সারা দেশে চলছে দাপদাহ। এবারের মতো দাপদাহ গত ৫০ বছরেও দেখা যায়নি। এর মধ্যে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে চরম লোডশেডিং। তীব্র জ্বালানি সঙ্কটের কারণে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় দেশের সর্বত্র লোডশেডিং একটি নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলমান বিদ্যুৎ সঙ্কটের কারণে গ্রামাঞ্চল ও অন্যান্য ছোট-বড় সব জেলা শহরের পাশাপাশি রাজধানীতেও বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে করে দেশের সর্বস্তরের জনগণ এক ভয়াবহ দুর্যোগ ও দুর্ভোগের জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে। হুমকির মুখে পড়ছে দেশের অর্থনীতি, চিকিৎসা ও শিক্ষাব্যবস্থা। ডিজিটাল বাংলাদেশের সব কিছুই যখন এখন বিদ্যুৎনির্ভর, সেখানে বিদ্যুতের অপ্রতুলতা সর্বস্তরের মানুষের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভয়াবহ মাত্রার এই বিদ্যুৎ সঙ্কটের অন্যতম প্রধান কারণ হলো- ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদার সাথে সাথে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন না হওয়া। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশে যেখানে বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে ১৫-১৬ হাজার মেগাওয়াটের উপরে সেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ১২ হাজার মেগাওয়াট। আর বিদ্যুতের এই ঘাটতি পূরণের জন্য এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ের মাত্রা আরো ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তা ছাড়া বিদ্যুতের অপব্যবহার, করোনা মহামারী এবং ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের ফলে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি যেমন ঘটেছে, তেমনি ডলার সঙ্কটের কারণে পর্যাপ্ত জ্বালানি আমদানি করতে বাংলাদেশ সরকারকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এমনকি তীব্র কয়লা সঙ্কটের কারণে গত ৫ জুন বন্ধ হয়ে গেছে দেশের বৃহত্তম ও সর্বাধুনিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। এর ফলে জাতীয় গ্রিডে অন্তত এক হাজার ২৫০ থেকে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
এ ছাড়া সিন্ডিকেটের কালো হাত এবং বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় ও বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর বিভিন্ন স্তরে অব্যবস্থাপনা, কারিগরি ত্রুটি, রক্ষণাবেক্ষণ ও জ্বালানি সঙ্কট বর্তমান পরিস্থিতির জন্য অনেকাংশেই দায়ী। এ সব কারণে দেশের সর্বমোট ১৫৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বৃহৎ একটি অংশ বছরের বেশির ভাগ সময় বন্ধ থাকে এবং যথেচ্ছ উৎপাদনশীলতা হারায়। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) তথ্য মতে, কেন্দ্রগুলোর দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের সমতা ২৭ হাজার ৩৬১ মেগাওয়াট থাকলেও এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড হলো ১৫ হাজার ৩০৪ মেগাওয়াট।
পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই ঘাটতি বৃদ্ধি পেয়েছে আরো কয়েকগুণ। তাই কোথাও কোথাও দৈনিক ১০ থেকে ১৫ ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের প্রভাবে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা এবং অর্থনীতি যে এক অপূরণীয় ভয়াবহ দুর্যোগের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
ক্রমবর্ধমান দাপদাহ ও লোডশেডিংয়ের প্রভাবে ইতোমধ্যে দেশের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে পারছে না। বিশেষ করে আসন্ন এইচএসসির শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ব্যাপক হারে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে বিভিন্ন অফিসিয়াল কাজকর্ম।
তা ছাড়া অপর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ এবং লোডশেডিংয়ের প্রভাবে বেশির ভাগ শিল্প-কারখানা উৎপাদন চালিয়ে যেতে হিমশিম খাচ্ছে। ইতোমধ্যে দেশের বেশির ভাগ মাঝারি ও ছোট শিল্প খাত উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়েছে। ঘন ঘন বিদ্যুৎবিভ্রাটের কারণে কারখানাগুলোর যন্ত্রপাতি যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তেমনি নষ্ট হচ্ছে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল। কমেছে মালিক ও শ্রমিকদের আয় এবং বৃদ্ধি পেয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য। এর মধ্যে যে কারখানাগুলো নিজেদের জেনারেটরের মাধ্যমে উৎপাদন চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে, অতিরিক্ত ডিজেল ও পেট্রলের খরচ মেটাতে গিয়ে সেসব কারখানার উৎপাদন খরচও প্রায় ১০ শতাংশ বেড়ে গেছে।
এমনকি দীর্ঘ সময় লোডশেডিংয়ের কারণে দেশের ছোট-বড় বিভিন্ন হাসপাতালে জরুরি বিভাগ প্রায় অকেজো হয়ে পড়ছে। এ ছাড়া অতিরিক্ত দাপদাহের সাথে সাথে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় বেড়েছে ডেঙ্গু ও হৃদরোগের প্রকোপ। স্বাস্থ্যঝুঁঁকিতে রয়েছে দেশের শিশু, বয়স্ক ও গর্ভবতী নারীরা। লোডশেডিংয়ের ফলে রাতের অন্ধকারে বেড়েছে চুরি, ছিনতাই, সন্ত্রাসী ছাড়াও অন্যান্য অপরাধ। সব মিলিয়ে জনজীবন হয়ে উঠেছে বিভীষিকাময়।
তবে গত ৫ জুন এক প্রেস কনফারেন্সে চলমান দাপদাহ ও লোডশেডিংয়ের প্রভাবে মানুষের দুর্ভোগের কথা ব্যক্ত করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ দুই সপ্তাহের মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হবে বলে আশ্বস্ত করেন। কিন্তু এই পরিস্থিতির পরিবর্তন আদৌ এত দ্রুত ঘটবে কি না তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। কেননা, বিশ্বজুড়ে যে হারে ডলার ও জ্বালানি সঙ্কট দেখা দিয়েছে এবং তীব্র দাপদাহের মাত্রা যেমন ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে, তাতে করে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান এত দ্রুত এবং খুব সহজেই সম্ভব নয়।
সরকার, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও সর্বস্তরের জনগণের সমন্বিত প্রচেষ্টাই কেবল এ পরিস্থিতি থেকে আমাদের নিস্তার দিতে পারে। প্রথমত, সরকার এবং বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষকে সর্বোচ্চ পরিমাণ স্থানীয় জ্বালানি উৎপাদনে আগ্রহী হতে হবে এবং প্রয়োজনীয় পদপে নিতে হবে। এতে করে জ্বালানি খরচ যেমন কমবে; তেমনি উৎপাদনে বৃদ্ধি পাবে। দেশে এখনো পর্যন্ত পাঁচটি কয়লাখনি আবিষ্কৃত হলেও একমাত্র বড়পুকুরিয়া কয়লাক্ষেত্র ব্যতীত বাকি চারটি কয়লাখনি থেকে এখন পর্যন্ত কোনো কয়লা উত্তোলন করা হয়নি। এ ছাড়া কারিগরি সক্ষমতা ও আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে দেশের বেশির ভাগ গ্যাসক্ষেত্র থেকে পর্যাপ্ত গ্যাস উত্তোলন ব্যাহত হচ্ছে। তাই সর্বপ্রথম দেশের অভ্যন্তরীণ প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী ফার্নেস অয়েলের দাম তুলনামূলক কম হয়ে ফার্নেস অয়েলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের চেষ্টা ফলপ্রসূ হতে পারে।
তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি সাশ্রয়ের দিকে দৃষ্টি দেয়া অধিক জরুরি। বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ সিস্টেম লস ও বিদ্যুতের অপচয় হ্রাস করতে হবে। পাশাপাশি নবায়নযোগ্য শক্তির সঠিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রত্যেককে নিজ নিজ জায়গা থেকে বিদ্যুৎ অপচয় রোধে সচেতন হতে হবে। অযথা ফ্যান, লাইট ও এসি চালিয়ে রাখা থেকে বিরত থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, বিদ্যুৎ আমাদের রাষ্ট্রীয় সম্পদ। তাই নিজ দায়িত্বে নিজের ও দেশের স্বার্থে এ ধরনের অপচয় রোধ করব এবং অন্যকে এ ব্যাপারে উৎসাহিত করব। জাতীয় সম্পদের সঠিক ব্যবহার এবং সমন্বিত উপায়ে সবার সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক জীবন যাপন নিশ্চিত করা দেশপ্রেমেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আর এরই মাধ্যমে আমরা লোডশেডিংয়ের মাত্রা ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারি।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
ইমেল : sanowarhossain.iu@gmail.com