ঋণ খেলাপিরা ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত স্থিতির উপর মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট প্রদাণ করে ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ পাবেন। পরবর্তীতে নানা কারণে এই সময় বৃদ্ধি পেয়ে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়। খেলাপি ঋণ নিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের এ যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। তদারিকর দায়িত্বে থাকা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঠিক তদারকির অভাবে প্রায় ৫ বছরেও সামনে আগায়নি। এমনকি এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে পরবর্তীতে অর্থমন্ত্রী, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কোন ধরণের উদ্যোগও চোখে পড়েনি। অথচ প্রতিদিনই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে খেলাপিদের ছাড় দিতে নতুন নতুন সুযোগ প্রদাণ করে সার্কুলার জারি করছে। গত মঙ্গলবারও খেলাপি ঋণ যাতে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে না যায়, এ জন্য ঋণ পরিশোধে ছাড় আবারো বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সুবিধার ফলে এখন কিস্তির ৫০ শতাংশ অর্থ জমা দিলেই কেউ খেলাপি হবেন না। আগে খেলাপির তালিকা থেকে বাদ পড়তে কিস্তির ৭৫ শতাংশ অর্থ জমা দিতে হতো। এ সুযোগ মিলবে চলতি মাস পর্যন্ত। গত সোমবার থেকে তা কার্যকর শুরু করা হয়েছে। যদিও সরকারে এ সিদ্ধান্ত অনেকেই সাধুবাদ জানিয়েছে। কিন্তু এখানেও মিলেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিন্ডিকেটের স্বার্থ। নিজস্ব সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠানকে নানা ছাড় দিতেই দু’দিন পর পর নতুন নতুন ছাড় দিয়ে সার্কুলার জারি করা হচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, খেলাপি ঋণ ছাড়ে সুযোগ নিচ্ছেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহসহ বিভিন্ন কর্মকর্তারা। স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে ছাড় প্রদাণে চলছে বড় অঙ্কের বাণিজ্য। অর্থ মওকুফের অঙ্কের একটি অংশ প্রদাণ করতে হয় শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ, উপ-সচিব মো. জাহিদ হোসেনসহ একটি সিন্ডিকেটকে। আর এই সিন্ডিকেটের কমিশনের ওপর নির্ভর করে চিঠির ভাষার মারপ্যাচ।
অর্থমন্ত্রীর ‘স্থিতির উপর মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট প্রদাণ করে ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ’ যুগান্তকারি এই সিদ্ধান্তের সুবিধা নেয়ার জন্য যারা অবেদন করেছেন অধিকাংশেরই দীর্ঘদিন থেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। ধার-দেনা করে ঋণ খেলাপির তকমা থেকে বের হওয়ার জন্য এই সুবিধার আওতায় অবেদন করেছিলেন। কিন্তু অবেদনের পরপরই মাহমারি করোনার বিপর্যস্ততার মধ্যে পড়া এবং পরবর্তীতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মন্দাবস্থার মধ্যে পড়েন গ্রাহকরা। আর এ সময় তদারকির দায়িত্বে থাকা সরকারের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিন্ডিকেটটি করেছে বড় অঙ্কের কমিশন বাণিজ্য। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের স্বার্থ না দেখে নিজেদের স্বার্থে ঘনিষ্টজনদের দিয়েছেন বাড়তি সুবিধা। যে কারণে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের যুগান্তকারী সিদ্ধান্তটি এক অর্থে ভেস্তে গেছে। অবশ্য এক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রীর নিজের তদারকির দুর্বলাতও ছিল। আবার তিনি যেসব আদেশ দিতেন তা বাস্তবায়নেও ছিলো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অনীহা। এক অর্থে অর্থমন্ত্রীর যুগান্তকারি সিদ্ধান্তুগুলো চাপা পড়ে যায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহের একগুয়েমি ও কমিশন বাণিজ্যের আড়ালে।
এদিকে দীর্ঘদিন থেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পর ধার-দেনা করে ঋণ খেলাপির তকমা থেকে বের হওয়ার জন্য অবেদন করেও সরকারের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তা না পেয়ে বরং অনেককে আবার পথে বসতে হচ্ছে। কারণ ধার-দেনা পরিশোধেরও কোন উপায় পাচ্ছেন না গ্রাহকরা। অথচ সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালীসহ বিভিন্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট প্রদাণ করে ঋণ পুনঃতফসিলের আবেদনকারীদের বিষয়টি সুরহার জন্য যখন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের অনুমোদনের জন্য পাঠাতেন। তখন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কর্মকর্তারা কমিশন নিয়ে সুদ মওকুফের একেক আবেদনে একেক নিদের্শনা দিতেন। ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এবং অনুসন্ধানে জানা যায়, ব্যাংক থেকে আবেদনকারীদের বিষয়ে আসা চিঠিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে তিন প্রকার চিঠি দেয়া হয়েছে। ঘনিষ্টজনদের ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে সমাধান, কাউকে বিআরপিডি সার্কুলার নং-৫ এবং বিআরপিডি সার্কুলার নং-১ অনুসরণ আবার অনেককে অনারোপিত সুদ মওকুফের প্রস্তাব বাতিল করে ঋণ পরিশোধের নির্দেশনা দিচ্ছেন। এসব চিঠির কারণে ব্যাংক ও গ্রাহকের সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে। আবার ব্যাংক সম্পর্কে বিরুপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যাংক কর্মকর্তারা অভিযোগ করে বলেছেন, উপসচিব (১) বীমা (২) নীতি ও আর্থিক প্রণোদনা (৩) অভিযোগ শাখার দায়িত্বে থাকা উপসচিব মো. জাহিদ হোসেন সচিবের নির্দেশে এবং বড় অঙ্কের কমিশনের বিনিময়ে এসব চিঠির ভাষা পরিবর্তন করতেন। এছাড়া মন্ত্রণালয়ের অনেক বিষয় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে পাশকাটিয়ে বিভিন্ন ব্যাংক ও গ্রাহককে হয়রানি করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক গুলোর বড় বড় কর্মকর্তাদের দিয়ে গ্রাহকের বিরুদ্ধে চিঠি করিয়ে নেয়া হয় বলে ব্যাংকগুলো সূত্রে জানা গেছে।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘নগদ অর্থ ব্যাংকে আসবে, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে, বন্ধ কলকারখানার চাকা সচল হবে এবং বাড়বে কর্মসংস্থান। এই চিন্তা ভেস্তে গেছে।
জানা গেছে, গত ২০২২ সালের ২৭ জুন সোনালী ব্যাংকের সিইও এন্ড ম্যানেজিং ডিরেক্টর মো. মুরশেদুল কবীর (ভারপ্রাপ্ত) বর্তমানে অগ্রণী ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর স্বাক্ষরিত চট্টগ্রামের আগ্রবাদ সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের গ্রাহক জরিনা কার্পেট মিলস লিমিটেড এর অনুকুলে অনুমোদিত সুদ মাওকুফ ঋণগ্রহীতাকে অবহিতকরণের ৩০দিনের মধ্যে পরিশোধের শর্ত ঋণ হিসাবটি সমন্বয়ের অনুমতি প্রদানের বাংলাদেশ ব্যাংকের নিদের্শনাসহ আথিক প্রতিষ্ঠানের সচিবকে চিঠি দেয়া হয়। এর জবাবে জরিনা কার্পেট মিলস লিমিটেডকে গত বছর ৬ সেপ্টেম্বর আথিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের উপসচিব মো. জাহিদ হোসেন স্বাক্ষরিত চিঠি দেয়া হয়। চিঠিতে বলা হয়, সোনালী ব্যাংক লিমিডেটের পত্র নংএসবিএল/প্রকা/ এপিএফডি/জরিনা কার্পেট মিলস লি: /৬৬৩/ তারিখ২৭.০৬.২০২২। উপযুক্ত বিষয়ে ও সূত্রস্থ, পত্রের প্রস্তাব মোতাবেক সোনালী ব্যাংক লি: আগ্রবাদ কপোরেট শাখা চট্টগ্রাম এর অবলোপনকৃত ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠান জরিনা কর্পেট লি:এর ঋণের সুদ মওকুফ এবং ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ব্যাংক পরিচালনা পরিষদ স্বীয় বিবেচনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে মর্মে পরামর্শ প্রদান করা হলো।
অন্যদিকে একইভাবে সোনালী ব্যাংক লি. রাজধানীর রমনা শাখার গ্রাহক মেসার্স সাস গার্মেন্টস লি. সুদ মওকুফকরণের জন্য আবেদন করেন। এর জবাবে গত বছর ২৯ মার্চ উপসচিব মো. জাহিদ হোসেন স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, আবেদনকারী সোনালী ব্যাংক রমনা কর্পোরেট শাখা ঢাকার একজন গ্রাহক। তার মালিকানাধীন সাস গার্মেন্টস লি. নামীয় প্রতিষ্ঠানের অনুকুলে ৫ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট জমা প্রদানপূর্বক বিআরপিডি সার্কুলার-০৫ সময় বৃদ্ধিকরণ বা বিশেষ বিবেচনায় সুদ মুকফুফোত্তর দায় দেনা অবসায়নের সুযোগ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হলো।
অন্যদিকে ২০২২ সালের ২১ নভেম্বর সোনালী ব্যাংক লিমিডেটের সিইও এ্যান্ড ম্যানেজিং ডিরেক্টর আফজাল করিম স্বাক্ষরিত সোনালী ব্যাংক স্থানীয় শাখার অপর এক গ্রাহকের অবলোপনকৃত অনারোপিত সুদ মওকুফের প্রস্তাব দিলে তার জবাবে উপসচিব জাহিদ হোসেন স্বাক্ষরিত টিঠিতে বলা হয়, উক্ত সার্কুলারে ব্যত্যয় ঘটিয়ে মওকুফ করার কোনো সুযোগ নেই। অথচ জরিনা কার্পেট মিলস লিমিটেডসহ শতশত প্রতিষ্ঠানের কাছে কমিশন নিয়ে সুদ মওকুফ করার চিঠি দেয়া হয়েছে।
২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট প্রদাণ করে ঋণ পুনঃতফসিলের অর্থমন্ত্রীর যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে নানা প্রতিবন্ধকতা এবং কমিশন বাণিজ্যের বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে গত কয়েক মাসে একাধিকবার কথা বলতে চাইলে সবাই সভা-সেমিনারে ব্যস্ত বলে জানিয়েছেন। এ নিয়ে কোন কথা বলতে তারা রাজি নয়।